Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

হাসান হাফিজের জন্মদিনে শুভেচ্ছা

Icon

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

হাসান হাফিজের জন্মদিনে শুভেচ্ছা

হাসান হাফিজ একাধারে কবি ও সাংবাদিক; তার এ দুই সত্তার মধ্যে বিরোধ ছিল না। বরং গভীর ঐক্য রয়েছে। সাংবাদিক হিসাবে নিত্যদিন তাকে লিখতে হয়, লেখার আগে দেখতে হয়, বুঝতে হয়। সেই দেখার ও বোঝার খবর হাসান হাফিজ অনায়াসে নিয়ে আসেন তার কবিতায়। অন্যদিকে তার নিজের ভেতর রয়েছে যে কবির গুণ, অর্থাৎ সংবেদনশীলতা, কল্পনাশক্তি ও নান্দনিকতা, তা উপস্থিত থাকে তার সাংবাদিকতায়ও।

তার কবিতাগুলোয় দেখা ও জানার জগৎটি আমাদের অতিচেনা ও জানা। জীবন অভিজ্ঞতার প্রতিটি স্তরকে নতুন করে তুলে আনেন তার সৃজনশীল কাজের মধ্য দিয়ে। শিল্পীর সে কাজ তিনি চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেন, নান্দনিকভাবে। তার কবিতাগুলো সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে লিখিত, কিন্তু এখানে যে শিল্পী উপস্থিত, তিনি অতীত এবং ভবিষ্যতেরও। বর্তমানের বাস্তবতা তার কবিতায় বিশেষভাবে উদ্ভাসিত।

প্রতিটি কবিতার পেছনে প্রবল আবেগ আছে। সন্দেহ নেই কবি দুঃখে ভারাক্রান্ত। সেই দুঃখ তার ব্যক্তিগত নয়, আমাদের সবারই। বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করছে। এটা অবশ্য কোনো নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু এ শত্রুতা ক্রমেই দুঃসহ ও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ছে। ব্যবস্থাটিকে তিনি ধিক্কার দিচ্ছেন। ওই ধিক্কার আমাদেরও। কিন্তু তার ধ্বনি তার নিজস্ব। ঘৃণার পেছনে তার ভালোবাসা রয়েছে। ভালোবাসার কারণেই তার ঘৃণা অত্যন্ত গভীর। তার কবিতাগুলো স্বতঃস্ফূর্ত, সেটি বিশেষ গুণ।

তার অনেক কবিতায় ইংরেজি অনুবাদ যুক্ত করা হয়েছে। এ অনুবাদ অবাঙালি পাঠকের কাছে কবিতাগুলোকে পৌঁছে দেবে। বাঙালি পাঠকও অনুবাদের সঙ্গে মূল কবিতাকে মিলিয়ে পড়লে দ্বিতীয় পাঠের আনন্দ পাবেন।

হাসান হাফিজের কাব্যচর্চায় আমার শুভেচ্ছা আগেও ছিল, তার ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে তা জানানোর সুযোগ পেয়ে খুশি হলাম।

হাসান হাফিজের অনেক গুণ এবং তার সব গুণেরই আমি অনুরাগী। তবে তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি; আর ওই পরিচয়ের ভেতরই অন্য পরিচয়গুলো রয়ে গেছে এবং কাজ করছে। তার কবিতার জগৎটা আমাদের অপরিচিত নয়, কিন্তু সেই পরিচিতকে যখন তিনি কবিতায় নিয়ে আসেন, তখন মনে হয়, ওপর থেকে একটা আবরণ সরে গেছে, চেনা জিনিসকেই নতুন করে চিনতে পারছি। সেটি প্রসন্ন এক অভিজ্ঞতা। এ প্রসন্নতা তার সব কাজেরই বৈশিষ্ট্য।

বিরূপ এ বিশ্বে প্রসন্নতা খুব বিরল। বহু ঘটনা অনবরত ঘটছে, অধিকাংশই বিরক্তিকর; কিন্তু হাসান হাফিজকে মনে হয় কোনো কিছুই বিরক্ত করে না। হতাশও করে না। তিনি আশা রাখেন, তাই বলে যে উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েন, এমন নয়। তিনি প্রাণবন্ত এবং অনুত্তেজিত। এ ব্যাপারটা তার কবিতায় আছে, রয়েছে তার সব কাজে।

হাসান কথা বলতে ভালোবাসেন; কিন্তু তার কথকতায় সংযম থাকে, যাকে আমরা বাগ্বৈদগ্ধ্য বলি। বাগ্বৈদগ্ধ্য আসে ভেতরের কৌতুকবোধ ও বুদ্ধিমত্তা থেকে। আমরা টের পাই তিনি অনেক কিছু জানেন, অনেক বিষয়ে পড়েছেন, কিন্তু তার সে অধ্যয়ন যান্ত্রিক নয়, অনায়াসে সারবস্তু গ্রহণের। জ্ঞানকে তিনি অতি সহজে বহন করেন; বোঝা হিসাবে নয়, অর্জন হিসাবে। অন্যের কথা তিনি মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং অপেক্ষায় থাকেন নিজের কথাটা বলার জন্য। চাপিয়ে দেন না, জানিয়ে দেন। একটি উদার গণতান্ত্রিকতা যেমন তার লেখায়, তেমনি তার আলাপচারিতায় সক্রিয় থাকে। তাই তার কবিতা যেমন, তেমনি তার সাহচর্যও অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত থাকে।

তার কবিতা পেলেই আমি সঙ্গে সঙ্গে পড়ি, তার দেখা পেলে খুব খুশি হই। এ আমার একার নয়, তার সকল পাঠকের এবং যারা তার সান্নিধ্যের সুযোগপ্রাপ্ত তাদের সবারই সাধারণ অভিজ্ঞতা।

হাসান হাফিজ আমাদের অত্যন্ত আপনজন। তার কারণ তার সাহিত্যচর্চা। তিনি তার পাঠকের মন জয় করেছেন, এবং তাদের সঙ্গে থেকেছেন। নিজে সর্বক্ষণ সাহিত্যের সঙ্গে আছেন। সার্বক্ষণিক সাহিত্যিক, মনেপ্রাণে সাহিত্যিক বলতে যা বোঝায় তিনি তা-ই। অন্য অনেক কাজ করেছেন, আছেন সাংবাদিকতার জগতে, গুরুত্বপূর্ণ পদে, এবং সাংবাদিকদের মিলনক্ষেত্র জাতীয় প্রেস ক্লাসের সভাপতি পদেও যুক্ত আছেন; সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কর্তব্য পালনে। কিন্তু সাহিত্যই তার কাজের ও বসবাসের প্রধান ক্ষেত্র।

একজন কবি বলেই কল্পনায়, উদ্ভাবনায়, আবেগে, সৌন্দর্যচেতনায় এ কবিকেই আমরা তার সাহিত্যে সব সময় পাই। সাহিত্যের বাইরে হাসানের সব কাজের মধ্যেই কাব্যিক শৃঙ্খলা ও সৌন্দর্য দেখতে পাই।

সাহিত্য তাকে অনুক্ষণ দুটি কাজে ব্যস্ত রেখেছে। একটি হচ্ছে নিজের সাহিত্যকর্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া; অপরটি সাহিত্যের জন্য উপাদান ও জ্ঞান সংগ্রহ করা। সাহিত্যের কাব্যশাখায়ই তার কাজ; এবং যে কাজই করেছেন, অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে। আঙ্গিক নিয়ে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিরাম নেই। ভাষা ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন। চিন্তা করেন শব্দের অর্থ ও অনুষঙ্গ নিয়ে, ভাষার ব্যবহার নিয়ে; সে বিষয়ে পত্রিকায় লিখেছেন, বই প্রকাশ করেছেন। তার নিজস্ব সাহিত্যিক রীতিটি ক্রমাগত প্রসারিত ও সমৃদ্ধ। এমন সজাগ কবি আমরা কম পেয়েছি।

কিন্তু রীতিই যে সাহিত্য নয়, এ বোধের ব্যাপারেও তিনি অসাধারণ। তাই সাহিত্যের জন্য উপাদান সংগ্রহে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন। এখানেও তার কোনো আত্মতৃপ্তি নেই। উপাদান আসত জীবন থেকে, আসত গ্রন্থপাঠ থেকে। তার কাছে জীবন ও গ্রন্থপাঠ হচ্ছে পরস্পরের পরিপূরক। মানুষের সঙ্গে অবাধে মিশতে, এবং ক্লান্তিহীনভাবে বই পড়েন। ধ্রুপদি সাহিত্যের সঙ্গে তিনি হালের লেখাও পড়েন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে।

হাসানের অনেক গুণ, প্রধান গুণ দায়িত্বকে সহজভাবে নেওয়া এবং সহজে বহন করা। তার মূল কর্মক্ষেত্র দুটি-সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা। উভয় ক্ষেত্রেই তিনি অত্যন্ত সহজ এবং অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে কাজ করেছেন। তার সাফল্য ঈর্ষণীয়। সমসাময়িকদের অনেককেই তিনি ছাড়িয়ে, ছাপিয়ে উঠেছেন।

সাহিত্যের সঙ্গে সাংবাদিকতার বিরোধটা খুবই স্বাভাবিক। সাহিত্য স্থায়ী ও গভীর; সাংবাদিকতা তাৎক্ষণিক ও অগভীর। সাংবাদিক হিসাবে হাসানকে কাজ করতে হয়েছে তাৎক্ষণিকতার ভেতরেই, কিন্তু সেখানেও তিনি বিশিষ্ট, এবং খুবই সফল।

তার আছে সংবাদের তাৎপর্য বোঝার, গভীরে গিয়ে অনুসন্ধানের এবং সংবাদকে সাহিত্যিকভাবে উপস্থাপন করার দক্ষতা। এটা সব সাংবাদিকের থাকে না এবং না থাকলে কাজটা অনেক সময়ই যান্ত্রিক হয়ে পড়ে। হাসানের কাজ কখনোই যান্ত্রিক নয়। সব সময়ই প্রাণবন্ত। কারণ তার ভেতরে একজন কবি আছে। সাহিত্যক্ষেত্রে তার আরও কাজ আছে, কিন্তু মূলত তিনি একজন কবি।

তার কবিতায় কল্পনার সঙ্গে বক্তব্যের সজীব মিলন ঘটেছে। বক্তব্যের ক্ষেত্রে তার সামাজিক অঙ্গীকার মোটেই অস্পষ্ট নয়, কিন্তু সেই অঙ্গীকার কাব্যিক হয়ে উঠেছে কল্পনাশক্তির ব্যবহারে। সঙ্গে রয়েছে সংযম। শব্দকে ভালোবাসে, কিন্তু শব্দ তাকে মোহাচ্ছন্ন করতে পারে না।

সাংবাদিকতার চর্চা তার কবিতাকে দুর্বল করতে পারত, কিন্তু পারেনি; সাংবাদিকতাই বরং সমৃদ্ধ হয়েছে কবির হস্তক্ষেপে। হাসান হাফিজের আরেকটা গুণ কর্মস্পৃহা। আমি তাকে কখনো অলস হিসাবে দেখিনি। কাজের বাইরে তাকে ভাবা কঠিন। হাসান হাফিজের কর্মস্পৃহা, অনুসন্ধানমনস্কতা ও দায়িত্বপালনের দক্ষতা স্থায়ী হোক-তার ৭০তম জন্মবার্ষিকীতে এ কামনাটা বিশেষভাবে রইল।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম