Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আমার কবিতা আমার শরীরের অংশ: বাতুল আবু আকলিন

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমার কবিতা আমার শরীরের অংশ: বাতুল আবু আকলিন

মানুষের মূল্য ক্রমশ নামছে। মানুষেরই প্রভুত্বকামিতা আর লোভ তাকে পরিণত করেছে শুধু একটি সংখ্যায়-সংবাদে, পরিসংখ্যানে অথবা পরিত্যক্ত স্মৃতিতে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ গাজা। এখানে একাকিত্বের গর্ভ থেকে যে শিশুর জন্ম, সে মুক্তি খোঁজে ভাষায়। আর সেই ভাষাই হয় তার একমাত্র আশ্রয়, একমাত্র প্রতিবাদ। হয়তো সেই কারণেই ধ্বংসস্তূপের শহরেও কেউ কেউ কবিতা লেখে-কারণ তারা জানে, শব্দই পারে মানুষের ছায়াটুকু বাঁচিয়ে রাখতে। তেমন এক কণ্ঠ বাতুল আবু আকলিন-গাজার তরুণ কবি, যার জীবনের প্রতিটি শ্বাস যেন যুদ্ধ, ক্ষতি ও আশার মধ্যবর্তী এক সেতু। তার কলমে মৃত্যু কেবল সমাপ্তি নয়, বরং ভাষার পুনর্জন্ম। ভিডিও কলে তার সঙ্গে গার্ডিয়ানের কথোপকথন অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন

জুন মাসের শেষ দিন, গাজার এক সাধারণ সোমবার। সমুদ্রের ধারে ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে পরিবারের অন্য সাতজনের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন বিশ বছর বয়সি বাতুল আবু আকলিন। ‘আমি হাতে ফালাফেল র‌্যাপ নিয়ে জানালার বাইরে তাকাচ্ছিলাম, হঠাৎ জানালাটা কেঁপে উঠল,’ তিনি বলেন। পাশের ক্যাফেতে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে, নিহত হন নারী, পুরুষ ও শিশুসহ বহু মানুষ। সেই মুহূর্তের বিস্ফোরণ যেন তার জীবনকেও চিরতরে দু’ভাগ করে দেয়-একদিকে বেঁচে থাকা, অন্যদিকে লেখা।

এ অবিশ্বাস্য নৃশংসতার ভেতর থেকেও বাতুল উঠে এসেছেন গাজার এক উজ্জ্বল ও অকপট কণ্ঠস্বর হয়ে। তিনি কেবল বেঁচে থাকার সাক্ষ্যই দেন না-বরং ভাষার নতুন সংজ্ঞা দেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘৪৮ কেজি’ (48Kg) ইতোমধ্যেই প্রশংসিত হয়েছে ঔপন্যাসিক অ্যান মাইকেলস, নাট্যকার ক্যারিল চার্চিল ও কবি হাসিব হুরানির মতো আন্তর্জাতিক সাহিত্যিকদের কাছে।

‘গ্রন্থটিতে আছে ৪৮টি কবিতা,’ বাতুল বলেন। ‘প্রতিটি আমার শরীরের এক কেজি ওজনের প্রতিনিধিত্ব করে। আমি আমার কবিতাগুলোকে শরীরের অংশ ভাবি। যদি কোনোদিন আমি টুকরো টুকরো হয়ে যাই, অন্তত আমার কবিতাগুলো যেন থেকে যায়-আমার দেহের বদলে।’

এ প্রতীকী বোধ কেবল আত্মরক্ষার নয়-এ এক নান্দনিক প্রতিরোধ। তার কবিতায় একদিকে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার থেকে নিক্ষিপ্ত ক্ষেপণাস্ত্র, অন্যদিকে কুকুরের কাছে হিমায়িত মৃতদেহ বিক্রি করা এক আইসক্রিম বিক্রেতা; আবার কোনো কবিতায় এক নারী মৃত শহরকে কোলে নিয়ে সেকেন্ডহ্যান্ড যুদ্ধবিরতি কিনতে বের হন-কিন্তু দাম ক্রমে বাড়তেই থাকে। এ কল্পচিত্রগুলো বাস্তবতারই সম্প্রসারণ, যেখানে অবাস্তবতা হয়ে ওঠে একমাত্র বোধগম্য ভাষা।

‘আমি এমন ভাষা খুঁজছিলাম, যা অক্ষমেরও মুখ খোলে, নির্বাকেরও আর্তনাদ বহন করে,’ তিনি বলেন। তার কবিতা তাই গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও বেঁচে থাকার নোটবুক। কিছু কবিতা ভৌতিকভাবে সুন্দর, কিছু নিষ্ঠুরভাবে সরল। যেমন এক কবিতায়-

‘একজন পথগায়ক একসময় আমাদের রাস্তায় বিরক্তি ছড়াত, এখন আমি প্রার্থনা করি-বিরক্তিটাই যেন ফিরে আসে।’

অন্য কবিতায় দাদার হাসপাতাল-মৃত্যুর কথা-‘এতই সাধারণ এক মৃত্যু যে, আমি কবিতাতেও তাকে তেমনই সাধারণভাবে লিখে ফেলেছি।’ কিন্তু দাদির মৃত্যু এত ভয়াবহ যে তা ভাষাকে চূর্ণ করে দেয়। এক ক্ষেপণাস্ত্র তার দেহ ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তখন কবিতায় নাতনি প্রশ্ন করে-

‘দাদি, তুমি কেন আমাকে সেলাই শেখালে না?

আমি তোমার মুখটা আবার জুড়ে দিতে পারতাম,

তারপর একবার চুমু খেতাম।’

এ বিচ্ছিন্ন অঙ্গ ও আলাদা হয়ে যাওয়া দেহের মোটিফ তার কাব্যজগতে বারবার ফিরে আসে-যেন গোটা শহরই হাত-পা হয়ে চিৎকার করে একে অপরকে খুঁজছে।

বাতুলের জন্ম গাজার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা আইনজীবী, মা সাইট ইঞ্জিনিয়ার। দশ বছর বয়সে লেখা শুরু করেন। তার শিক্ষক একদিন বাবা-মাকে বলেন, ‘তোমাদের মেয়ে প্রতিভাবান, যত্ন নাও।’ তারপর থেকেই মা-ই হয়ে ওঠেন তার প্রথম পাঠক ও সম্পাদক।

১৫ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক কবিতা প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে তিনি প্রথম আলোচনায় আসেন। এরপর গাজার নানা সাহিত্যপত্রে তার কবিতা ছাপা হতে থাকে। স্কুলে ইংরেজিতে ছিলেন সেরা এবং সময় পেলেই আঁকতেন বা বই পড়তেন। ‘আমার বড় স্বপ্ন ছিল অক্সফোর্ডে যাওয়া,’ তিনি বলেন। নিজের ডেস্কে লাগানো ছিল একটি নোটিশ-‘Oxford is waiting for you.’

ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজায় ইংরেজি সাহিত্য ও অনুবাদ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। দ্বিতীয় বর্ষে ওঠার ঠিক আগেই আসে ৭ অক্টোবর-হামাসের আক্রমণ এবং তার পরের অমানবিক প্রতিশোধ। ‘তার আগে আমি ছিলাম এক বাবল-এ বন্দি মেয়ে, প্রতিটি বিষয় নিয়ে অভিযোগ করতাম,’ বাতুল বলেন। ‘তারপর হঠাৎ দেখলাম, আমি শুধু দৌড়াচ্ছি-বেঁচে থাকার জন্য।’

এ বোধ থেকেই জন্ম নেয় তার অনেক কবিতা। এক জায়গায় তিনি লেখেন-

‘মাঝের আঙুল তুলেছি আসন্ন বোমার চোখে,

অনামিকা দিয়েছি সেই নারীকে, যে হারিয়েছে হাত ও স্বামী, কনিষ্ঠা আঙুল মিটিয়ে নিয়েছে সব ঘৃণিত খাবারের সঙ্গে।’

যুদ্ধ তাকে কেবল শারীরিকভাবে নয়, ভাষাগতভাবেও পালটে দিয়েছে। তিনি সব কবিতা প্রথমে লেখেন আরবিতে, তারপর ইংরেজিতে ‘পুনর্লিখন’ করেন। ‘এগুলো অনুবাদ নয়,’ তিনি বলেন। ‘আরবি সংস্করণ ভারী, সেখানে বেদনা ঘন। ইংরেজি সংস্করণ সাহসী, দৃপ্ত-ওটা আমার অন্য এক আমি।’

তার বইয়ের ভূমিকায় লেখা-‘আরবিতে আমি হারাচ্ছিলাম নিজেকে, মৃত্যুভয়ে ছিন্ন হচ্ছিলাম; ইংরেজিতে নিজেকে পুনর্গঠন করলাম, মৃত্যুর সঙ্গে শান্তি স্থাপন করলাম।’ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, তরুণ ফটোজার্নালিস্ট ফাতমা হাসুনা নিহত হন এক বিমান হামলায়। ফাতমার জীবন নিয়ে নির্মিত ডকুমেন্টারি Put Your Soul on Your Hand and Walk কানে প্রদর্শিত হওয়ার কথা ছিল।

এ ক্ষতির মধ্যেও তিনি শিখেছেন দৃঢ় হতে। ‘এই গণহত্যা আমার ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রেখেছে,’ তিনি বলেন। ‘উত্তর থেকে দক্ষিণে পালানোর সময় মনে হতো আমি পুরো পরিবারটাকে ধরে আছি। এখন আমি আর ভয় পাই না।’

একসময় তারা দক্ষিণের এক শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেন। ‘গ্যাস চুলা ছিল না, কাঠ জ্বালিয়ে রান্না করতাম,’ বাতুল বলেন। ‘মায়ের চোখ ধোঁয়ায় জ্বলত, তাই রুটি আমাকেই বানাতে হতো। রাগে রাগে হাত পুড়িয়ে ফেলতাম।’

যুদ্ধবিরতির সময় তারা ফিরে আসেন গাজা সিটিতে, সমুদ্রদৃশ্যওয়ালা একটি ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে। জানালার নিচে তাঁবু-যাদের ঘর আর নেই। এক কবিতায় তিনি লেখেন-

‘আমি বেঁচে থাকি, আর হাজার শহীদ পড়ে যায়,

আমি খাই, আর বাবা অনাহারে,

আমি লিখি, আর পাশের বাড়ির কবির হাত উড়ে যায়।’

এ কবিতার নাম Sin, যা দুটি কলামে লেখা। পাঠক চাইলে পড়তে পারেন উল্লম্বভাবে বা আড়াআড়ি-জীবিত কবি ও মৃত প্রতিবেশীর মাঝের অদৃশ্য দাগটিকে চাক্ষুষ করে তোলে এটি।

এখনো অনলাইন ক্লাস নেন, শিশুদের পড়ান, এমনকি গাজার রাস্তায় একা বেরোনও শুরু করেছেন। ‘আগে এটা ছিল বিপজ্জনক, এখনো বিপজ্জনক, কিন্তু আমি আর ভয় পাই না,’ তিনি বলেন। ‘আরেকটা জিনিস শিখেছি-অসভ্য হতে। খারাপ মানুষের সঙ্গে খারাপ ভাষা ব্যবহার করতে হয়। এটা আমাকে শক্ত করেছে।’

বাতুল বলেন, ‘আমি বইয়ের চেয়ে পৃথিবীকেই বেশি পড়েছি।’ হয়তো সেই কারণেই তার কবিতার প্রতিটি চিত্র যেন সময়ের আগেই বৃদ্ধ এক মস্তিষ্কের ছাপ। ‘যখন মৃত্যু তোমার পেছনে ছুটছে,’ তিনি বলেন, ‘তুমি জীবনটার ভেতর দৌড়ে পার হয়ে যেতে চাও- কারণ তুমি জানো, তোমার তরুণ হয়ে ভুল করার সময় নেই।’

এভাবেই বাতুল আবু আকলিন হয়ে উঠেছেন এক জীবন্ত প্রতীক-যেখানে কবিতা কেবল নান্দনিক প্রকাশ নয়, বরং আত্মরক্ষার এক প্রাচীন অস্ত্র।

সূত্র : দি গার্ডিয়ান

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম