মানবমুক্তির কবি ছিলেন ফররুখ আহমদ: আবদুল হাই শিকদার
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৮ জুন ২০২৫, ১০:৪৯ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
যুগান্তর সম্পাদক দেশবরেণ্য কবি আবদুল হাই শিকদার বলেছেন, কবি ফররুখ আহমদকে ইসলামি রেনেসাঁর কবি বলে তাকে গলির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি বাংলা সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে তার বিচরণের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বাংলা সাহিত্যের ক্যানভাসের আলোকে তার বিচার করা উচিত।
আবদুল হাই শিকদার বলেন, মার্কসীয় চিন্তা-চেতনার মানুষ হলেও তিনি (ফররুখ আহমদ) সেখানে যাননি। তিনি একাধারে লিখলেন মানবরচিত কোনো মতবাদ মানুষের মুক্তি আনতে পারে না। তিনি ইসলামি বিপ্লবের চেতনার সঙ্গে যুক্ত হলেন। এটা হলো তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। এখানে তার শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত আছে। আসলে তিনি ছিলেন মানবমুক্তির চেতনার কবি। যিনি তার সাহিত্যে একাধারে প্রেমকাহিনি, রূপকথা ও ইসলামি চেতনা মানব মুক্তির উজ্জীবিত এক অনন্য বৈশিষ্ট্যধারী ছিলেন। তার সাহিত্যের বিষয় গবেষণা ও পড়ার মাধ্যমে জানা সম্ভব।
শনিবার (২৮ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে কবি ফররুখ আহমদের ১০৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত সেমিনারে বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
ফররুখ গবেষণা ফাউন্ডেশন এই সেমিনারের আয়োজন করে। আয়োজক সংগঠনের সহসভাপতি আবুল কাসেম হায়দারের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক মাহবুব আলম গোরা, কবি ও চিন্তক ড. মাহবুব হাসান, কবি জয়নুল আবেদীন, কবি হাসান আলীম, কবি শাহীন রেজা, কবি শামীমা চৌধুরী, কবি নুরুন্নাহার নীরু, কবি হুসাইন আলমগীর, কবি লিলি হক, কবি আবিদ আজম, ইমরান মাহফুজ। অনুষ্ঠানে কবির কবিতা আবৃত্তি করেন নাসিম আহমেদ, শায়লা আহমেদ, আশরাফুল ইসলাম, সৈয়দ ওয়াহিদুজ্জামান বাচ্চু। কবির লেখা গান পরিবেশন করেন আমীরুল মোমেনীন মানিক, তাওহীদুল ইসলাম প্রমুখ।
আবদুল হাই শিকদার বলেন, ১৯৩০-এর দশকে কলকাতাকেন্দ্রিক কবি ও সাহিত্যিকরা ইউরোপীয় বিভিন্ন কবিতা ও সাহিত্যের ভাবানুবাদ করে বাহবা কুড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে কোনো মৌলিক লেখা ছিল না।
তিনি বলেন, এই অঞ্চলের ৮০ শতাংশ মানুষ বৌদ্ধ ছিল। সেনবংশ হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য এখানে গণহত্যা চালিয়েছিল। বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারে রক্ষিত সব জ্ঞান-বিজ্ঞানকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। বাংলা ভাষার আদি সাহিত্য চর্যাপদকে নেপালের জঙ্গল থেকে আবিষ্কার করতে হয়েছিল। সে সময় মাত্র ৪৭টি গান হলো বাংলা সাহিত্যের আদি সম্পদ। ৪০০ বছর ধরে বাংলার কবিরা কি এই ৪৭টা গান লিখেছিলেন? এই নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে পরে মুসলিম শাসক ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা জয়ের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশের পাঠ্যবইয়ে ভারতের বিজেপির নরেন্দ্র মোদির প্রেসক্রিপশনে মুসলমানদের বহিরাগত হিসাবে দেখানো হয়েছে। বরং আর্যরা বহিরাগত।
আবদুল হাই শিকদার বলেন, এ দেশের লোক হলো হরপ্পা সভ্যতার, দ্রাবিড়রা, গঙ্গা রেড্ডিরা। তারা কোথায়? মুসলমানরা এই দেশ বিজয় করে এ দেশের সম্পদ তারা ইউরোপীয়দের মতো পাচার করেনি। তারা নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত জনতার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তৈরি করেছেন। যে কারণে বাংলা ভাষার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হলো।
তিনি বলেন, ড. দীনেশচন্দ্র সেন বলেছিলেন, মুসলমানদের বাংলা বিজয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৌভাগ্যের সুপ্ত দুয়ার খুলে দিয়েছিল। মুসলমানরা যদি বাংলা বিজয় না করত, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে যেত। রাষ্ট্র থেকে টাকা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল রামায়ণ, ভগবত গীতা, পুরাণ অনুবাদ করার জন্য। সে সময়ের অন্যতম পণ্ডিত চণ্ডীদাস রাষ্ট্রের টাকায় প্রতিপালিত। এজন্য হোসেন শাহ ও গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের আমলে বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগ রচিত হয়েছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে ঘোষণা করে দিয়েছেন। চতুর্দশ শতাব্দীতে রাষ্ট্রের টাকায় যে বই বের হয়, তার নাম ইউসুফ-জুলেখা। ওই সময় বিভিন্ন সাহিত্যে দেব-দেবীর উপাখ্যান লেখা হতো। তৎকালীন মুসলিম সাহিত্যিকরা বাংলা ভাষায় লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদসহ বিভিন্ন প্রেম উপাখ্যান লিখেছেন, যা বাংলা ভাষার এক অনবদ্য সৃষ্টি হিসাবে মানুষ লুফে নিয়েছে। পরে মুসলিম সাহিত্যিকরা আলিফ-লায়লা ওয়ালায়লা, জিন, ডাইনি বুড়ি, জাদুঘরসহ অসংখ্য রূপকথার গল্প দিয়ে বাংলা সাহিত্যকে ভরে ফেলেছেন। সুস্বাদু হয়ে উঠল বাংলা সাহিত্য।
যুগান্তর সম্পাদক বলেন, মুসলিম সাহিত্যিকরা অনবদ্যভাবে রোমান্টিক প্রণয়ের পৃথিবী ও রূপকথাভিত্তিক সাহিত্য লিখেছেন। এর সঙ্গে ইসলামি বিপ্লবের চেতনা- এই তিনে মিলে ফররুখ আহমদের সাহিত্য বিনির্মাণ হয়েছে। তার সাহিত্য নজরুল, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মৃত্যুর পর তিনি সাত সাগরের মাঝি উপন্যাস লিখে জয় করে নিলেন। কবিকে চিনতে হলে, জানতে হলে তার সাহিত্য পাঠ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
