‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থখ্যাত কবি
গোলাম মোস্তফা আছেন শৈলকুপার অন্তরে
মিজানুর রহমান, ঝিনাইদহ
প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
খ্যাতনামা কবি ও লেখক গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের অমর গ্রন্থ ‘বিশ্বনবী’র রচয়িতা হিসাবে অধিক পরিচিত। তার কবিতায় ইসলাম ও প্রেম প্রাধান্য পেয়েছে। ১৮৯৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের যশোর জেলার (বর্তমান বাংলাদেশ) ঝিনাইদহ মহকুমার মনহরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের এই প্রাণপুরুষ। গোলাম মোস্তফা ছিলেন একজন লেখক, অনুবাদক, গীতিকার, গল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক। তাকে অনেকে মুসলিম রেনেসাঁর কবি হিসাবেও উল্লেখ করে থাকেন।
ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে সবুজ গাছপালাঘেরা গ্রাম মনহরপুর। কুমার নদের পাড় ঘেঁষে গড়ে ওঠে এই গ্রাম। জন্মভিটায় নিজ হাতে লাগানো আম, লিচু, জামরুল গাছের সবুজ পাতায় কবির শরীরের ঘ্রাণ যেন আজও লেগে আছে। কুমার নদের ঘাটে রয়েছে কবির অসংখ্য স্মৃতি। গ্রামের প্রবীণদের কণ্ঠে ভেসে আসে কবির লেখা গান, ছড়া, কবিতার পঙ্ক্তিমালা। কবিকে নিয়ে গর্ব করেন তারা। নতুন প্রজন্মের মাঝেও কবির প্রতি রয়েছে গভীর ভালোবাসা।
মুসলিম জাগরণের কবি গোলাম মোস্তফা মনহরপুর গ্রামে বেড়ে ওঠেন। তার বাবা গোলাম রব্বানী ও মা মোছা. শরিফা খাতুন। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ছিলেন কবি। ছোট ভাই গোলাম কাওসার। দাদা কাজি গোলাম সরওয়ার ছিলেন আরবি ও ফারসি ভাষায় পণ্ডিত। কবির লেখাপড়ায় হাতেখড়ি হিন্দু পণ্ডিতদের হাতে। কিছুদিন পাঠশালায়ও অধ্যয়ন করেন। পরবর্তী সময়ে ভর্তি হন ইংরেজি স্কুলে। পদ্মা, গড়াই, কুমার, কালী নদের কলকল ধ্বনি শুনে বেড়ে ওঠা গোলাম মোস্তফার ধমনিতে ছিল কবিত্ব। ব্রিটিশ শাসনের সময় যশোর, কুষ্টিয়া, পাবনা অঞ্চলে নীলকর এবং ইংরেজ শাসকদের প্রতিপত্তি ছিল। বাউলসাধক আর গায়কদের পূণ্যভূমি হিসাবে খ্যাত এ জনপদে সেসময় হিন্দু সম্প্রদায়ের আধিক্য ছিল। সংস্কৃতিও ছিল হিন্দু ভাবাদর্শে প্রভাবিত।
পেশায় স্কুলশিক্ষক ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা। একজন মুসলিম শিক্ষক হিসাবে পিছিয়ে থাকা সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের তিনি ইংরেজি ও আধুনিক শিক্ষায় সমৃদ্ধ করেছেন। পোশাকে সাহেবি ভাব থাকলেও গোলাম মোস্তফা ছিলেন খাঁটি বাঙালি। কোট-টাই পরতেন। চোখে ছিল মোটা ফ্রেমের চশমা। সেসময়ে কলকাতাজুড়ে শিক্ষক হিসাবে পরিচিতি ছিল তার। অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ১৯১৩ সালে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী’তে ‘আন্দ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ শিরোনামের কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে গোলাম মোস্তফার সাহিত্যজগতে প্রবেশ। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্ত রাগ’ প্রকাশিত হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিচের দুই লাইন কবিতার মাধ্যমে কবিকে অভিনন্দিত করেছিলেন-
‘তব নব প্রভাতের রক্তরাগখানি
মধ্যাহ্নে জাগায় যেন জ্যোতির্ময়ী বাণী।’
কবি গোলাম মোস্তফার ছোট ভাই গোলাম কাওসারের ছেলে মুন্সি শওকত আলী ওরফে মুকুল মুন্সির সঙ্গে ১৯ জুলাই দুপুরে কথা হয় কবির জন্মভিটায়। কবির জরাজীর্ণ টিনের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে মুকুল মুন্সি স্মৃতির পাতা মেলে ধরেন। তিনি জানান, কবির মৃত্যুর সময় (১৩ অক্টোবর ১৯৬৪) তার বয়স ছিল ১৩ বছর। বর্তমানে তার বয়স প্রায় ৭০। সব কথা মনে নেই তার। কিন্তু কবির ভরাট কণ্ঠের হাসির শব্দ মাঝে মাঝে ভেসে আসে তার কানে। মুকুল জানান, কবিরা ছিলেন দুই ভাই। কলকাতায় শিক্ষকতা করার ফাঁকে ফাঁকে গ্রামে আসতেন। থাকতেন পশ্চিম পাশের টিনের চালা ঘরে। ওই সময় কলকাতার টালিগঞ্জ থেকে একটি খাট কিনেছিলেন কবি। সেই খাটেই ঘুমাতেন। শাল কাঠের টেবিল আজও অক্ষত রয়েছে। সেখানে বসেই লিখতেন গান, কবিতা। কবির ছিল দুই স্ত্রী। চার ছেলে ও তিন মেয়ের জনক ছিলেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের অমর ভাস্কর্য সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ নকশা করেছেন কবির নাতি, ছোট মেয়ে রাশিদা হক হেনার ছেলে স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। কবির প্রথম স্ত্রী মাগুরা জেলার কমলাপুরের জামেলা খাতুন। দ্বিতীয় স্ত্রী কলকাতার মাহফুজা খাতুন। প্রখ্যাত পিয়ানোবাদক মোস্তফা ফারুক মাহফুজা খাতুনের সন্তান। বড় স্ত্রী জামেলা খাতুনের বড় ছেলে মোস্তফা আনোয়ার ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাইলট। ফাইটার প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যান তিনি। অন্য ছেলেরা হলেন-মোস্তফা আজিজ (চিত্রশিল্পী), চিত্রশিল্পী মুস্তফা মনোয়ার (বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মহাপরিচালক ও প্রখ্যাত পাপেট নির্মাতা)। তিন মেয়ে হলেন ফিরোজা খাতুন (জোসনা), হাসিনা রহমান (হাছনা) রাশিদা হক (হেনা)। অস্কারজয়ী নাফিজ বিন জাফর কবির নাতি। ৭ সন্তানই নিজ নিজ গুণে আলোকিত করেছেন গোটা দেশ। জীবিত রয়েছেন তৃতীয় ছেলে শিল্পী মুস্তফা মনোয়ার।
কর্মজীবন শেষে ঢাকায় চলে যান কবি। নিজ গ্রাম মনহরপুরে ৫ বিঘা জমির ওপর টিনের বাড়িটি কবি নিজে তৈরি করেছিলেন। কবির বাড়ির অঙিনায় রয়েছে চমৎকার চৌচালা অপূর্ব নকশার একটি বৈঠকখানা। পাশে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল আকৃতির আম, জামরুল আর লিচু গাছ। তরতাজা সবুজ পাতাগুলো যেন কারও অপেক্ষায় সেজে রয়েছে। কিন্তু কবির আপনজনরা কেউ আসেন না।
গ্রামের একটি টং দোকানে বসা ছিলেন ৮০ বছর বয়সি বশির উদ্দিন মিয়া। তিনি জানান, কবির বাড়িতে গান, কবিতা, ভাবগানের আসর বসত। কবি নিজেও গান গাইতেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাউলসাধকরা ছুটে আসতেন এখানে। গ্রামের মানুষের সঙ্গে কবির নিবিড় সর্ম্পক ছিল। সবার ভালোবাসা পেয়েছিলেন কবি। বশির উদ্দিন মিয়ার বয়স হলেও কবির বিখ্যাত ‘বনভোজন’ ছড়ার চার লাইন এখনো মুখস্থ তার। কিন্তু লেখাপড়া জানেন না তিনি। শোনালেন-‘নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে/ আমবাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে।/ রাঁধুনিদের শখের রাঁধার পড়ে গেছে ধুম/ বোশেখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম।’
শুধু বশির উদ্দিন নন, গ্রামের প্রবীণ আরও অনেকের কণ্ঠে আবৃত্তি হয় বনভোজন ছড়াটি। গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব গোলাম মওলা বলেন, আমরা কবি গোলাম মোস্তফাকে নিয়ে গর্ব করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো দীর্ঘদিনেও কবির জন্মভিটা ঘিরে তেমন কিছু গড়ে ওঠেনি। গ্রামে কবির নামে একটি হাইস্কুল ছাড়া কিছু নেই।
কবির নাতনি (মুকুল মুন্সির মেয়ে) ফাতেমা আক্তার বলেন, এতদিন ঘর-বাড়ি সংস্কার করা হয়নি। এখন নতুন করে পারিবারিকভাবে পুরোনো বাড়িঘর সংস্কার করা হচ্ছে। বাইরের কিছু অনুদানও পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে ফাতেমা বলেন, স্বাধীনতার পর কবির মূল্যায়ন কম হয়েছে। পাঠ্যপুস্তক থেকে কবির কবিতা তুলে দেওয়া হয়েছে। গোলাম মোস্তফাকে পাকিস্তানপন্থি বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ ঘেঁটে দেখলে দেখা যাবে, কবির লেখায় বাংলাদেশ নিয়ে অনেক গান-কবিতা, সাহিত্য রয়েছে।
১৯৪২ সালে কবি রচনা করেন ‘বিশ্ব নবী’। কলকাতা থেকে বইটি প্রিন্ট হয়। গোলাম মোস্তফার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রক্ত রাগ’। গ্রন্থাবলির মধ্যে ‘হাসনাহেনা’ (কাব্যগ্রন্থ) ‘খোশরোজ’ (কাব্যগ্রন্থ), ‘সাহারা (কাব্যগ্রন্থ)’, ‘বুলবুলিস্তান’ (কাব্যচয়ন) উল্লেখযোগ্য। ‘রূপের নেশা’ ‘ভাঙ্গাবুক’ ‘একমন একপ্রাণ’ ইত্যাদি উপন্যাস বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। অনুবাদক হিসাবেও কবি গোলাম মোস্তফার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে।
মনহরপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত কবি গোলাম মোস্তফা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফিরোজ খান নুন বলেন, কবি গোলাম মোস্তফার সাহিত্যকর্ম-কবিতা, গান, উপন্যাস সম্পূর্ণ ইসলাম ধর্মের অনুশাসনকে তুলে ধরে। দেশপ্রেমের সেরা উদাহরণ তিনি। বাংলা সাহিত্যে রেনেসাঁর কবি গোলাম মোস্তফা চির অমর হয়ে থাকবেন।
