Logo
Logo
×

জাতীয়

আওয়ামী আমলে বেবিচকে নিয়োগে মানা হয়নি নিয়মনীতি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ১১:৫৭ এএম

আওয়ামী আমলে বেবিচকে নিয়োগে মানা হয়নি নিয়মনীতি

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষে চুক্তিভিক্তিক পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ। ছবি: সংগৃহীত

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষে (বেবিচক) সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চুক্তিভিক্তিক পরামর্শক নিয়োগে একের পর এক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এবার সেই অবৈধ নিয়োগে জড়িতদের চিহ্নিত করতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সংস্থাটি।

গত ৬ নভেম্বর বেবিচকের পরিচালক (অডিট) মোহাম্মদ নুরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী সময় পর্যন্ত পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের দায় নির্ধারণ করে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটি গঠনের পরপরই আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে বেবিচক।

এ বিষয়ে বেবিচকের এফএসআর সদস্য এয়ার কমোডর মুকিতুল আলম মিয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনার আলোকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি ২০১৮ সাল থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে পরামর্শক হিসাবে নিয়োগে ২০০৮ সালের পিপিআর অনুসরণ করা হয়েছিল কিনা তা যাচাই করবে। এফএসআর বিভাগকে সংশ্লিষ্ট সব নথি সরবরাহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্তের ফলাফলের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

অডিটের অজুহাতে চুক্তি বাড়ানো

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া অনেক অযোগ্য পরামর্শকের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও ‘অডিটের অজুহাতে’ তাদের মেয়াদ আবারও বাড়ানো হয়। যদিও আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশনের (আইকাও) কোনো অডিট তখন সামনে ছিল না। ২০২৬ সালের মার্চে অডিট হওয়ার কথা থাকলেও এখন শোনা যাচ্ছে তা ২০২৭ সালের শুরুতে হতে পারে।

তথ্য অনুযায়ী, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনা ও ২০০৬ সালের পিপিএ, ২০০৮ সালের পিপিআর উপেক্ষা করে ৪৬ জনকে বৈধতার চিঠি দেয় বেবিচক। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এই অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশও ছিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘জরুরি পরিস্থিতি’ দেখিয়ে চুক্তি নবায়ন শুধু নিয়মবহির্ভূতই নয়, বরং আন্তর্জাতিক অডিটের ক্ষেত্রেও ঝুঁকিপূর্ণ।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম যুগান্তরকে বলেন, ‘যেহেতু এসব পরামর্শকদের অনেকের নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ, তাই তাদের মাধ্যমে কোনো আন্তর্জাতিক অডিট মোকাবিলা করাও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হবে। আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশনের অডিট টিম চাইলে এসব নিয়োগের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারে। এতে বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ 

মন্ত্রিপরিষদের নির্দেশনা

অনুসন্ধানে জানা যায়, ৪৬ জন পরামর্শক ও বিশেষ কর্মকর্তার চুক্তি চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সরকারি ক্রয় আইন (পিপিএ ২০০৬) ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর ২০০৮) অনুসরণের নির্দেশনা থাকলেও তা উপেক্ষা করে পূর্বের শর্তেই এসব বৈধতার চিঠি জারি করা হয়।

৭ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পরামর্শকদের চুক্তি বৃদ্ধির মূল উদ্দেশ্য হলো আসন্ন আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অরগানাইজেশন (আইকাও) ও ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) অডিট মোকাবিলা করা।

বিধিমালা ১৯৯৬ এর ২৩(৪) নম্বর বিধি অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়। একই সঙ্গে নির্দেশ দেওয়া হয়—উক্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে বাস্তবায়ন অগ্রগতি প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে হবে।

বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘চুক্তি না বাড়ালে অডিট মোকাবিলা সম্ভব হবে না এমন অজুহাতে তারা চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে নেয়। আদতে এখন দেখতে পাচ্ছি কবে অডিট হবে, তার কোনো ঠিক নেই। তবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এসব পরামর্শকদের চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির নীতিগত অনুমোদনের ক্ষেত্রে শর্ত দিয়েছে—চুক্তি বৃদ্ধিতে পিপিএ, পিপিআর অনুযায়ী স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতাপূর্ণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। ২০১৮ সাল থেকে বিধি লঙ্ঘনের দায় নির্ধারণ করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বিনা বেতনে দায়িত্ব পালন

এর আগে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও এসব পরামর্শকরা বিনা বেতনে সাত মাসেরও বেশি সময় ধরে বেবিচকে বহাল তবিয়তে কাজ চালিয়ে যান। তারা বিমানের ইন্সপেকশন, পাইলটদের লাইসেন্স নবায়ন, চেক রাইড ও সার্টিফিকেশন অনুমোদন এবং মেডিকেল চেকআপের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছেন।

চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ নবায়নের জন্য বেবিচক বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায়। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যাওয়ার পর ১৮ ফেব্রুয়ারি চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ নবায়ন না করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনায় বলা হয়—সরকারি ক্রয় বিধিমালায় উল্লিখিত বুদ্ধিভিত্তিক ও পেশাগত সেবা ক্রয়ের বিধিবিধান অনুসরণ করে নিয়োগ প্রদানের পরামর্শসহ সারসংক্ষেপ ফেরত পাঠানো হলো। 

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এসব পদে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে ৫৪ জন পরামর্শকের চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বেবিচক সূত্র জানায়, অধিকাংশ পরামর্শক অযোগ্য, অভিজ্ঞতা নেই এবং রাজনৈতিক সংযোগের ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। তাদের পেছনে মাসে কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। বিশেষ পরিদর্শক (এভিয়েশন পাবলিক হেলথ), বিশেষ পরিদর্শক (অপারেশনস) ও বিশেষ পরিদর্শক (এসএমএস)-এর মাসিক বেতন ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা; বিশেষ পরিদর্শক (সিনিয়র ফ্লাইট অপারেশনস ইন্সপেক্টর-ফিক্সড উইং) পান ৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা; এ ছাড়া ১ লাখ ১৭ হাজার টাকা করে বেতন পান এভিয়েশন অ্যাটর্নি ও অন্যান্য বিশেষ পরিদর্শকরা। 

বেবিচকের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘এসব পদে চুক্তিভিক্তিক নিয়োগে কোনো ধরনের নিয়মনীতি মানা হয়নি। অযোগ্য, অদক্ষ এবং বিমান চলাচলে কোনো অভিজ্ঞতা নেই—এ রকম কনসালট্যান্টদের শুধু সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। এমনকি পার্মানেন্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয় না।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম