ডেঙ্গুতে এত মৃত্যু কেন
ডা. ইব্রাহিম মাসুম বিল্লাহ
প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ডেঙ্গু আজ এক নীরব মহামারিতে পরিণত হয়েছে। কয়েক বছর আগেও যেটিকে আমরা ‘বর্ষার রোগ’ বলে ভাবতাম, সেটি এখন সারা বছরব্যাপী ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য সংকট (Public Health Emergency)। এডিস মশার বিস্তার, ভাইরাসের ধরন পরিবর্তন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, আর দুর্বল নগরব্যবস্থাপনা সব মিলিয়ে ডেঙ্গু এখন আমাদের শহর জীবনের এক স্থায়ী আতঙ্ক।
এ মৃত্যুর মিছিলের পেছনে শুধু ভাইরাসের তীব্রতাই নয়, লুকিয়ে আছে আমাদের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা এবং ব্যক্তিগত দায়িত্বহীনতার কষ্টদায়ক প্রতিফলন। অগোছালো নগরায়ণ, অপরিকল্পিত আবাসন, নোংরা ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে স্তূপ মিলিয়ে শহরগুলো ডেঙ্গু মশার আদর্শ প্রজননভূমিতে পরিণত হয়েছে। ছাদের ট্যাংক, ফুলের টব, নির্মাণাধীন ভবনের ড্রাম সব জায়গায় জমে থাকে স্থির পানি।
কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে অভিযান চালায় বটে, কিন্তু ধারাবাহিক, সমন্বিত ও টেকসই পদক্ষেপের (Integrated Vector Control Program) অভাবে মশা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগগুলো টেকে না।
ডেঙ্গু শনাক্তে বিলম্ব, হাসপাতালে ভর্তি হতে দেরি এবং তরল ব্যবস্থাপনায় (Fluid Mismanagement) ভুল এই তিন কারণেই মৃত্যুহার বাড়ছে। প্রতি মৌসুমেই রোগীর চাপ বাড়লে সরকারি হাসপাতাল তো বটেই বেসরকারি হাসপাতালেও বেড সংকট দেখা দেয়, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সের অভাবও প্রকট হয়ে ওঠে।
অন্যদিকে অনেক রোগী প্রাথমিক পর্যায়ে জ্বরকে ‘সাধারণ জ্বর’ ভেবে সময় নষ্ট করেন। ফলে Critical Phase, Plasma Leakage বা Multi-Organ Failure অবস্থায় হাসপাতালে পৌঁছালে চিকিৎসা দেওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন (DEN-1 থেকে DEN-4) রয়েছে।
একবার কোনো এক ধরনে আক্রান্ত হলে কিছুটা সুরক্ষা পাওয়া যায়, কিন্তু অন্য ধরনে সংক্রমিত হলে জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে একাধিক ধরন একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে ‘Secondary Infection’ বা পুনঃসংক্রমণের হার বাড়ছে, যা মৃত্যুর অন্যতম কারণ। ডেঙ্গু প্রতিরোধে জনগণের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এখনো অনেকেই মনে করেন, ‘ডেঙ্গু শুধু বর্ষায় হয়’ বা ‘মশারি ব্যবহার করলেই যথেষ্ট।’ বাসা, অফিস, স্কুল, হাসপাতাল সব জায়গায় পানি জমে আছে কিনা, তা সপ্তাহে অন্তত একদিন নিয়ম করে পরীক্ষা করা জরুরি।
Source Reduction Activity, অর্থাৎ মশার সম্ভাব্য প্রজননস্থল ধ্বংস করা এটাই সবচেয়ে কার্যকর প্রতিরোধ কৌশল। অনিয়মিত বৃষ্টি, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মশার জীবনচক্র দীর্ঘ হচ্ছে। এতে সংক্রমণের সময়কালও লম্বা হচ্ছে, আর মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ছে।
ডেঙ্গু এখন শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, এটি জাতীয় সমস্যা। একদিকে চিকিৎসা প্রস্তুতি বাড়াতে হবে, অন্যদিকে সরকার বিশেষত নগর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে দায়িত্ব। প্রতি বাড়ি, অফিস, স্কুল ও প্রতিষ্ঠানে গড়ে তুলতে হবে নিজস্ব ‘অ্যান্টি-ডেঙ্গু ইউনিট।’ মশা মারার চেয়ে মশা জন্মাতে না দেওয়াই হবে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শুধু ডাক্তার বা প্রশাসনের নয় এটা আমাদের সবার। সম্মিলিত সচেতনতা ও দায়িত্ববোধই পারে মৃত্যুর এ মিছিল থামাতে।
লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মাদানী হসপিটাল লিমিটেড, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফরাজী হাসপাতাল বারিধারা।
