Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

স্পেনের গৃহযুদ্ধে আহত অরওয়েল: মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

Icon

যুগান্তর ডেস্ক

প্রকাশ: ২৭ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

স্পেনের গৃহযুদ্ধে আহত অরওয়েল: মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী

ইটন কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর, এরিক আর্থার ব্লেয়ার (পরবর্তীকালের বিশ্ববিখ্যাত লেখক জর্জ অরওয়েল) পাঁচ বছর বার্মায় পুলিশ কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি চাকরিটা পছন্দ করতেন না। একজন পুলিশ হিসাবে এমন কিছু বিষয় তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, যা তাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার প্রতি হতাশ করে তোলে। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো তিনি বহু বছর পর ‘এ হ্যাঙ্গিং’ এবং ‘শুটিং অ্যান এলিফ্যান্ট’-এর মতো প্রবন্ধগুলোয় বর্ণনা করেন। এ ছাড়াও ‘বার্মিজ ডেইজ’ নামে তার প্রথম উপন্যাসে, সাম্রাজ্যবাদী বার্মার দুর্নীতি এবং কুসংস্কারের তিক্ত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়। ১৯২৭ সালে তিনি বার্মা ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পর ইম্পেরিয়াল পুলিশ থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। অরওয়েল তার জীবনের শেষের দিকে লিখেছেন, ‘খুব ছোটবেলা থেকেই, সম্ভবত পাঁচ বা ছয় বছর বয়সে, আমি জানতাম যে বড় হয়ে আমার একজন লেখক হওয়া উচিত,’।

১৯২৭ সালের মধ্যে তিনি লেখক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এমন একটি লক্ষ্য যার জন্য, তার জন্য যতটা সম্ভব অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করা প্রয়োজন যাতে লেখার জন্য কিছু থাকে। পরবর্তী বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

তিনি মাঝেমধ্যে বামপন্থি প্রকাশনাগুলোর জন্যেও লিখতেন। সেই সময়ে, ইউরোপের দরিদ্রদের মধ্যে তার বাস করার ফলে সৃষ্ট ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাকে সামাজিক ন্যায়বিচারের অনুভূতি দিলেও তিনি তখনও বুঝতে পারেননি যে কীভাবে তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে শব্দে প্রকাশ করবেন। লেখক হিসাবে তার পরিচয় ১৯৩৩ সালে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, যখন তিনি জর্জ অরওয়েল ছদ্মনাম গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। এর অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার প্রথম বই প্রকাশ করেন, যা ইউরোপে তার অভিজ্ঞতার একটি নন-ফিকশন বিবরণ। যার শিরোনাম ছিল ‘ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন’। এক বছর পর তার ‘বার্মিজ ডেইজ’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির পরতে পরতে দক্ষিণ এশিয়ার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমালোচনা। ১৯৩৬ সালের গোড়ার দিকে অরওয়েল উত্তর ইংল্যান্ডে কয়লা খনি শ্রমিকদের কর্মক্ষমতা এবং জীবনযাত্রার অবস্থা তদন্ত করার জন্য দুই মাসের অভিযানে বের হন। এই অভিযান তাকে অমূল বদলে দেয়। সেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে রচিত ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ার’ গ্রন্থে তিনি লেখেন, ‘আপনি সত্যিই সমাজতন্ত্রের পক্ষে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার আগে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, বর্তমানে পরিস্থিতি সহনীয় নাকি অসহনীয়’। তিনি এ বিশ্বাস নিয়ে উত্তর ইংল্যান্ড ত্যাগ করেন যে, পরিস্থিতি অবশ্যই সহনীয় নয়। সেখানে দরিদ্রতম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে অরওয়েল আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং নিশ্চিত হন যে, সমাজতন্ত্রই এ ধরনের বৈষম্য মোকাবিলার জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা হতে পারে। ১৯৩৭ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় তার রাজনৈতিক বিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি আসে। ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থানের পর, আক্রমণের মুখে পড়া বামপন্থি রিপাবলিকান সরকারের পক্ষে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে লড়াই করতে স্পেনে যান অরওয়েল। তিনি ছয় মাস স্পেনে ছিলেন। অরওয়েলকে ব্রিটিশ ইন্ডিপেনডেন্ট লেবার পার্টির তরফ থেকে একটি পরিচিতি পত্র দেওয়া হয়। সেই পত্র নিয়ে তিনি পার্টিডো ওব্রেরো ডি ইউনিফিকেশন মার্ক্সিস্তার (পাউম) মিলিশিয়া ব্যারাকে চলে যান। চরমপন্থি বামদলভিত্তিক এ সংগঠনটি, সংক্ষেপে পাউম নামে পরিচিত। সেখানে তাড়াহুড়ো না করেই তিনি ‘এরিক ব্লেয়ার মুদি দোকানদার’ হিসাবে স্বাক্ষর করেন। তিনি তখন একজন মুদি দোকানি এবং স্বাভাবিকভাবেই তার লেখায় তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন এমন নায়কদের সঙ্গে আরেকটি সাক্ষাতের, যাদের তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে পারেন ; ‘বার্সেলোনার লেনিন ব্যারাকে মিলিশিয়াতে যোগ দেওয়ার আগের দিন আমি একজন ইতালিয় মিলিশিয়াম্যানকে অফিসারদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। লালচে হলুদ চুল এবং শক্তিশালী কাধসমৃদ্ধ পঁচিশ বা ছাব্বিশ বছর বয়সী শক্ত গড়নের একজন যুবক। সে আমার দিকে পাশ ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার বুকের ওপর তার চিবুক, একজন অফিসারের টেবিলের ওপর খুলে রাখা ম্যাপের দিকে বিস্মিত ভ্রুকুটি নিয়ে তাকিয়ে ছিল। তার মুখাবয়বটি আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। তার ছিল এমন এক মুখশ্রী যে হত্যা করতে এবং বন্ধুর জন্য নিজ জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধাহীন। এমন এক মুখশ্রী যা শুধু একজন নৈরাজ্যবাদীর কাছেই আশা করা যায়। তার চেহারায় উদারতা এবং উগ্রতা দুই-ই ছিল’।

অরওয়েল স্পেনে ছয় মাস কাটিয়েছেন মূলত আরাগন ফ্রন্টে পাউম মিলিশিয়ার লেনিন ডিভিশনে। তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে মরতে প্রস্তুত ছিলেন এবং প্রয়োজনে তাদের জন্যও। কিন্তু সব কিছু তার পছন্দের ছিল না। সামরিক প্রশিক্ষণ অকেজো, আধুনিক অস্ত্র বিরল, ব্যারাকগুলো নোংরা এবং নিম্নমানের ছিল। সেটি কোনো মুক্ত সমাজ ছিল না, এমনকি আকর্ষণীয়ও নয় তবে প্রথম কয়েকদিনে অরওয়েল নিশ্চিত হন যে এটি তার পরিচিত সব চেয়ে সাম্যের এক সমাজ। ঠিক যেমন তিনি ইংরেজ খনি শ্রমিকদের ‘প্রকৃত শ্রমিক’ হিসাবে দেখতেন, তেমনি তিনি স্প্যানিশ মিলিশিয়াদের ‘প্রকৃত বিপ্লবী’ এবং ‘শ্রেণিহীন সমাজের ছোট একটি জগৎ’ হিসাবে দেখতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি মনে করতেন, সম্পূর্ণ সমতা অর্জিত হওয়ার দিনটি হয়তো খুব বেশি দূরে নয়। অহংকার, অর্থের লোভ, বসের ভয় ইত্যাদি বন্ধ হয়ে গেছে; শ্রেণিগত পক্ষপাত চলে গেছে। বন্ধুত্ব বাস্তবমুখী এবং অপ্রভাবিত ছিল। সর্বোপরি তিনি কাতালানদের ‘প্রয়োজনীয় শালীনতা, সরলতা এবং উদারতা’ দেখে মুগ্ধ হন। অন্য কথায়, তিনি ভেবেছেন, ‘দ্য রোড টু উইগান পিয়ার’-এর দ্বিতীয় অংশে তিনি যা খুঁজছিলেন তা তিনি খুঁজে পেয়েছেন; একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। স্প্যানিশ শ্রমিক শ্রেণির একই প্রবৃত্তি তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল, যা তিনি ইংল্যান্ডে পেয়েছিলেন। ইংরেজ খনি শ্রমিকদের নিজেদের মধ্যে একটি শ্রেণি ছিল। অন্যদিকে, স্প্যানিশ মিলিশিয়দের নিজেদের জন্য একটি শ্রেণি ছিল। কর্নেল, যাজক এবং জমিদারদের অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ স্পেন থেকে প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার মাধ্যমে তারা তখন শ্রমিক ও কৃষকদের জন্য উপযুক্ত একটি দেশ, লাল স্পেন প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত বলে মনে হয়েছে। বিপ্লবের ওপর অরওয়েলের প্রথম পাঠ এখানেই শুরু হয়েছিল; ‘ইংল্যান্ড থেকে সরাসরি এলে বার্সেলোনার চেহারাটা ছিল অবাক করার মতো এবং অভিভূত করার মতো। এই প্রথম আমি এমন কোনো শহরে গিয়েছিলাম যেখানে শ্রমিক শ্রেণির লোকই ছিল। প্রায় প্রতিটি আকারের ভবন শ্রমিকরা দখল করে নিয়েছিল এবং লাল পতাকা অথবা নৈরাজ্যবাদীদের লাল ও কালো পতাকা দিয়ে মোড়ানো ছিল। প্রতিটি দেওয়ালে হাতুড়ি ও কাস্তে এবং বিপ্লবী দলগুলোর আদ্যক্ষর লেখা ছিল; প্রতিটি গির্জা ধ্বংস করে দেওয়া হয় এবং সেগুলোর ছবি ও ম্যুরালগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তিগত মোটরগাড়ি ছিল না, সবই ছিল নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সব ট্রাম, ট্যাক্সি এবং অন্যান্য পরিবহণের বেশিরভাগ অংশ লাল এবং কালো রঙে রঙ করা ছিল। বিপ্লবী পোস্টারগুলো সর্বত্র পরিষ্কার লাল এবং নীল রঙে দেওয়ালে জ্বলজ্বল করছিল যার ফলে, অবশিষ্ট কতিপয় বিজ্ঞাপন কাদার মতো ধূসর রঙের দেখাচ্ছিল। লাউডস্পিকারগুলো সারা দিন এবং রাত পর্যন্ত বিপ্লবী গানের ধ্বনি বাজিয়ে চলেছিল। বাহ্যিকভাবে এটি এমন একটি শহর হয়ে উঠেছিল, যেখানে ধনী শ্রেণির অস্তিত্ব প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল’।

মে মাসের ৩ থেকে ৭ তারিখ পর্যন্ত বার্সেলোনায় পাউম এবং রিপাবলিকান বাহিনীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়, রিপাবলিকানরা ছিল কমিউনিস্ট নিয়ন্ত্রণে। অরওয়েল পাউম সদর দফতর পাহারা দিতে সাহায্য করেন। ইন্টারন্যাশনাল ব্রিগেডে যোগদানের ধারণা ত্যাগ করে ১০মে তিনি আরাগন ফ্রন্টে ফিরে যান। মে মাসের শেষের দিকে তিনি আবার বার্সেলোনায় ফেরেন। ২০ মে খুবই মর্মান্তিক একটি দিন, এদিনে একজন স্লাইপারের ছোড়া একটি বুলেট এসে অরওয়েলের গলায় বিদ্ধ হয়। উচ্চগতির ৭ মিমি-ক্যালিবারের গুলিটি অরওয়েলের শ্বাসনালি এবং ক্যারোটিড ধমনির মাঝখানের অংশকে ভেদ করে বেরিয়ে যায়। মুমূর্ষ অবস্থায় অরওয়েলকে মনফ্লোরাইতের ফিল্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তারপর সিয়েটামোতে স্থানান্তরিত করা হয়। তাকে মনফ্লোরাইতের ফিল্ড স্টেশন হাসপাতাল থেকে বার্সেলোনার একটি স্যানিটোরিয়ামে নিয়ে যেতে আট দিন সময় লাগে। অনেক ধকল কাটিয়ে সেখানে দুই সপ্তাহের সুস্থতার পর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি বেঁচে যান। তার কণ্ঠস্বর বিকৃত হয়ে যায়।

অরওয়েলের মতে, মিলিশিয়াদের যারা ১৯৩৭ সালের মে মাসে বার্সেলোনার রাস্তায় অস্ত্র সমর্পন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন তারাই ছিলেন বিপ্লবের স্পষ্ট সমর্থক বা রক্ষক। আর যারা তাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল তারাই ছিল বিপ্লবের স্পষ্ট শত্রু। তার কাছে এ বিষয়গুলো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, কারণ ভীষণ পশুস্বভাবের লোকরা এক ভিন্ন ধরনের অস্পষ্ট, ঘোলাটে এবং অনির্ণীত রাজনৈতিক ক্ষেত্রজুড়ে বিচরণ করছিল। কমিউনিস্ট সমর্থিত একটি সরকারের প্রতি বিপ্লবী পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে অরওয়েলের সশস্ত্র সহযোদ্ধারা কলঙ্ক মাথায় নিয়ে গ্রেফতার এবং কারারুদ্ধ হন। এরপর তাদের নেতাকে হত্যা করা হয়, তাদের অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং তাদের পার্টিকে ‘ট্রটস্কি-ফ্যাসিস্ট’ নামে অভিহিত করে অপবাদ দেওয়া হয়। এ সবের প্রতিক্রিয়ায় প্রবন্ধ এবং পর্যালোচনার আকস্মিক প্রবাহ হিসাবে অরওয়েল ব্রিটেনের মতাদর্শগত বামপন্থিদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করার মতো বলেন যে, ‘সত্যিই যা ঘটে চলেছে সেইসব না দেখার ভান করে বিপ্লবকে তারা মাঝপথে বিক্রি করে দিয়েছে’।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম