|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে বহুল প্রতীক্ষিত রায় ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সামনে কান্না, ক্ষোভ ও দীর্ঘদিনের যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে ওঠেন জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতরা ও নিহতদের স্বজনরা। তারা বলেন, ‘আমাদের রক্তের বিচার পেয়েছি’।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকাল থেকেই সারা দেশসহ রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শহীদ পরিবার এবং আহত বীরযোদ্ধারা ভিড় করতে থাকেন ট্রাইব্যুনাল এলাকায়। ব্যানার হাতে, চোখে অশ্রু আর মুখে স্লোগানে পুরো এলাকা পরিণত হয় শোক ও প্রতিশোধের দাবিতে উত্তাল মানবস্রোতে।
সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালের সামনে এসে দাঁড়ান শহীদ ঈসমাইল হোসেন রাব্বির বাবা মো. মিরাজ মিয়া। রায় শোনার মুহূর্তে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং ক্ষোভ, বেদনা ও শোকে উজ্জ্বল কণ্ঠে বলেন, ‘শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর না করলে আমাকে ১০০ গুলি করুন। আমার বুক ঝাঁজরা করে দিন। আমার ছেলে ছিল আমার আপন। হাসিনা তার পুলিশ–র্যাব বাহিনী দিয়ে গুলি করে আমার সন্তানকে হত্যা করেছে। হাসিনার একবার নয়, জনসম্মুখে তাকে কয়েক হাজারবার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা প্রয়োজন।’
মিরাজ মিয়া জানান, তার ছেলে ঈসমাইল হোসেন রাব্বি শরীয়তপুরের একটি কলেজে পড়তেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর তিনি ঢাকায় এসে আন্দোলনে যোগ দেন।
তিনি বলেন, ৪ আগস্ট আন্দোলন চলাকালে হাসিনার হানাদার বাহিনী—পুলিশ-র্যাব আমার ছেলের কপালে গুলি করে। কপাল দিয়ে ঢোকা বুলেট মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। মাথার মগজ বেরিয়ে পড়ে। তাকে শহীদ মিনারে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।
বিধ্বস্ত এই বাবা আরও বলেন, আমার ছেলেকে যেভাবে হত্যা করেছে, আমার কোল থেকে যেভাবে ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে, হাসিনাকে কয়েক হাজারবার ফাঁসি দিলেও তার শোধ হবে না।
তিনি জানান, তিনি ৩০০ টাকা খরচ করে একটি বড় ছুরি কিনেছেন। তার ভাষায়- ‘হাসিনাকে যদি সামনে থেকে দেখতে পাই, এ ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করব। আমাদের মতো শত শত বাবার কোল যেভাবে খালি করেছে, তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কুপিয়ে হত্যা করলেও প্রতিশোধ পূর্ণ হবে না।
এদিন ট্রাইব্যুনালের সামনে রায় শুনতে আসা আরও বেশ কয়েকজন শহীদ পরিবারের সদস্য ও আহত আন্দোলনকারীরাও রায়ের প্রতি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। তাদের দাবি, শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালসহ সকল জড়িত ব্যক্তিকে যেকোনো উপায়ে দেশে ফিরিয়ে এনে এ রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তাদের ভাষায়, ন্যায়বিচারের স্বার্থে দণ্ডপ্রাপ্তদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরই একমাত্র প্রত্যাশা।
ট্রাইব্যুনালের সামনে সকাল থেকেই হাজির ছিলেন জুলাই–আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত বীরযোদ্ধারা। উত্তরা থেকে আসেন মুস্তাঈন বিল্লাহ। তিনি ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিএনএস সেন্টারের সামনে পুলিশের গুলিতে পিঠে এবং যুবলীগ সভাপতির ছোড়া গুলিতে বাম হাতে আহত হয়েছিলেন। রায়ের পর পুরোনো স্মৃতি মনে করে আবেগ চেপে রাখতে পারেননি।
মুস্তাঈন বিল্লাহ বলেন, আমি ৯ মাস হাসপাতালে কাতরেছি। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বুলেট নিয়ে যে যন্ত্রণা সয়ে বেঁচে ছিলাম—তার একটাই উদ্দেশ্য ছিল হাসিনার ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখা। আমরা চাই—যেভাবে আমরা হাসপাতালে আহাজারি করেছি, স্বৈরাচার হাসিনাকে আজ ফাঁসির মঞ্চে তেমনই আহাজারি করতে হোক।
বিল্লাহ জানান, তার বাম হাতে এখনো এক ইঞ্চির একটি বুলেট রয়ে গেছে, এবং সেই জায়গায় তিনি কোনো অনুভূতি পান না। তবুও আদালতে উপস্থিত হওয়ার কারণ ছিল একটাই—‘সারা বাংলাদেশ তাকিয়ে আছে। এমন ক্ষমতাধর স্বৈরশাসকের বিচার দেখার মুহূর্ত বহুদিনের প্রতীক্ষা।’ তার দাবি, সরকার যেন দ্রুত শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করে।
একই ক্ষোভ ঝরে পড়ে আহত জুলাই যোদ্ধা মো. সালমান হোসেনের কণ্ঠেও। তিনি মেরুল বাড্ডায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হন। গুলি তার বা উরুর একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়, টুকরো টুকরো হয়ে যায় উরুর হাড়। নিজের সেই স্মৃতি মনে করে তিনি বলেন, ‘আমি তিন মাস হাসপাতালে কাতরিয়েছি। ব্যথায় ঘুমাতে পারিনি। আমাদের মতো হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যার পর স্বৈরশাসক হাসিনা আরাম-আয়েশে জীবন কাটাবে—এটা হতে পারে না।’
তারও দাবি একই—‘যেভাবেই হোক, হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের জড়িত নেতাকর্মীদের দেশে ফিরিয়ে এনে সর্বোচ্চ শাস্তি কার্যকর করতেই হবে।’
সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদ পরিবারের সদস্যরাও একই দাবি জানান। তাদের মতে, জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে যারা গুলি চালিয়েছে, যারা হত্যা করেছে, যারা নির্যাতন চালিয়েছে—তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, পুরো এলাকাজুড়ে ছিল প্রতীক্ষা, ক্ষোভ এবং শোকের এক মিলিত স্রোত। প্রতিটি মুখে–চোখে লেখা ছিল অপেক্ষা আর প্রতিশোধের আগুন। রায় ঘোষণার মুহূর্তে মানুষজনের ঠোঁটে উচ্চারিত হয় একটাই দাবি—‘স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীদের বিচার হোক, রায় কার্যকর হোক।’
ট্রাইব্যুনালের পরিবেশ আরও টানটান হয়ে ওঠে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে। তখন শহীদ পরিবারের সদস্যরা ট্রাইব্যুনালের মূল গেটে অবস্থান নেন এবং পরে ধাপে ধাপে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পান। কিছুক্ষণ পর তাদের সঙ্গে যোগ দেন জুলাই আন্দোলনে আহতরাও। তাদের মাঝে ছিলেন উত্তরা থেকে আসা আহত আব্দুর রহমান। তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচার হাসিনার সর্বোচ্চ শাস্তি ছাড়া আমরা কিছুই চাই না। রায় শুধু ঘোষণা হলেই হবে না—দ্রুতই ভারত থেকে এনে তা কার্যকর করতে হবে।’
টাঙ্গাইল থেকে আসা এক মোবাইল দোকানি জানান, তার আত্মীয় জুলাই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন।
ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, আমার ভাইদের বিচার চাইতে এসেছি। খুনি হাসিনা দেশটাকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। বিচারে গড়িমসি আমরা দেখতে চাই না। অবশ্যই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করতে হবে।
বিকাল ২টা ৫০ মিনিটে রায় ঘোষণার আগেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এলাকায় নেওয়া হয় নজিরবিহীন নিরাপত্তাব্যবস্থা। সুপ্রিম কোর্ট–ট্রাইব্যুনাল এলাকা থেকে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত সড়ক পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যানবাহন চলাচল বন্ধ, সাধারণ মানুষের চলাচল সীমিত। পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন, বিজিবি ও সেনাবাহিনী তৎপর ছিল প্রতিটি মোড়ে। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো।
এর আগে বেলা ১১টার পর ট্রাইব্যুনাল–১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আদালত রায় পড়া শুরু করেন। এরপর ২টা ৫০ মিনিটে রায়ের পরপরই পুরো এলাকায় ভারি নীরবতার পর উঠে আসে কান্না, স্লোগান আর প্রতিশোধের দাবি। শহীদ পরিবারের সদস্যরা বলেন, ‘আমাদের সন্তানদের রক্তের বিচার হয়েছে। যারা গুলি ছুড়েছে, যারা হত্যা করেছে, যারা নিপীড়ন চালিয়েছে—তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী শহীদ মিরাজের বাবা আব্দুর রব রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমার মিরাজ পতাকা বেঁধে মিছিলে বের হয়েছিল। সেদিনই তাকে মেরে ফেলল। আজ এই গণহত্যার হুকুমদাতাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় যেন শুনতে পাই—এই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।’
তিনি বলেন, ‘রায় হয়েছে মিরাজের কবরের কাছে গিয়ে বলব—বাবা, তোমাকে হত্যার বিচার হয়েছে। দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই, যাতে এই দেশে আর কখনো এভাবে সরকার মানুষ হত্যা করতে না পারে।’
রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের মুখে একটাই কথা ভেসে আসছিল—বিচারের পূর্ণ বাস্তবায়ন। স্বজনেরা বলছিলেন, ‘বিচার চাই, প্রতিশোধ চাই।’ আহতরা বলছিলেন, ‘আমাদের রক্তের দাম ফাঁসি ছাড়া কিছু হতে পারে না। আমাদের রক্তের বিচার পেয়েছি’ আর জনতার ঢেউ বলছিল—‘সংগ্রামের এই রক্তঋণ শোধের একটাই উপায়—রায় দ্রুত কার্যকর।’

