Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

অটোফিকশন আসার আগেই রোমানোর কলমে তার উপস্থিতি

Icon

মেজবাহ উদ্দিন

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অটোফিকশন আসার আগেই রোমানোর কলমে তার উপস্থিতি

সামাজিকতায় মোড়া মানুষ সবচেয়ে অযত্ন করে তার মনকেই। অর্থাৎ মানুষ আসলে তার নিজের মনের কাছেই সবচেয়ে বেশি অচেনা। ভেতরের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভয়-আকাঙ্ক্ষা কিংবা কামনার উজ্জ্বল রংগুলো সে চেপে রাখে দক্ষতায়, যেন নিজের হাতেই নিজেকে সমাধিস্থ করছে। একদিন যদি হঠাৎ সেই গোপন দরজা খুলে যায়-তখন গল্প আর বাস্তবের ফারাক মিলেমিশে একাকার হয়ে ওঠে। এ অশ্রুত, অধরা সত্তাকে খুঁজে পাওয়া মানেই জীবনের নতুন বয়ান আবিষ্কার করা-যেখানে নিখাদ ও নির্ভেজাল মানুষটির সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া যায়। প্রয়াত ইতালীয় লেখিকা লাল্লা রোমানো সেই মুখোমুখি হওয়ার শিল্পকেই রূপ দিয়েছেন তার সাহিত্যে। স্মৃতি ও স্বপ্ন, বাস্তব ও কল্পনার মিশ্রণে তিনি লিখেছেন নিজের ভেতরের সেই অশ্রুত মানুষকে।

১৯৬৪ সালে ইতালীয় লেখিকা লাল্লা রোমানো তার অনুরাগী পাঠক এবং প্রকাশনা সংস্থা আইনাউদির সম্পাদক ইতালো ক্যালভিনোর কাছ থেকে পান এক অসামান্য প্রশংসা। ক্যালভিনো তখনই বুঝেছিলেন-রোমানোর প্রতিটি রচনা আসলে এক ব্যক্তিগত কাহিনি কিংবা ইতালীয় শব্দ storia'i আরেক অর্থে, এক ব্যক্তিগত ইতিহাস। জীবনের অভিজ্ঞতা, সম্পর্ক ও স্মৃতির ভেতর দিয়েই তিনি লিখেছেন, আর এ লেখাই দাঁড়িয়েছে বিশ শতকের ইতালীয় সাহিত্যে এক অন্তরঙ্গ আত্মজীবনের শিল্পরূপ হিসাবে।

যুদ্ধোত্তর মিলানে ওপন্যাসিক হিসাবে আত্মপ্রকাশের আগে রোমানো ছিলেন প্রতিশ্রুতিশীল চিত্রশিল্পী। ১৯৪১ সালে বের হয় তার প্রথম কবিতার সংকলন, আর এক দশক পর প্রকাশিত হয় গদ্যের বই Le metamorfosi (দ্য মেটামরফোসিস)। এ গ্রন্থের স্বপ্নঘন, ভাঙাচোরা আখ্যান নব্য বাস্তববাদের স্রোত থেকে ভিন্ন, কিন্তু নাতালিয়া জিন্সবার্গ ও চেজারে পাভেজের মতো সাহিত্যিকরা এর অভিনবত্ব সঙ্গে সঙ্গেই চিনে নেন। জিন্সবার্গ লিখেছিলেন, রোমানোর স্বপ্ন ‘অসাধারণ, উর্বর ও প্রাণময়।’

যেমন করে তিনি চিত্রকলায় মানুষ ও প্রকৃতিকে রূপায়িত করতেন, তেমনি সাহিত্যে রোমানো ক্রমশ ফিরে যেতেন নিজের জীবনের কাছাকাছি মানুষ ও পরিসরগুলোতে-ভালোবাসা, সংঘাত কিংবা ট্র্যাজেডি দিয়ে গড়া সেই সময় ও স্থানগুলোতে। আলপাইন গ্রাম দেমন্তে-তে শৈশব কিংবা তুরিনে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতির পাশাপাশি, তার বহু গুরুত্বপূর্ণ রচনা আবর্তিত হয়েছে স্ত্রী, মা এমনকি দাদিমা হিসাবে জীবনযাপনের নিরাভরণ মুহূর্তগুলোকে ঘিরে। সেসময় ইতালীয় সাহিত্যে যা ছিল একেবারেই বিরল। অথচ রোমানো এগুলোকে সাহিত্যসম্মত উচ্চতায় তুলে ধরেছেন কাব্যিক সংবেদনশীলতা ও আবেগঘন সততার মাধ্যমে, এই বিশ্বাসে যে এগুলোও শিল্পসৃষ্টির যোগ্য বিষয়।

১৯৬৯ সালের Le parole tra noi leggere (আমাদের মধ্যে হালকা কিছু কথা) তে তিনি মাতৃত্ব নিয়ে নিজের সংশয়কে খোলামেলা ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। ছেলের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিগত দলিলপত্র প্রকাশ করে বিস্মিত করেছিলেন পাঠককে। বইটি পরে জেতে ইতালির মর্যাদাপূর্ণ স্ট্রেগা পুরস্কার, যদিও এতে তার ও ছেলের সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে। রোমানো তবু মনে করতেন-ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে শিল্পে রূপ দেওয়া তার কাছে অপরিহার্য, কারণ ‘লেখাই আমার বেঁচে থাকার পথ।’ তার মতে, সাহিত্যকে বাস্তব আর কল্পনার ফারাকে ভাগ করা অর্থহীন। In Farthest Seas-এর প্রসঙ্গে তিনি লিখেছিলেন- ‘আমি জীবিত অভিজ্ঞতাকে ভয় করি না। শিল্প হলো বিমূর্ততা।’ আবার অন্যত্র তার উক্তি-‘আমার কাছে স্মৃতিই হলো আবিষ্কার।’

এ ভাবনার পূর্ণতা আসে তার অনবদ্য সৃষ্টি In Farthest Seas (১৯৮৭)-এ, যেটিকে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই বলে মেনে গেছেন। গ্রন্থটি দুই ভাগে বিভক্ত-‘চার বছর’ ও ‘চার মাস’। প্রথম ভাগে ধরা আছে স্বামী ইনোচেন্ৎসো মন্তির সঙ্গে প্রেম ও বিবাহের প্রথম চার বছর; দ্বিতীয় ভাগে তার দ্রুত অবনমন ও মৃত্যু পর্যন্ত শেষ চার মাস।

রোমানো নিছক ঘটনা নয়, দৈনন্দিন ক্ষুদ্র মুহূর্তও ধরে রেখেছেন-আল্পস পর্বতের অভিযানে প্রথম দেখা, হ্রদতীরের হোটেলে প্রথম রাতের অস্বস্তি, ভুলে যাওয়া বিবাহবার্ষিকী কিংবা অফিসের বেদনাময় পদোন্নতি। আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ এসব মুহূর্তই তাদের দাম্পত্য জীবনের হৃদয়কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। ইনোচেন্ৎসোর চরিত্রে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন ‘এক অপরিবর্তনীয় নির্মলতা’। তবে তিনি কখনো স্বামীকে আদর্শায়িত করেননি। তার বয়ানে যেমন ব্যঙ্গ ও রসবোধ আছে, তেমনি নির্মম সততাও। মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি ভাবেন ‘প্রাণীর যন্ত্রণা’র কথা, আবার ফ্রান্সিস বেকনের চিত্রকলা মনে করে লিখে ফেলেন-‘নিষ্ঠুরতা ছাড়া করুণা নেই।’

আজকের সাহিত্যে ‘grief memoir’ বা শোককাহিনি একটি স্বীকৃত ধারায় পরিণত হয়েছে, কিন্তু রোমানো লিখেছিলেন বহু আগে-জোয়ান ডিডিওনের The Year of Magical Thinking- এরও অনেক আগে। তবু In Farthest Seas নিছক শোকের বই নয়; এটি প্রেম ও মৃত্যুর অন্তরঙ্গ যাত্রা, যেখানে শোক অনুভব করানো হয় নাম না নিয়েই।

এ বই অনুবাদের আসল চ্যালেঞ্জ নিহিত এর কাব্যিক সূক্ষ্মতায়। প্রতিটি শব্দ যেন যত্নে বাছা, আবেগমথিত অনুরণনে ভরা। রোমানো নিজেই বলেছিলেন: ‘লেখা মানে জীবনের ঘন বুনন থেকে একটি ছবি ছেঁকে নেওয়া, পৃথিবীর কোলাহল থেকে একটি সুর তুলে আনা, আর তাকে ঘিরে রাখা নীরবতায়।’ In Farthest Seas-এর পাতায় সেই নীরবতাই ছড়িয়ে আছে। ছোট ছোট অধ্যায়, পাতার সাদা ফাঁকা জায়গা, অল্প শব্দের ভেতর ছন্দ ও বিরতি-সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক সংগীতময় গতি। তার নিজের ভাষায়: ‘একটি উপন্যাসের জাদু জন্ম নেয় তার ছন্দ থেকে... রহস্য হওয়া চাই অস্পষ্ট, আবৃত, অথচ সত্য।’

বইটির রহস্যও তাই-প্রথমে দেহগত ও মানসিক আকর্ষণের, পরে প্রেমের, আর শেষে মৃত্যুর। স্বপ্ন ও স্মৃতির মিলনে এ বই এক অন্তরঙ্গ দাম্পত্যের ইতিহাস, আবার একইসঙ্গে এক সার্বজনীন মানবিক অভিজ্ঞতার রূপক। রোমানোর প্রথম গ্রন্থ থেকেই দেখা যায় এ প্রবণতা-বাস্তবতা ও কল্পনা, স্মৃতি ও স্বপ্নকে মিশিয়ে দেওয়া। তিনি বলেছিলেন : ‘স্মৃতি আমার কাছে কী?-তা হলো স্বপ্ন।’ In Farthest Seas-এর শেষভাগে স্বামীর জীবনকে তিনি বলেন ‘একটি সুন্দর স্বপ্ন।’ কিন্তু সেই স্বপ্নই হয়ে ওঠে তার প্রকৃত জীবন।

সবচেয়ে হৃদয়বিদারক উপলব্ধি তিনি ব্যক্ত করেন এভাবে : ‘যেগুলোকে আমি অন্য জীবন বলি, তাদের যা কিছু বাস্তবতম ছিল, সেগুলোও তার-বাইরে নয়, তার ছায়ায়। এভাবেই আমি আমার জীবনকে মাপব, যতদিন তা চলবে।’ রোমানোর সাহিত্য তাই শুধু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়; তার স্মৃতিগুলো পাঠকের জীবনেও প্রতিধ্বনিত হয়। এক অনির্বাচনীয় শিল্পকৌশলে তিনি আমাদের শিখিয়েছেন-ব্যক্তিগত ইতিহাসই হতে পারে সার্বজনীন শিল্প, আর প্রেম ও মৃত্যুর নীরব সুরই পারে সাহিত্যকে অনন্তের দিকে নিয়ে যেতে।

সূত্র : লিট হাব

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম