Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বিপ্লব জন্মায় রাস্তার ধুলোয়

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিপ্লব জন্মায় রাস্তার ধুলোয়

বিপ্লব কখনো প্রাসাদের মার্বেল মেঝেতে জন্মায় না; তার জন্ম হয় রাস্তার ধুলোয়, সাধারণ মানুষের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা আর চাপা ক্ষোভের মধ্যে। কিন্তু ক্ষমতার শিখরে থাকা মানুষ সেই গণমানুষের স্পন্দন শুনতে পায় কদাচিৎ। যখন তারা টের পায়, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালে ইরানে ঠিক তাই ঘটেছিল। যে বিপ্লব মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তার আগমনী বার্তা শাহের দরবার থেকে ওয়াশিংটনের করিডর পর্যন্ত কেউই বুঝতে পারেনি। আর চলমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল আর ইরানের মধ্যেকার আপাত শান্তি এক কাচের ঘরের মতো ভঙ্গুর; সামান্য আঘাতেই যা ভেঙে পড়তে পারে এক নতুন যুদ্ধের তাণ্ডবে। কিন্তু এ অন্তহীন সংঘাত, এ রক্তক্ষয়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতার শেকড় আসলে কোথায়? কীভাবে একদা পশ্চিমা বিশ্বের বন্ধু ‘ময়ূর সিংহাসন’ আজকের এই ঘোর শত্রুভাবাপন্ন, একঘরে ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হলো? এ ঐতিহাসিক ধাঁধার উত্তর আর ক্ষমতার অন্ধত্বের এক অমোঘ আয়না নিয়ে হাজির হয়েছে স্কট অ্যান্ডারসনের নতুন বই ‘King of Kings’, যা আমাদের দেখায় কীভাবে উপেক্ষা, ঔদ্ধত্য আর নীতিগত জড়তা একটি ‘স্থিতিশীলতার দ্বীপ’কে রাতারাতি এক উত্তাল সমুদ্রে পরিণত করতে পারে।

যুদ্ধ সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক এবং লেখক অ্যান্ডারসন লোভ, পক্ষপাত আর ঔদ্ধত্যের এ উপাখ্যানকে চারটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চমৎকারভাবে বুনেছেন: তেহরানের শাহের দরবার এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, যারা উভয়েই রাজপথের বাস্তবতা নিয়ে ছিল ইচ্ছাকৃতভাবে অন্ধ এবং নীতিগত জড়তায় পঙ্গু; খোমেনির অনভিজ্ঞ বিপ্লবীদের দল; এবং একজন আমেরিকান, যিনি আসন্ন বিপদ ঠিকই দেখতে পেয়েছিলেন, কিন্তু তার সতর্কবার্তায় কেউ কান দেয়নি। বিপ্লব আঁচ করাটা সরকারগুলোর জন্য সবসময় কঠিন হিসাবেই মনে করা হয়। যারা ক্ষমতার কেন্দ্রের সবচেয়ে কাছাকাছি থাকে, তারাই প্রায়শই সবার শেষে এর আভাস পায়। নীতিগত পক্ষপাত, অর্থের মোহ এবং গোষ্ঠীচিন্তার বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে সারা বিশ্বের কূটনীতিকদের ‘মিথ্যে বাঘের ভয়’ দেখানোর ব্যাপারে সতর্ক করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকেও মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে গুপ্তচরবৃত্তি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়, পথেঘাটে নয়, যেখানে বিপ্লবী চিন্তাভাবনা জন্মায় ও বেড়ে ওঠে। অ্যান্ডারসন লিখেছেন, ‘মার্কিন-ইরান সম্পর্ক যতই ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, একের পর এক মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মহামান্য শাহের সুনজরে থাকার ইচ্ছাও তত বাড়ছিল এবং তারা তাদের অধস্তনদের ভিন্নমতাবলম্বীদের সঙ্গে মেলামেশা করতে ততই নিরুৎসাহিত করছিলেন।’ একটি সুন্দর নীতির জন্য বাস্তবকে এড়িয়ে গেলে ক্ষতি কী?

১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তেহরান সফর করেন, এর পরের বছরটি ছিল স্থিতিশীলতার সম্পূর্ণ বিপরীত; ১৯৭৮ সাল ছিল দাঙ্গা, দমনপীড়ন আর অগ্নিসংযোগের বছর। এর মাঝে-মধ্যে বিভ্রান্তিকর শান্ত পরিস্থিতিও আসত, কিন্তু তার পটভূমিতে বাজতে থাকত খোমেনির সেই আপসহীন বার্তা: ‘শাহকে চলে যেতেই হবে।’ এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ওরফে শাহকে দেশত্যাগ করতেই হয়।

রাজপ্রাসাদের নৈশভোজ আর হোয়াইট হাউজের জৌলুস থেকে বহু দূরে, আমরা পরিচিত হই অ্যান্ডারসনের কাহিনির এক অনাড়ম্বর নায়কের সঙ্গে। তার নাম মাইকেল মেট্রিঙ্কো, একদা পিস কর্প-এর কিছুটা অদ্ভুত প্রকৃতির এক স্বেচ্ছাসেবক, যিনি পরে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা হন। সহকর্মীদের থেকে ভিন্ন, তিনি কেবল ফার্সিই বলতেন না, বরং ক্ষমতার বলয়ের বাইরে বেরিয়ে সাধারণ ইরানিদের সঙ্গে কথা বলার দুঃসাহসও দেখিয়েছেন। শাহ এবং তার দুর্নীতিপরায়ণ পারিষদবর্গের ক্রমবর্ধমান অপ্রিয়তা নিয়ে মেট্রিঙ্কোর বারবার দেওয়া সতর্কবার্তা তার ঊর্ধ্বতন, কেতাদুরস্ত সহকর্মীদের বিরক্তি আর হতাশাই কুড়িয়েছিল।

একবার মেট্রিঙ্কো ১৯৭৮ সালের তাবরিজের সেই অশুভ গণ-অভ্যুত্থান স্বচক্ষে দেখেছিলেন, যা কিনা কোম শহরের (যেটি ছিল ধর্মগুরু আর সেমিনারির কেন্দ্র) অনুরূপ ঘটনারই প্রতিক্রিয়া ছিল। তেহরানে ফিরে তিনি রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম সালিভানের কাছে জরুরি ভিত্তিতে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। উত্তরে সালিভান তার এ স্পর্ধার জন্য মেট্রিঙ্কোকে তিরস্কার করলেন, তার এই ‘বাড়াবাড়ি’র জন্য ভর্ৎসনা করলেন এবং ওয়াশিংটনকে আশ্বস্ত করলেন যে, রাস্তার বিক্ষোভ, ধর্মঘট বা আয়াতুল্লাহ খোমেনি নামক নির্বাসিত, স্বল্পপরিচিত এক ধর্মগুরুর ক্রুদ্ধ আস্ফালনে শাহের ক্ষমতার বিন্দুমাত্র কোনো হুমকি নেই।

বিপ্লব যতটা না মহৎ-আদর্শের কথা বলে, তার চেয়ে অনেক বেশি বলে স্থানচ্যুতি আর অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার কথা। ১৯৭০-এর দশকে ইরান পেট্রোডলারের যে জোয়ার দেখেছিল-যা ছিল ওপেক কার্টেলকে শাহের চতুরভাবে পরিচালনা এবং আমেরিকার তেল আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়ার ফল-তা এ দুই অনুভূতিরই জন্ম দিয়েছিল। ইরানের সমাজের শীর্ষস্তরে এক ধনী শ্রেণির উদ্ভব ঘটল, যারা সাধারণ নাগরিকদের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল। সাধারণ মানুষ তখন সম্পদের খোঁজে বড় বড় শহরে ভিড় জমিয়েছিল, কিন্তু পেয়েছিল কেবল বেকারত্ব আর হতাশা।

তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাহলভি দরবার বিলাসব্যসনের এক মহাযজ্ঞে মেতে ওঠে (অস্ত্র, শিল্পকর্ম, এবং আরও অস্ত্র), যা দুর্নীতি, অপচয় আর বেহিসেবিপনার এক দুষ্টচক্র তৈরি করে। এর সবচেয়ে কুখ্যাত উদাহরণ ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের ২,৫০০তম বার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৭১ সালের সেই জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব (বিবিসির মতে যার খরচ হয়েছিল আনুমানিক ১২ কোটি ডলার)। আর এসবকিছুই ঘটছিল এক অতি উত্তপ্ত অর্থনীতির পটভূমিতে, যা তেলের দাম সামান্য কমতেই নিজেকে আর টিকিয়ে রাখতে পারছিল না।

ফলস্বরূপ, ১৯৭৯ সালের আগের দশকে, লোভী অভিজাতদের চাপিয়ে দেওয়া আধুনিকতার অভিঘাতে ইরানি জনগণের মধ্যে পরিচয় হারানোর এক অনুভূতি দানা বাঁধছিল। ধর্মঘট আর রুটির দাঙ্গা লেগেই ছিল। খোমেনি ছিলেন সেসব ধর্মনিরপেক্ষ ও ধার্মিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে একজন মাত্র, যারা এক সরল অতীত হারানোর জন্য বিলাপ করতেন; কারণ সেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সুফল কেবল অভিজাত শ্রেণি আর তাদের বলয়ে থাকা সৌভাগ্যবান কিছু মানুষই ভোগ করছিল।

এ স্থানচ্যুতি, হতাশা আর মোহভঙ্গের শূন্যস্থানেই আয়াতুল্লাহ খোমেনির ইসলাম এবং শাহ ও তার মার্কিন মিত্রদের লাগামছাড়া ভোগবাদ নিয়ে বলা সহজ-সরল সত্যকথাগুলো প্রবলভাবে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। খোমেনির চরমপন্থি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি (যা তিনি ইরাক ও ফ্রান্সের নির্বাসন থেকে প্রকাশ করতেন) প্রচলিত শিয়া চিন্তাধারার পরিপন্থি ছিল, যা তাকে তার নিজ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠিত মতবাদের বাইরে ঠেলে দিয়েছিল। তবুও, লেখক যেমনটা দেখিয়েছেন, খোমেনির আধুনিকতাবাদী বামপন্থি অনুসারীর দল-ইব্রাহিম ইয়াজদি,

সাদেঘ ঘোতবজাদেহ এবং মেহেদিবাজারগান- ইচ্ছাকৃতভাবেই খোমেনির আরও রক্তাক্ত এবং সহিংস দৃষ্টিভঙ্গিকে ধোঁয়াশার চাদরে ঢেকে রেখেছিলেন। তারা তাকে এক কাজের পুতুল হিসাবে দেখতেন, যাকে বিপ্লবের আসল কাজ শেষ হয়ে গেলে কোম শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাদেরই, তারাই সেই কাজের পুতুলে পরিণত হয়েছিলেন, যাদের শেষ পরিণতি হয়েছিল নির্বাসন, মৃত্যুদণ্ড অথবা ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে ছিটকে পড়া। অ্যান্ডারসন তার কাহিনির ইতি টেনেছেন ১৯৭৯ সালের মার্কিন দূতাবাস অবরোধের ঘটনা দিয়ে, যেখানে ইসলামি বিপ্লবীরা মার্কিন দূতাবাসের কর্মীদের ৪৪৪ দিন ধরে জিম্মি করে রেখেছিল। ১৯৭০-এর দশকের সেই উত্থান-পতনের পরিবর্তে, সেই দশকের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা আর সামাজিক স্থানচ্যুতির বদলে, আজকের ইরান দেখছে বেকারত্ব, স্বজনপ্রীতি আর মুদ্রাস্ফীতির গভীরে এক ধীর, অবিচল পতন। আর আজ কোথায় সেই ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশার ফারাক, সেই তীব্র স্থানচ্যুতি? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, কোথায় সেই জোরালো কণ্ঠস্বর, যে ইরানি জাতীয়তাবাদের জমিতে দাঁড়িয়ে ইসলামি প্রজাতন্ত্রকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে অথবা সাংস্কৃতিক শিয়াবাদের গভীর ধারা এবং তার সঙ্গে জড়িত শাহাদাত ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সেই চেতনাকে ধারণ করতে পারে, যা আমরা শিয়া ইসলাম আর পারস্যের কিংবদন্তিতে দেখতে পাই? হয়তো কোথাও নেই।

সূত্র : ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম