Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আহমদ রফিক: ভাষা ও মননের প্রতীক

জন্ম ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ মৃত্যু ২ অক্টোবর ২০২৫

Icon

সাহিদা আক্তার

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আহমদ রফিক: ভাষা ও মননের প্রতীক

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে আহমদ রফিক এমন এক নাম, যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চিন্তা, গবেষণা ও লেখালেখির মধ্য দিয়ে জাতিকে আলোকিত করে গেছেন। তিনি ছিলেন একাধারে ভাষা আন্দোলনের সৈনিক, রবীন্দ্র-গবেষক, কবি, প্রাবন্ধিক ও প্রজ্ঞাময় বুদ্ধিজীবী, যার লেখনী ও চিন্তা আমাদের ভাষা, স্বাধীনতা ও মানবিক চেতনার গভীরে প্রোথিত। আহমদ রফিকের জীবন শুধু একজন ব্যক্তির জীবনের গল্প নয়; এটি এক জাতির মানস গঠনের অংশ।

১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন আহমদ রফিক। শৈশব ও কৈশোরের গঠনকালেই তিনি রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষার আলোয় বেড়ে উঠেছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হন। পাকিস্তানি শাসকদের বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে দমননীতি যখন ছাত্রসমাজে ক্ষোভের আগুন জ্বালাচ্ছিল, তখন সেই আন্দোলনের মিছিলে আহমদ রফিকের কণ্ঠ ছিল দৃপ্ত ও স্পষ্ট। তিনি কারাবরণও করেছিলেন, কিন্তু দমে যাননি। এ সংগ্রাম তার চিন্তার ভেতরে যে মানবিক ও ভাষাভিত্তিক চেতনা সৃষ্টি করে, তা সারা জীবন তার সাহিত্যকর্মে প্রবাহিত হয়েছে।

ভাষা আন্দোলনের পর তিনি যুক্ত হন শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চায়। শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা কলেজে, যুক্ত থেকেছেন বিভিন্ন সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে। তার লেখার মূল কেন্দ্রে ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কারণ রবীন্দ্রচিন্তাই তাকে মানবিকতার সর্বোচ্চ দিগন্তে পৌঁছে দেয়। রবীন্দ্র-গবেষণায় আহমদ রফিকের অবস্থান আজও অনন্য। তার গ্রন্থ রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ, রবীন্দ্রবোধ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, রবীন্দ্রনাথ : রাজনীতি ও সমাজচেতনা; এসব বই শুধু গবেষণাপত্র নয়, আমাদের জাতিসত্তার অনুসন্ধান। তিনি দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ শুধু সাহিত্যিক নন, তিনি ছিলেন স্বাধীনচেতা সমাজবিপ্লবী, যিনি বাঙালির আত্মপরিচয় নির্মাণে দিশা দেখিয়েছেন।

আহমদ রফিক ছিলেন যুক্তির দারুণ অনুশীলক। রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম ও মানবতাবোধ নিয়ে তিনি কখনো আপস করেননি। তার প্রবন্ধ ও নিবন্ধে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চিন্তার স্রোত প্রবল। তিনি ছিলেন এমন এক চিন্তাশীল লেখক, যিনি শুধু ইতিহাস লিখেননি, ইতিহাসকে ব্যাখ্যা করেছেন নতুন ভাষায়। তার লেখায় জাতীয়তাবাদ, মানবমুক্তি, শিক্ষা, সংস্কৃতি; সব মিলেমিশে গেছে এক সজীব স্রোতে।

একইসঙ্গে তিনি কবিতাও লিখেছেন। যদিও তার পরিচিতি গবেষক হিসাবে বেশি, তার কবিতায়ও বুদ্ধিদীপ্ত মানবিক অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নির্বাসিত নায়ক (১৯৬৬); বাউল মাটিতে মন (১৯৭০); রক্তের নিসর্গে স্বদেশ (১৯৭৯); বিপ্লব ফেরারী, তবু (১৯৮৯); পড়ন্ত রোদ্দুরে (১৯৯৪); ভালোবাসা ভালো নেই (১৯৯৯)।

তিনি সাহিত্যকে নিছক সৌন্দর্যচর্চা হিসাবে দেখেননি; দেখেছেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে।

আহমদ রফিক বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজে ছিলেন এক নৈতিক কণ্ঠস্বর। তিনি ছিলেন নির্ভীক, নিরাসক্ত ও নিরপেক্ষ সত্যবক্তা। যখন সমাজে তোষণ ও আত্মসন্তুষ্টির বৃত্ত ঘনিয়ে আসে, তখন তার মতো মানুষই আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন বৌদ্ধিক সততা ও বিবেকের আলোয়। তিনি রাজনীতি নিয়ে নির্দ্বিধায় মত দিতেন, তবে তা কোনো দলীয় প্রপঞ্চ নয়; ছিল বাঙালির মুক্ত চিন্তার পক্ষে স্পষ্ট অবস্থান।

স্বাধীনতার পর তিনি লেখালেখির পাশাপাশি সমাজ ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে সক্রিয় ছিলেন। বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মুক্তবুদ্ধির ধারাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে কাজ করেছেন, তা প্রজন্মের পর প্রজন্ম অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তার মতো মানুষের কারণে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে শুধু ‘কবিগুরু’ নয়, চিন্তার প্রতীক হিসাবে আবার আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে।

জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি ছিলেন লেখায়, আলোচনায়, সেমিনারে ও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে ভাববিনিময়ে। তার লেখনীতে একদিকে যেমন অতীতের স্মৃতি, তেমনি ছিল ভবিষ্যতের দিশা। তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘জাতির মুক্তি শুধু রাজনৈতিক স্বাধীনতায় নয়, সাংস্কৃতিক ও মানসিক স্বাধীনতায়।’ এ কথাটি তার চিন্তার সারমর্ম। তিনি চেয়েছিলেন এমন একটি বাংলাদেশ, যেখানে মানুষ নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও মানবিকতার আলোয় সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হতে পারবে।

আহমদ রফিকের গবেষণার ক্ষেত্র শুধু রবীন্দ্রনাথেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি নজরুল, বুদ্ধদেব বসু, শামসুর রাহমানসহ অন্যান্য সাহিত্যিকদের নিয়েও লিখেছেন। তার প্রবন্ধে দেখা যায়; বাঙালি সমাজের রূপান্তর, শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা এবং রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক সংকট নিয়ে গভীর বিশ্লেষণ। তিনি বারবার বলেছেন, ‘যে জাতি নিজের সংস্কৃতির প্রতি উদাসীন, সে জাতি কখনো উন্নত হতে পারে না।’ তার এ উক্তি আজও ততটাই সত্য, যতটা ছিল তার যৌবনে।

সমাজের বিভিন্ন সংকটে তিনি ছিলেন এক নৈতিক আলোকবর্তিকা। ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ, ও রাজনৈতিক বিভাজনের বিরুদ্ধে তিনি স্পষ্ট ও নির্ভীক অবস্থান নিয়েছেন। তার বক্তব্যে যেমন ছিল যুক্তি, তেমনি ছিল গভীর মানবিক বোধ। তিনি কোনো কৃত্রিম ভাষায় কথা বলতেন না; বরং জীবনের কাছাকাছি, মানুষের ভাবনা থেকে উঠে আসা কথায় তিনি মন ছুঁয়ে যেতেন।

বাংলাদেশের সাহিত্যে ও চিন্তাজগতে আহমদ রফিকের অবদান অসীম। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, রবীন্দ্র পুরস্কারসহ অসংখ্য স্বীকৃতি তার প্রজ্ঞার সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু তার প্রকৃত অর্জন ছিল মানুষের ভালোবাসা, ছাত্রদের শ্রদ্ধা, পাঠকদের মুগ্ধতা। তিনি নিজের কর্মে, চিন্তায় ও সততায় ছিলেন এক আলোকিত মানবের প্রতিচ্ছবি।

আহমদ রফিক যেসব পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন তার মধ্যে আছে ত্রৈমাসিক সাহিত্যপত্র নাগরিক (১৯৬৩-১৯৭১), দ্য ইস্ট পাকিস্তান মেডিকেল জার্নাল (১৯৬০-১৯৭০), দ্য মেডিকেল ডাইজেস্ট (১৯৬০-১৯৭০), পরিভাষা (১৯৬৮-১৯৭০), সুজনেষু (মিনি সাহিত্যপত্র,(১৯৭২-১৯৭৬) এবং বিজ্ঞানের জয়যাত্রা।

তিনি চলে গেলেন, কিন্তু রেখে গেলেন এক বিশাল মানসিক উত্তরাধিকার। আজ যখন সমাজে যুক্তিবোধ, মানবিকতা ও সংস্কৃতিচর্চা হুমকির মুখে, তখন আহমদ রফিকের চিন্তা ও জীবনাদর্শ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। তিনি আমাদের শেখান; স্বাধীনতা মানে শুধু শাসকের পরিবর্তন নয়, বরং চিন্তার মুক্তি।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে আহমদ রফিক এক দীপ্ত নক্ষত্র, যার আলো আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে। তিনি ভাষা, সাহিত্য ও মানবিকতার মাধ্যমে আমাদের যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, তা কখনো ম্লান হবে না। মৃত্যুর পরও তিনি রয়ে গেলেন আমাদের জাতীয় চেতনার এক অনন্ত আলো হয়ে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম