Logo
Logo
×

বাতায়ন

এআইভিত্তিক জলবায়ু সমাধানে চীন মডেল

সাইদুল ইসলাম

সাইদুল ইসলাম

প্রকাশ: ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:৫৬ এএম

এআইভিত্তিক জলবায়ু সমাধানে চীন মডেল

ছবি: সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তন আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক সংকট। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, হিমবাহ গলন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানব সভ্যতার জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে। এই সংকট মোকাবিলায় প্রযুক্তিগত সমাধান হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে চীন, যেটি এখন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর অর্থনীতি, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমনে একটি কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

১. প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় এআই : 

চীনে ভূমিকম্প, বন্যা, খরা এবং টাইফুনের মতো দুর্যোগ প্রায়ই ঘটে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে এআই নির্ভর মডেল দুর্যোগ পূর্বাভাস ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

এআই-ভিত্তিক স্যাটেলাইট বিশ্লেষণ: বাইডু ও হুয়াই-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ডিপ লার্নিং ব্যবহার করে রিয়েল-টাইম স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করছে, যা বন্যা ও ভূমিধসের সম্ভাবনা আগেভাগে শনাক্ত করতে সহায়তা করছে।

আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা : চীনের ন্যাশনাল ক্লাইমেট সেন্টার এখন AI ব্যবহার করে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের নির্ভুলতা ৩০–৪০% পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হয়েছে।

বিগ ডাটা একত্রিকরণ: বিভিন্ন সেন্সর ও আইওটি (IoT) ডিভাইস থেকে সংগৃহীত ডেটা এআই দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে স্থানীয় প্রশাসনকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে সাহায্য করছে।

২. কার্বন ফুটপ্রিন্ট বিশ্লেষণ ও নির্গমন নিয়ন্ত্রণ: 

চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হলেও, তাদের “Carbon Neutral 2060” লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে এআই একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক শক্তি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর কার্বন মনিটরিং : গুগলের মতোই চীনের আলীবাবা ক্লাউড একটি “Carbon Management Platform” তৈরি করেছে, যা শিল্প কারখানার নির্গমন তথ্য এআই দিয়ে বিশ্লেষণ করে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমানোর উপায় প্রস্তাব করে।

স্মার্ট উৎপাদন ব্যবস্থা : এআই ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে কারখানাগুলোতে শক্তি অপচয় হ্রাস এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে।

নগর কার্বন মানচিত্রায়ন : বেইজিং ও সাংহাই শহরে এআই-নির্ভর কার্বন ম্যাপিং টুল ব্যবহার করে শহরের কোন অংশে বেশি নির্গমন ঘটছে তা রিয়েল টাইমে দেখা যায়।

৩. নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবস্থাপনায় এআই : 

চীন বর্তমানে সৌর ও বায়ু শক্তি উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষে। তবে এই উৎসগুলোর অনিশ্চিত সরবরাহ (যেমন মেঘলা দিনে সৌরশক্তির ঘাটতি) ব্যবস্থাপনায় এআই বিপ্লব ঘটিয়েছে।

পূর্বাভাসভিত্তিক রক্ষণাবেক্ষণ : এআই-চালিত সিস্টেম টারবাইন বা সোলার প্যানেলের ত্রুটি আগেই শনাক্ত করতে পারে, যা উৎপাদন ক্ষতি কমায়।

স্মার্ট গ্রিডের অপটিমাইজেশন : চীনের State Grid Corporation এআই ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহের ভারসাম্য রক্ষা করছে, যাতে নবায়নযোগ্য উৎসের শক্তি সঠিকভাবে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়।

জ্বালানি পূর্বাভাস : এআই সিস্টেম আবহাওয়ার প্যাটার্ন বিশ্লেষণ করে কত সৌর বা বায়ু শক্তি উৎপাদন হবে তা পূর্বাভাস দিতে পারে, ফলে শক্তি পরিকল্পনা আরও নির্ভুল হয়।

৪. জলবায়ু নীতি নির্ধারণে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ

এআই শুধু প্রযুক্তিগত নয়, নীতিনির্ধারণ পর্যায়েও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

নীতি সিমুলেশন মডেল : চীনা নীতি-গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো AI ব্যবহার করে বিভিন্ন জলবায়ু নীতির ফলাফল আগে থেকেই সিমুলেট করছে। যেমন- কোন সেক্টরে কার্বন ট্যাক্স বাড়ালে কতটা নির্গমন কমবে।

তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ : সরকার এআই দিয়ে বিশ্লেষণ করছে কোন অঞ্চলে সবুজ বিনিয়োগ (green investment) বেশি কার্যকর হবে।

জলবায়ু অর্থায়ন পর্যবেক্ষণ : চীনের সেন্ট্রাল ব্যাংক (PBOC) এআই ব্যবহার করে “green bonds” এবং “climate finance” প্রকল্পগুলোর কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করছে।

৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রযুক্তি কূটনীতি: 

চীন এখন এআই-চালিত জলবায়ু সমাধানকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে আনছে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড সবুজ উদ্যোগ : চীন উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এআই-ভিত্তিক জলবায়ু ডেটা বিশ্লেষণ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিচ্ছে।

জাতিসংঘ জলবায়ু অংশীদারিত্ব : চীন জাতিসংঘের “AI for Earth” এবং “AI for Climate Action” প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে ডেটা ও প্রযুক্তি শেয়ার করছে।

গ্লোবাল সাউথ সহায়তা : আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এআই-ভিত্তিক দুর্যোগ পূর্বাভাস প্রকল্পে চীন বিনিয়োগ করছে, যা একটি নতুন ধরণের “climate diplomacy” গড়ে তুলছে।

৬. চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা: 

যদিও চীন এআই ব্যবহার করে জলবায়ু মোকাবিলায় অগ্রগতি অর্জন করেছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

-- ডেটা স্বচ্ছতা ও আন্তঃদেশীয় তথ্য শেয়ারিং সীমিত।

-- এনার্জি-ইনটেনসিভ এআই মডেলের নিজস্ব কার্বন প্রভাবও বিবেচনা করা প্রয়োজন।

-- গ্রামীণ অঞ্চলে প্রযুক্তিগত অবকাঠামো এখনো পর্যাপ্ত নয়।

তবে ২০৩০ সালের মধ্যে চীন এআই-চালিত জলবায়ু অভিযোজনকে জাতীয় কৌশল হিসেবে গ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যেখানে মানবপ্রযুক্তি সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি “Green Intelligence Ecosystem” গড়ে উঠবে।

চীনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু প্রযুক্তির বিষয় নয়, এটি ভবিষ্যতের জলবায়ু নীতি, অর্থনীতি ও মানব নিরাপত্তার মূল চালিকাশক্তি হতে পারে। দুর্যোগ পূর্বাভাস থেকে শুরু করে শক্তি ব্যবস্থাপনা ও নীতি নির্ধারণ, সবখানেই এআই জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করছে।

চীনের এই অগ্রগতি অন্য দেশগুলোর জন্য এক অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত, যেখানে মানব মেধা, প্রযুক্তি ও পরিবেশ সচেতনতা একসাথে কাজ করে টেকসই ভবিষ্যতের পথ দেখাচ্ছে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম