Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

জুলাই অভ্যুত্থান : সাহিত্যিক সমাজের নীরবতা

Icon

শিবলী আজাদ

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই অভ্যুত্থান : সাহিত্যিক সমাজের নীরবতা

চোখের পলকেই চলে গেল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ১২টি মাস। অভ্যুত্থান-উত্তর, চাওয়াপাওয়ার অনেক কিছুই এখনো আর্জনের বাকি। অনেক হিসাবনিকাশ ও মূল্যায়ন ও পুনর্মূল্যায়নের পালা চলছে। গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি কারা, অভ্যুত্থানের প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন শত্রু-মিত্র নির্ণয়ের প্রচেষ্টা থেমে নেই। আলোচনা ও মূল্যায়নের ফোকাস অস্বাভাবিক নয় যে, এখনো রাজনৈতিক শক্তি ও আমলাতন্ত্রের ওপর নিবিষ্ট। ফ্যাসিবাদী শক্তির উত্থান ও চালিকাশক্তির প্রধান উৎস যে উপরিউক্ত দুই বলয়, বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু জনপরিসর ও পাবলিক ডিসকোর্সে ফ্যাসিবাদী শক্তির সপক্ষে সম্মতি উৎপাদন ও অবৈধ শাসনের বৈধতাদানের পেছনে ক্রিয়াশীল যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা এবং তার কুশীলব, অধিকাংশের অনুসন্ধিৎসায় তার আলোচনা হয়নি। সোজা কথায়, জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শক্তির সপক্ষে সক্রিয় বুদ্ধিজীবী ও লেখক-সাহিত্যিক সমাজের ভূমিকা এখনো মূল্যানের অপেক্ষায়। সময় এসেছে, বুদ্ধিজীবী ও লেখক সম্প্রদায়ের সামষ্টিক আচরণের সালতামামি তৈরির। কোন পরিপ্রেক্ষিতে, কী ধরনের এবং কেন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ও লেখক-কবিসমাজ স্বৈরাচারের তল্পিবাহক ও দলদাসে পরিণত হলো, ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তার নির্মোহ বিশ্লেষণ জরুরি।

বাম ঘরানার অধিকাংশ লেখক ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন জুলাই আন্দোলনের প্রতিপক্ষ। কথাটি অতিশয়োক্তি নয়, নিরেট বাস্তবতা। জনপরিসরে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বক্তৃতায়, পত্রিকার কলাম ও বিবৃতিতে এর ভূরিভূরি সাক্ষ্য মেলে। স্বৈরাচারী শেখা হাসিনা ও ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের সপক্ষে তারা অবস্থান নেয়। অবস্থান নেওয়ার পেছনে রুটি-রুজির ভাবনা, ক্ষমতার হালুয়া-রুটির প্রত্যাশা এবং পদলেহনের প্রতিদানরূপে মণিকাঞ্চনের প্রত্যাশাই একমাত্র কারণ নয়। দলদাস মনোবৃত্তির পেছনে ঐতিহাসিক কারণও বিদ্যমান। পূর্ববঙ্গে বাঙালি মুসলমানের নিজস্ব জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশের ইতিহাসে সে আচরণের উৎস লুক্কায়িত।

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’, মার্কসবাদী দলের সর্বজনীন স্লোগান। শুধু কথার কথা নয় স্লোগানটি। রুশ ও চৈনিক বিপ্লবের পর স্লোগানটির বাস্তব প্রয়োগও পরিলক্ষিত। উভয় রাষ্ট্র দুনিয়াজুড়ে বামপন্থি ও কমিউনিস্ট দলগুলোকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। ভিয়েতনাম ও স্নায়ুযুদ্ধের সময় সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। নব্বইয়ের দশকের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল সাহায্যের সে ধারা। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ও চীনের পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে উত্তরণ সাহায্যে ভাটা পড়ে। তারপরও মার্কসবাদী দলগুলো সীমানা পেরিয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সাহায্য প্রদান বজায় রাখে। শুধু বাংলাদেশ একমাত্র ব্যতিক্রম।

ভারতের দুই কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই ও সিপিএম-এর বাৎসরিক সম্মেলনে অন্য দেশের কমিউনিস্ট পার্টি আমন্ত্রণ পেলেও নিমন্ত্রণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় আওয়ামী লীগের নেতৃত কমিউনিস্ট পার্টিগুলো। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গাঁটছড়া দীর্ঘদিনের। গাঁটছড়া বাঁধার কারণে কংগ্রেসের বাৎসরিক অধিবেশনে আওয়ামী লীগের আমন্ত্রণ পাওয়াটা স্বাভাবিক। রুশপন্থি কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া, সিপিআই-এর অধিবেশনে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবির আমন্ত্রণ পাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। যদিও সিপিবির চেয়ে আওয়ামী লীগের ডেলিগেট দৃশ্যগ্রাহ্যভাবে প্রমাণিত, অধিকতর খাতির-যত্ন পায়।

কিন্তু চোখ কপালে ওঠার মতো অস্বাভাবিক বিষয় হচ্ছে, জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের নেতৃত্বাধীন চীনপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিএম, মার্কসসিস্ট ও লেনিনিস্ট) কাণ্ড। সিপিএম-এর বাৎসরিক সম্মেলনে বাংলাদেশের চীনপন্থি বাম দলগুলোর অনুপস্থিতির পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ডেলিগেটের রাজকীয় উপস্থিতি লক্ষণীয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কমিউনিস্ট ভ্রাতৃত্ববিরোধী আচরণ এবং শ্রেণিশত্রু আওয়ামী লীগ প্রীতির উৎস কী? সোজা কথায়, দলমত ও ভাবাদর্শ নির্বিশেষে সব ভারতীয় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি এবং সিভিল সোসাইটির কাছে আওয়ামী লীগের অভাবনীয় এ গ্রহণযোগ্যতার মাজেজা কোথায়? নিগূঢ় সে কারণ অনুধাবনের মাঝে লুকিয়ে আছে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রতি বাঙালি জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী ও লেখক-সাহিত্যিক সমাজের বিরোধিতার উৎস।

ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের প্রধান দুই কমিউনিস্ট পার্টি রুশ ও চৈনিক সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। বাংলাদেশের রুশপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির আরেক ভরসার স্থল ছিল ভারত সরকার। সোভিয়েত বন্ধু, ভারত সরকারের মাধ্যমে মস্কো বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ওপর প্রভাব বজায় রেখে এসেছে। রাজনৈতিক মিত্র ভারতকে ব্যবহার করে শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে চাপে রাখা ছিল রুশ কৌশল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্ব এ সমীকরণ নির্মাণ করেছিল। কালচারাল পলিটিক্স ও কালচারাল মতাদর্শ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক অভীষ্ট অর্জনের হাতিয়ার। রাজনৈতিক মতাদর্শের সপক্ষে সম্মতি উৎপাদনের অস্ত্র।

পূর্ব-পাকিস্তানের উদীয়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদের আকাঙ্ক্ষা রুশ ও ভারত অক্ষশক্তির পক্ষে সহায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। সোভিয়েত ক্লায়েন্ট স্টেট হলেও ঐতিহাসিকভাবে শক্তিশালী পুঁজিবাদী শ্রেণি ও সামরিক-বেসামরিক কালচারাল এলিট ও সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপস্থিতির কারণে, ভারত স্বকীয়তা বজায় রাখতে সমর্থ হয়। ভারত পূর্ণমাত্রায় সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্লায়েন্ট স্টেটে রূপান্তরিত হয়নি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ছায়ায় বেড়ে ওঠা রুশ সম্প্রসারণবাদ ও ভারতের আধিপত্যবাদের মতাদর্শিক মিলন ঘটে। ফলে, মার্কিন তাত্ত্বিক স্টিফেন কোহেনের ভাষায়, ব্রিটিশরাজ প্রশাসন থেকে উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত ইম্পেরিয়াল পলিসি অক্ষুণ্ন রাখতে সক্ষম হয়। কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক উপাদান পূর্ব পাকিস্তানের উদীয়মান রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অনুপ্রবেশ ঘটানো ছিল ভারতের তরফে রাজনৈতিক অভীষ্ট হাসিলের উপায়। সংস্কৃতিকে ভারত তার রাজনৈতিক ফায়দা তোলার ব্যবহারে তৎপর হয়। উন্নত ও সমৃদ্ধ এবং স্বকীয় নাগরিক সাংস্কৃতিক উপাদানের অনুপস্থিতির কারণে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের কালচারাল এলিট বিনাবাক্যে কলকাতাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক মতাদর্শ গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণি বামপন্থি ভাবাদর্শে বেড়ে ওঠে। তাদের চিন্তায় বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বামপন্থার ফিউশন ঘটেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আর বামপন্থা একাকার হয়ে যায়। কিন্তু সে বামপন্থা ছিল আমদানিকৃত, স্বদেশজাত নয়। পূর্ববাংলার লেখক ও বুদ্ধিজীবীর মনোজগতে কলকাতা ও দিল্লির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ভিত্তি ঘটে। বাকিটা ইতিহাস।

স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ক্ষুদ্র এ বামপন্থি গোষ্ঠী ডিসপ্রোপোরশনেট প্রভাব বজায় রেখেছে। আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চড়ে ক্ষুদ্র বামপন্থি মহল এ প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। আওয়ামী লীগের নিজস্ব বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের অভাব ও লীগ নেতৃত্বের ভারতনির্ভরশীলতা প্রভাব বিস্তারে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিল। সোজা কথায়, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বামপন্থার কনফ্লেশন ঢাকায় বামপন্থার জয়জয়কারে সাহায্য করে। দেশ ও জাতির ইথোস বিরোধী উগ্র বাঙালি বামপন্থার উত্থানের পেছনে অবশ্য দুটি ঐতিহাসিক ইন্টারেস্টিং টুইস্ট বিদ্যমান।

প্রথমত, ঢাকার বাঙালি জাতীয়তাবাদের আইকনিক ব্যক্তিত্ব, সবার চরিত্র কমবেশি সুবিধাবাদী ও সুযোগসন্ধানী। পুরো পাকিস্তান আমলে এরা পাকিস্তান সরকারের পক্ষে কাজ করেছে। পাকিস্তান সরকারের কলা-মুলো খেয়ে প্রতিষ্ঠা অর্জনকারী এদের দ্বৈতচরিত্র ইতিহাসে প্রমাণিত। হাতেগোনা দু-একজন ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সবাই ষাটের দশকে আইয়ুব সরকারের তল্পিবাহক হিসাবে কাজ করেছে। পাকিস্তান সরকারের পক্ষে প্রচারণা চালানোর লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত ব্যুরো অব ন্যশনাল রিকনস্ট্রাকশনের (বিএনআর) হয়ে প্রোপাগান্ডায় অংশ নিয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষে অসংখ্য বইপত্র ও প্যাম্ফলেট লিখেছে। রেডিও-টিভিতে প্রোগ্রাম করেছে। পাকিস্তানপন্থি নিউজ আউটলেটগুলো ভরপুর ছিল এদের লেখায়।

বিনিময়ে ব্যাপক আর্থিক সুবিধা, বৈষয়িক প্রণোদনা, পদ-পদোন্নতি ও সরকারি স্কলারশিপ এরা বাগিয়ে নেয়। ৭১-এর পুরো নয় মাস এরা ছিল নিশ্চুপ। সক্রিয়ভাবে কেউ মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেনি। গা বাঁচিয়ে দুই নৌকায় পা রেখে চলেছে। বাহাত্তরে ডিগবাজি দিয়ে এরাই উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদীতে রূপান্তরিত হয়। নিজের কদর্য অতীত ঢাকা এবং বৈষয়িক সুযোগ-সুবিধা বজায় রাখাই ছিল ডিগবাজির মুখ্য কারণ। অতীতের পদলেহনের অভ্যাস অনুসারে এবার তারা ভারতীয় আদর্শ প্রচারে উদ্যোগী হয়। মোদ্দা কথা, দ্রুতলয়ে প্রভু বদলায় লেহনের কাজ অক্ষুণ্ন রাখে। আহমদ ছফার বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) গ্রন্থ এদের কর্মকাণ্ডেরই সমালোচনা।

দ্বিতীয়ত, কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ আবার বরাবরই ছিল সাম্প্রদায়িক। বর্ণহিন্দুর সংকীর্ণ ভাবজগতে মুসলমানের অবস্থান শুধু অপরই নয় রীতিমতো শত্রুর কাতারে। উল্লেখ্য, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদের উৎস বাঙালি জাতীয়তাবাদের গর্ভে। বঙ্কিম-অরবিন্দ-বিবেকান্দ-শ্যামাপ্রসাদের হাত ধরে যে বাঙালি জাতীয়তাবাদ তৈরি হয়, তার মর্মমূল মুসলিমবিদ্বেষে স্থাপিত। কাস্টভিত্তিক সমাজে বামপন্থাও ফলে শুরু থেকেই বর্ণহিন্দুর কবজায় ছিল। বর্ণহিন্দুর সফট হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বামপন্থি রাজনীতিকেও প্রাভবিত করে।

বাঙালি বর্ণহিন্দুর রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক রাজনীতির ভিত্তি ছিল অর্গানিক সমাজের স্বপ্ন ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের রাজনীতি।

দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খেইম অর্গানিক সমাজকাঠামো তত্ত্বের উদ্গাতা। অর্গানিক সমাজকাঠামো তত্ত্বের মূল সারাংশ হচ্ছে : এ কাঠামোয় সমাজের সব শ্রেণির সক্রিয় ও পারস্পরিক সহযোগিতায় সমাজকাঠামো শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ফাংশন করে। ফলে সামাজিক শ্রেণিগুলো, তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়। অর্গানিক সমাজ কাঠামোয় সামাজিক ও শ্রেণিগত সংঘাত থাকে না। প্রত্যেক ব্যক্তি ও শ্রেণি নিজস্ব গণ্ডিতে বসবাস করে। সৌহার্দ ও সহযোগিতার পরিবেশ বিরাজ করে। সবচেয়ে বড় কথা, ডমিন্যান্ট শ্রেণির রাজনৈতিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক হেজেমনি ক্ষুণ্ন হয় না। অর্গানিক সমাজ ভার্টিক্যাল স্তরভিত্তিক সমাজ কাঠামো এন্ডোর্স করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভূ-স্বামীশ্রেণির উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজের চোখে অর্গানিক সমাজের আবেদন ছিল প্রচণ্ড।

শুদ্ধ বাঙালির ধারণা বস্তুত বর্ণহিন্দুর মানসপ্রসূত আরাধ্য এক চেতনা। কথিত এ চেতনা শতভাগ হিন্দু সম্প্রদায়কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের সমাজ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ ইসলামি উপাদান তাতে একেবারেই উপেক্ষিত, রীতিমতো ব্রাত্য। শুধু ব্রাত্য হলেও কথা ছিল না। শুদ্ধ বাঙালির প্রত্যয়ের চোখে ইসলামি বাঙালি সংস্কৃতির এন্টি-থিসিস। ইসলামি অনুষঙ্গ বাঙালি সংস্কৃতির ডিসরাপ্টার বাঙালি কালচারের অপর এবং অমোঘ ও অবশ্যম্ভাবী চরম শত্রু। বলাবাহুল্য, শুদ্ধ বাঙালির ধারণ ভিন্ন নামে ঊনবিংশ শতকের হিন্দু জাতীয়তাবাদের পুনরুত্থানের প্রকল্প। উদ্দেশ্য আর কিছুই নয়, পূর্ববাংলার মানুষকে ইসলামবিবর্জিত করার উদগ্র বাসনা। সেক্যুলার বাঙালি সংস্কৃতির আড়ালে বর্ণহিন্দুর সফট হিন্দুত্ববাদ গেলানোর সাংস্কৃতিক পাঁয়তারা। প্রগতিশীল ও মৌলবাদ বাইনারীর আড়ালে প্রচারিত এ সাংস্কৃতিক মানদণ্ডের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে ভেজিটেবলে রূপান্তরিতকরণ। পূর্ববাংলার দ্রোহী ও প্রতিরোধের ঐতিহ্য ভূলণ্ঠিত ও ম্রিয়মাণ করে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য জোরদার করা। কে না জানে, সাংস্কৃতিক আধিপত্য রাজনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ?

অস্বাভাবিক নয় যে, শুদ্ধ বাঙালির প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করানো হয় ইসলাম। সাংস্কৃতিক লড়াই বেগবানে আমদানি করা হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ইসলাম ও পাকিস্তান সমর্থক প্রচারণার আড়ালে আঁকা হয় ইসলামের অরিয়েন্টালিস্ট এক কল্পিত মৌলবাদী ও জঙ্গি রূপ। পুরো প্রক্রিয়া ছিল মূলত, ভারতীয় আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পিত এক সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ছক। আর টার্গেট করা হয় পূর্ববাংলার স্বকীয়তার ধারক কবি, লেখক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা দুই কবি, আল মাহমুদ ও সৈয়দ আলী আহসান আখ্যা পান প্রতিক্রিয়াশীল কবি রূপে। প্রগতির ধারকরূপে প্রচার পান শামসুর রাহমান ও হুমায়ুন আজাদ। অথচ, একাত্তরে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে কলাম লিখতেন শামসুর রাহমান। আর মুক্তিযুদ্ধের পুরো ন মাস পাকিস্তানি সরকারের অধীনে চাকরি করেছেন হুমায়ুন আজাদ।

সাবেক পাকিস্তানপন্থি কিন্তু অধুনা আওয়ামীপন্থি লেখক-বুদ্ধিজীবী উপরিউক্ত প্রচারণায় সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। লীগের ছত্রছায়ায় আওয়ামী লীগের সপক্ষে প্রচারণা চালানোয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের আড়ালে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদের চিহ্ন লুকিয়ে রাখা সহজতর হয়েছিল। কিন্তু শেয়াল কি আর গায়ের নিল রঙে ঢেকে রাখতে পারে? জুলাই অভ্যুত্থানে পদলেহী সারমেয় ও শেয়ালের কুৎসিত মুখ আজ উন্মোচিত। শ্বাপদের দল আজ বস্ত্রহীন। উলঙ্গ কুৎসিত ও কদাকার দেহাবয়ব আজ প্রকাশিত। মুখোশ খসে কুশ্রী মুখোশ্রী আজ আলোর নিচে। এখন দরকার, গোবৎ, বীভৎস এ পশুদলকে সমাজ ও বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলে অপাঙ্ক্তেয় ও অচ্ছুতের স্থান দেওয়া। একঘরে করে রাখা-বাংলার মাটি কলুষিত করার সুযোগ যেন আর না পায় হায়েনার দল।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম