Logo
Logo
×

জাতীয়

শেখের বেটা’র আশীর্বাদেই লুঙ্গি সেলাই করা সলটু এখন শত কোটি টাকার মালিক

নেসারুল হক খোকন

নেসারুল হক খোকন

প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৫, ১১:৪৪ এএম

শেখের বেটা’র আশীর্বাদেই লুঙ্গি সেলাই করা সলটু এখন শত কোটি টাকার মালিক

শেখ সেলিমের ছেলে শেখ ফাহিম ও সুজিব রঞ্জন দাশ সলটু (বাঁ থেকে)। ছবি: সংগৃহীত

একসময় বাবার মুদির দোকানের পাশে লুঙ্গি সেলাই করে সংসার চালাতেন সুজিব রঞ্জন দাশ সলটু। কিন্তু সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের আশীর্বাদে এবং পরবর্তীতে শেখ সেলিমের ছেলে শেখ ফাহিমের সান্নিধ্যে তার ভাগ্যের পালে যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ লেগে যায়। পাঁচ বছরের মধ্যে তিনি কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে যান।

শুধু দেশেই নয়, কানাডার টরেন্টোতে শতকোটি টাকার চারটি বাড়ি এবং দুবাইতে ফ্ল্যাটসহ অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন সলটু। টরেন্টোতে তিনি এখন প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা জুয়া খেলেন। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে সলটুর এমন চাঞ্চল্যকর উত্থানের তথ্য উঠে এসেছে।

অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির নেপথ্যে শেখ ফাহিম

আরব্য উপন্যাসের আলাদিনের চেরাগের সঙ্গে তুলনা করে সংশ্লিষ্টরা সলটুর অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির গতিকে ব্যাখ্যা করেছেন। সলটুর ঘনিষ্ঠ একজন ব্যবসায়ী যুগান্তরকে জানান, তার অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার নেপথ্যে ছিলেন শেখ ফাহিম। ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত এফবিসিসিআই’র সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে শেখ ফাহিম কানাডায় মোটা অঙ্কের টাকা পাচার শুরু করেন এবং তার হস্তক্ষেপেই সুনামগঞ্জের মল্লিকপুরে সলটু একটি গ্যাস পাম্প (সিএনজি ফিলিং স্টেশন) চালু করেন।

এই গ্যাস পাম্প থেকে প্রতিদিন সিলিন্ডারে গ্যাস ভরে দেশের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে বিক্রি করা হতো এবং জালালাবাদ গ্যাস কোম্পানিতে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে কমপক্ষে পাঁচ বছর ধরে গ্যাস চুরির মাধ্যমে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ৫ আগস্টের পর এই গ্যাস পাম্প বন্ধ করে দেওয়া হলেও সম্প্রতি এটি আবার খুলে দেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে প্রাপ্ত নথিপত্র এবং কানাডার সরেজমিন অনুসন্ধানে সলটুর অস্বাভাবিক সম্পদের বিবরণ উঠে এসেছে। ২০১৯ সালে তার স্ত্রী শেলি দাসের নামে টরেন্টোর স্কারবোরো এলাকার পিত অ্যাভিনিউতে একটি বাড়ি কেনেন। প্রায় শতকোটি টাকা মূল্যের এই বাড়িটি কেনার ক্ষেত্রে ‘ইকুইটি ক্রেডিট ইউনিয়ন ইনক’ নামে একটি কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ ডলার বিক্রেতার অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়। এই কোম্পানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের কৌশল নেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

এছাড়া, সলটুর নিজের নামে টরেন্টোর স্কারবোরো এলাকার ১৩৮নং মেবোর্নে ১৭ লাখ ৫৫ হাজার ডলারে দ্বিতীয় একটি বাড়ি রেজিস্ট্রি করা হয়। এই বাড়ি কেনার ক্ষেত্রেও ‘কানাডা ইনক’ এবং ‘কুবার মর্গেজ ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন’ নামে দুটি কোম্পানির মাধ্যমে ডলার পরিশোধ দেখানো হয়। সলটু বর্তমানে টরেন্টোর মেবোর্নের ১৩৮নং হোল্ডিংয়ের ১৯০নং প্লটের ট্রিপলেক্স বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন। ৫ আগস্টের পর তিনি কানাডায় পালিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন।

২০১৭ সালে হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার ঘটনায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে মামলা করেছিল, তাতে সলটু ও তার বন্ধু জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি খায়রুল হুদা চপল ছিলেন অন্যতম আসামি। কিন্তু মূল এই দুই আসামির নাম তালিকা থেকে প্রত্যাহার করায় দুদকের তদন্ত প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর নেপথ্যে শেখ ফজলে ফাহিমের হাত ছিল বলে অভিযোগ উঠেছে। সলটুর বন্ধু খায়রুল হুদা চপলও শত শত কোটি টাকা এনে টরেন্টোতে বিলাসী জীবনযাপন করছেন এবং একাধিক বাড়ি কিনেছেন।

কানাডায় বসবাসরত বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এবং রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সলটুর মতো লুটেরাদের কারণে দেশের এই পরিস্থিতি হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

তারা বলেছেন, ১৫ বছরের ক্ষমতার প্রভাবে এসব ‘কুলাঙ্গার’ টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছে, অথচ দলে তাদের কোনো ভূমিকাই ছিল না।

নাটকীয় উত্থান ও ক্ষমতাশালীদের সাথে সলটুর সম্পর্ক

সুজিব রঞ্জন দাস সলটুর উত্থানের পেছনে এক নাটকীয় কাহিনি রয়েছে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রচারণার সময় তাকে মরহুম আবদুস সামাদ আজাদের জুতা পরিষ্কার করতে দেখা যায়। সামাদ আজাদের নির্দেশে সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল হুদা মুকুট তাকে ঠিকাদারি কাজে যুক্ত করেন। এরপর মুকুটের ছোট ভাই খায়রুল হুদা চপলের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। এই ‘মানিকজোড়’ আওয়ামী আমলের পুরো সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নির্বিঘ্নে টেন্ডারবাজি করেছে বলে অভিযোগ।

শেখ ফজলে ফাহিম এফবিসিসিআই’র সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর সলটু তার অলিখিত ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পান। শেখ ফাহিম তাকে গোপালগঞ্জের কোটায় দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র পরিচালকও করেন।

করোনার সময় সলটুর বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে শেখ ফজলে ফাহিমসহ যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ৩টি হেলিকপ্টার নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, যার জন্য সলটু ৫০ লাখ টাকা খরচ করে হেলিপ্যাড বানিয়েছিলেন। অভিযোগ আছে, এফবিসিসিআই’র পরিচালক নির্বাচনের দায়িত্বে থাকার সময় তিনি শেখ ফাহিমের হয়ে পরিচালক করতে এক থেকে দেড় কোটি টাকা পর্যন্ত নগদ গ্রহণ করেছেন।

সলটুর ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট এবং সিলেটের উত্তর বাগবাড়িতে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে। কানাডায় পালিয়ে যাওয়ার পর তার দামি একাধিক গাড়ি গোপন করে রাখা হয়েছে। শেখ ফাহিম পলাতক থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সলটুর মোবাইলে ফোন করা হলে তিনি লাইন কেটে দেন এবং খুদে বার্তারও কোনো উত্তর দেননি।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম