Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে বিপুল সম্ভাবনা

Icon

ডা. মো. রফিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে বিপুল সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশে শিল্প খাতের অবদান দিন দিন বাড়ছে। বিশেষত, ওষুধশিল্প বর্তমানে দেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় ও কৌশলগত শিল্প খাত হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। বর্তমানে দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা দেশীয়ভাবে মেটানো হয় এবং বাংলাদেশ শতাধিক দেশে ওষুধ রফতানি করছে-যা এক বিশাল সাফল্য। এখন সময় এসেছে এ অর্জনকে আরও বিস্তৃত করার, বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানোর এবং কাঁচামালের আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় এপিআই উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করার।

সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট

১৯৮২ সালের ওষুধনীতি ছিল এ খাতের যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এ নীতির ফলে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য কমে আসে এবং দেশীয় কোম্পানিগুলো শক্ত অবস্থান নিতে শুরু করে। এ খাত অভ্যন্তরীণ বাজারে ২.৭৪ বিলিয়ন ডলারের চাহিদা পূরণ করছে এবং জিডিপিতে অবদান রাখছে ১.৮ শতাংশ। ২০১৪-২০১৯ পর্যন্ত এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১৬.৭ শতাংশ, যা বাংলাদেশের শিল্পায়নের ইতিহাসে বিরল সাফল্য।

রফতানির সম্ভাবনা

বাংলাদেশ বর্তমানে শ্রীলংকা, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটেন, কানাডা, ফিলিপাইনসহ শতাধিক দেশে ওষুধ রফতানি করছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ওষুধ রফতানি আয় দাঁড়ায় ১২৯.৯৫ মিলিয়ন ডলার, যেখানে ২০১৪-১৫ সালে ছিল মাত্র ৭২.৬৪ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৫.৬ শতাংশ।

রফতানি বাড়ানোর বাস্তব কৌশল

বাংলাদেশের ওষুধ ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ, যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা টিজিএ’র স্বীকৃতি পেয়েছে। এ সাফল্যকে আরও বিস্তৃত করতে বায়োসিমিলার, ভ্যাকসিন, অ্যান্টিক্যানসার, হরমোনাল ওষুধ ও ইনজেকশনভিত্তিক পণ্য বাড়াতে হবে। লাইওফিলাইজড ইনজেকশন, ড্রাই-পাউডার ইনহেলার, প্রি-ফিল্ড সিরিঞ্জ, বায়োলজিক ওষুধ যোগ করলে বাজার সম্প্রসারণ সম্ভব।

বাংলাদেশের উচিত এখন শুধু জেনেরিক নয়, নতুন ওষুধ উদ্ভাবনে প্রবেশ করা। এর মাধ্যমে বৈশ্বিক ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলারের বাজারে প্রবেশ করা সম্ভব হবে। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় ওষুধ উদ্ভাবন তহবিল, বিশ্ববিদ্যালয়-শিল্প খাত অংশীদারত্ব, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নেটওয়ার্ক গঠন।

এপিআই খাতের উন্নয়ন

বাংলাদেশে ওষুধের ৯৫ শতাংশ দেশেই উৎপাদিত হলেও প্রায় ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। ২০০৮ সালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়ায় ২০০ একর জমিতে ‘এপিআই শিল্পপার্ক’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও ১৭ বছর পরও অগ্রগতি খুবই সীমিত; বরাদ্দ ৪২ প্লটের মধ্যে মাত্র ২টি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। বাকিগুলো অবকাঠামোগত সমস্যা, গ্যাস-বিদ্যুৎ ঘাটতি ও ছাড়পত্র জটিলতায় স্থবির। বর্তমানে ৪০টির বেশি এপিআই দেশেই তৈরি হলেও তা মোট চাহিদার প্রায় ১০ শতাংশ।

মূলত চীন ও ভারত থেকে এপিআই আমদানি করা হয়, ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। দেশে মাত্র ২৬টি এপিআই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা মোট চাহিদার অল্প অংশ মেটাতে পারে।

টিআরআইপিএস (ট্রিপস) অব্যাহতির সুযোগ কাজে লাগানো

বাংলাদেশ ২০৩২ সাল পর্যন্ত পেটেন্ট অব্যাহতি পেয়েছে। এ সময়ের মধ্যেই জেনেরিক ওষুধের পাশাপাশি কাঁচামাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে, যাতে পরবর্তী সময়ে বিদেশি রয়্যালটি দিতে না হয়।

বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের শক্তির দিকগুলো হলো এর দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও মেধাবী জনবল-বিশেষ করে ফার্মাসিস্ট ও টেকনিক্যাল বিশেষজ্ঞরা, যারা আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে উৎপাদন পরিচালনা করছেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি, তুলনামূলকভাবে কম শ্রম ব্যয়, সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা, শক্তিশালী অবকাঠামো এবং উচ্চমানের উৎপাদন সক্ষমতা এ খাতকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করে তুলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ট্রিপস চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের ২০৩২ সাল পর্যন্ত পেটেন্ট অব্যাহতি পাওয়া, যা দেশীয় জেনেরিক ওষুধ উৎপাদন ও রফতানির জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ।

তবে এ শিল্পের কিছু দুর্বলতা এখনো রয়েছে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো কাঁচামালের ওপর অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা-বিশেষ করে চীন ও ভারত থেকে এপিআই আমদানি। এর ফলে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়, উৎপাদন খরচ বাড়ে। মূলধনের অপ্রতুলতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতে এলসি খোলার জটিলতা এবং কর ও আমদানিনীতির আমলাতান্ত্রিক জটিলতা শিল্পের প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে। এসব সমস্যা সমাধানে সরকারি নীতি সংস্কার ও অবকাঠামোগত সহায়তা জরুরি।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের সামনে রয়েছে অসংখ্য সুযোগ। বিশ্বজুড়ে সাশ্রয়ী জেনেরিক ওষুধের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। বাংলাদেশ এ বাজারে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের ওষুধ সহজেই বাজার দখল করতে সক্ষম হবে। তা ছাড়া শ্রম ব্যয় চীন ও ভারতের তুলনায় ৪-৫ গুণ কম হওয়ায়, বাংলাদেশ উৎপাদনে আরও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান তৈরি করতে পারে। সরকার গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বাড়ালে দেশীয় কোম্পানিগুলো নতুন অণু উদ্ভাবন, বায়োসিমিলার, অ্যান্টিক্যানসার ওষুধ এবং জটিল বায়োলজিক পণ্য তৈরি করতে পারবে-যা বৈদেশিক বাজারে আরও শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করবে।

সার্বিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের ওষুধশিল্প শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তবে টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য এখনই প্রয়োজন-কাঁচামালে স্বনির্ভরতা অর্জন, গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা ধরে রাখার জন্য সময়োপযোগী নীতিগত সহায়তা। যদি এ পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়িত হয়, তবে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প শুধু জাতীয় অর্থনীতির মূল স্তম্ভ নয়, বরং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য খাতেরও এক গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠবে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও লক্ষ্য

বর্তমানে বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের বাজারের আকার ৩৩,২০০ কোটি টাকা। ২০২৫ সালের মধ্যে রফতানি আয় ৬ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৭ সালের মধ্যে ৬.৬৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর লক্ষ্য বাস্তবসম্মত। যদি বাংলাদেশ বৈশ্বিক জেনেরিক বাজারের মাত্র ১ শতাংশ অংশীদার হয়, তাহলে বার্ষিক রফতানি আয় ৪ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। আর ১০ শতাংশ বাজার দখলে আয় হবে ৪০ বিলিয়ন ডলার। ফলে, ওষুধশিল্পই হতে পারে পোশাক খাতের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের উৎস।

এখনই সময় ওষুধ রফতানির বৈদেশিক সাফল্যকে অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তি-উৎপাদন সক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত করার।

বাংলাদেশকে এখন তিনটি লক্ষ্যকে একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে : ১. রফতানি বাজার সম্প্রসারণ; ২. দেশীয় কাঁচামাল উৎপাদনে স্বনির্ভরতা; ৩ গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি। এই ত্রিমাত্রিক কৌশলই ওষুধশিল্পকে বাংলাদেশের ‘পরবর্তী রফতানি বিপ্লবে’র কেন্দ্রে নিয়ে যাবে।

ডা. মো. রফিকুল ইসলাম : স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল, সহযোগী অধ্যাপক, ইউরোলজি বিভাগ, বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম