Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

পাসোলিনি খুনের পঞ্চাশ বছর পর

Icon

ওয়াহিদ কায়সার

প্রকাশ: ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাসোলিনি খুনের পঞ্চাশ বছর পর

একইসঙ্গে ইতালির অন্যতম বিখ্যাত আর কুখ্যাত ফিল্মমেকার পিয়ের পাওলো পাসোলিনি। এটা হয়তো তার সময়াময়িক সব ফিল্মমেকারের মধ্যে নীতিগত অবস্থানের ভিন্নতা ও মেজাজের জন্য। অথবা তার সামাজিকতা ও প্রথাগত আদর্শ পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতার কারণেও। পাসোলিনিকে বলা যায় দ্বৈত সত্তার অধিকারী। কারণ ফিল্মমেকার হওয়ার পাশাপাশি তিনি একজন কবি ও উপন্যাসিকও। এর সঙ্গে তার সমকামিতা এবং বাইবেলে বিশ্বাস। অথবা একই সমান্তরালে তার কমিউনিজম আর ক্যাথলিক বিশ্বাসে আস্থা।

ইতালির বোলোনিয়া শহরে মিলিটারি এক পরিবারে ১৯২২ সালে তার জন্ম। তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন সাত বছর বয়সে, পড়াশোনা করেন বোলোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে, আর তারপর দ্বিতীয় বিশযুদ্ধে অংশ নেন। তার রেজিমেন্ট জার্মানির বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে যায় যখন ইতালি আত্মসমর্পণ করে। পাসোলিনি কাসারসা নামে একটা ছোট শহরে পালিয়ে যায় আর সেখানেই কিছু বছর বাস করেন। ১৯৪২ সালে তার প্রথম বই Poesie a Casarsa বের হয়। বইটি লেখা হয়েছিল ফ্রিউলিয়ান ভাষায়, যে ভাষায় তার মা কথা বলতেন। পাসোলিনির পরবর্তী অনেক চলচ্চিত্র কবিতায় লোকগাথা, নগরকথা, বাইবেলের কাহিনির দেখা মেলে।

পাসোলিনি ১৯৪৬ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন, কিন্তু সমকামী হওয়ার কারণে খুব তাড়াতাড়ি তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। আন্তোনিও গ্রামসির লেখা দ্বারা দারুণ অনুপ্রাণিত পাসোলিনি তবুও একনিষ্ঠভাবে পার্টিকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। কমিউনিজমের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করেছেন ক্যাথলিক বিশ্বাসকে। ফরাসি চিন্তাবিদ এবং তাত্ত্বিক গাই-আর্নস্ট দিবো সর্বপ্রথম স্পেক্টাকলের কথা বলেন তার দ্য সোসাইটি অব দ্য স্পেক্টাকল-এ। গাই দিবো এই স্পেক্টাকলকে দেখান মার্কেট ইকোনমির এক কর্তৃত্ববাদী রাজ হিসাবে। আমরা সবাই এ স্পেক্টাকলে বন্দি। পাসোলিনি নিজের যুগের স্পেক্টাকলকে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯৬২ সালে যখন তার শর্ট ফিল্ম La ricotta তে অরসন ওয়েলেসকে একজন পরিচালক হিসাবে স্ক্রিনে জিজ্ঞেস করান, ‘What do you think of Italian society? (Answer) The most illiterate masses, and the most ignorant bourgeoisie in Europe’, তখন এটা বুঝতে আর কারও বাকি থাকে না তিনি কোন জিনিসটার সমালোচনা করছেন। তার বিশ্লেষণ করার পদ্ধতি ছিল খামখেয়ালির ছলে দার্শনিকতা থেকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহজে প্রবেশ করানো।

পাসোলিনির কবিতার স্বরও প্রায় আড্ডা দেওয়ার মতো। তিনি ছিলেন প্রথমদিককার লেখকদের একজন, যিনি শহরের সীমানাকে তার যুগের ল্যান্ডস্কেপ হিসাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। পাসোলিনির লেখায় আরও একটা বিষয় স্পষ্ট, আর তা হচ্ছে যে, তিনি তার কাজের প্রায় সব জায়গায় যা বলার ইচ্ছা হয়েছে তা খুব বেশি সরাসরি বলেছেন। হারলেম থেকে ঘুরে আসার স্মৃতি তাকে রসদ জুগিয়েছে অনেক বছর। সেখানে ব্ল্যাক প্যান্থারদের সঙ্গে তার দেখা হয়। আর সেখানেই তিনি তাদের বিখ্যাত স্লোগানের সঙ্গে পরিচিত হন : ‘You gotta throw your bodz into the fight.’ এ স্লোগানটা পাসোলিনির এত বেশি ভালো লাগে যে তিনি নিজের একটা কবিতায় এটা ব্যবহার করেন। কবিতাটির নাম ছিল ‘Poet of Ashes.’

১৯৭০ সালে, রোমের এক বিচে তাকে হত্যার পাঁচ বছর আগে তিনি নিজের নির্বাচিত কবিতার মুখবন্ধ লিখেছিলেন। নির্বাচিত কবিতার কবিতাগুলো এসেছিল তিনটি বই থেকে : গ্রামসির ভস্ম (১৯৫৭), আমার সময়ের ধর্ম (১৯৬১) গোলাপের আকারের কবিতা (১৯৬৪)। ১৯৬৪ সালেই তার চলচ্চিত্র দ্য গসপেল অ্যাকরডিং টু সেইন্ট ম্যাথিউ মুক্তি পায়। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকেই তার বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে হয়তো সবচেয়ে বিখ্যাত তিওরেমা। জিওভান্নি বোকাচ্চিও’র ডেকামেরন, জিওফ্রে চসারের দ্য ক্যান্টারবেরি টেলস এবং আরব্য রজনীর কাহিনি অনুসারে বানানো ট্রিলজিও সমালোচকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। তার কাজগুলোর মাঝে কলঙ্ক হিসাবে কুখ্যাতি পাওয়া Salú, or the 120 Days of Sodom (১৯৭৬) মুক্তি পায় তাকে হত্যা করার তিন সপ্তাহ পর। এ চলচ্চিত্রে দেখান স্যাডিজম ও যৌন নির্যাতন যে কোনো দর্শকের জন্য একটি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ঐতিহাসিক অথবা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর কাহিনি হয়তো যথাযথ, কিন্তু স্ক্রিনে যৌন নির্যাতনের বর্ণনা পুরনরাবৃত্তি ঘটাতে এখনো অনেক সাহসী ফিল্মমেকার ভয় পাবেন। অনেকে বলেন, এ চলচ্চিত্র নির্মাণ করার কারণেই পাসোলিনিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তবে এর সত্যতা পাওয়া কঠিন, কারণ সবার সমুখে চলচ্চিত্রটি আসে পাসোলিনি হত্যার তিন সপ্তাহ পর।

তাকে রোমের এক বিচে হত্যার এ কাহিনি ভিন্ন দিকে মোড় নেয় যখন জিওসেপ্পে পেলোসি নামে একজন তাকে হত্যার কথা স্বীকার করে। তবে পেলোসির একার পক্ষে পাসোলিনিকে এমন নির্মমভাবে হত্যা করা কঠিন ছিল, অন্তত পাসোলিনির মৃতদেহে পাওয়া নির্মমতার ছাপ দেখলে। পাসোলিনির অনেক হাড় ভাঙা ছিল। তার অণ্ডকোষও থেঁতলে ফেলা হয়েছিল। এমনকি তার মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টাও করে হয়েছিল। পাসোলিনিকে হত্যার সময় পেলোসির বয়স ছিল মাত্র ১৭। তাই পেলোসির একার পক্ষে তাকে হত্যার ব্যাপারটা অদ্ভুত বলে মনে হয়। ২০০৫ সালে পাওয়া অন্যান্য প্রমাণ থেকে জানা যায়, পাসোলিনিকে হয়তো মাফিয়া গ্যাংয়ের কেউ খুন করেছে। পাসোলিনির বন্ধু সার্জিও সিত্তির সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, Salú, or the 120 Days of Sodom চলচ্চিত্রের কিছু রোল চুরি হয়ে গিয়েছিল এবং পাসোলিনি সুইডেনের স্টকহোম সফরের পর ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর চোরদের সঙ্গে দেখা করে সেগুলো ফেরত পাওয়ার আশা করেছিলেন। সিত্তির সাক্ষ্য ধরে আরও একজন প্রত্যক্ষদর্শীর খবর পাওয়া যায়, যিনি বলেছিলেন যে তিনি একদল লোককে মৃতপ্রায় পাসোলিনিকে গাড়ি থেকে টেনে বের করতে দেখেছিলেন। পেলোসি নিজের সাক্ষ্য প্রত্যাহার করে নিলে রোম পুলিশ হত্যাকাণ্ডটিকে পুনরায় চালু করে, কিন্তু তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রমাণ ও সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। এখন পর্যন্ত আসলে কেউ সঠিকভাবে জানে না পাসোলিনিকে কেন হত্যা করা হয়েছিল-নিজের কমিউনিস্ট বিশ্বাসের জন্য, না Salú, or the 120 Days of Sodom নির্মাণের জন্য।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম