Logo
Logo
×

বাতায়ন

জাতীয় কৃষি দিবস ২০২৫: টেকসই কৃষির পথে নতুন দিগন্ত

Icon

গোলাম মর্তুজা সেলিম

প্রকাশ: ১৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:১২ পিএম

জাতীয় কৃষি দিবস ২০২৫: টেকসই কৃষির পথে নতুন দিগন্ত

বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক ও উর্বর মাটির দেশ, যেখানে কৃষিই জাতীয় জীবনের মূল চালিকাশক্তি। আমাদের সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই কৃষি কেবল খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যম নয়; এটি ছিল সংস্কৃতি, অর্থনীতি, আত্মপরিচয় ও স্বাধীনতার ভিত্তি। এদেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে কৃষকের ঘাম, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের গল্প লুকিয়ে আছে। হাজার বছরের এই কৃষিভিত্তিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৮ সালে পহেলা অগ্রহায়ণ-নবান্ন উৎসবের দিনটিকে ‘জাতীয় কৃষি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 

বাংলার হেমন্তকাল মানেই ধান কাটা, নতুন চালের পিঠা-পায়েস আর কৃষকের মুখে হাসি। কৃষি দিবস সেই শিকড়ের প্রতীক, যা আমাদের কৃষ্টি, উৎসব ও জীবিকার কেন্দ্রবিন্দুকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই দিনটি এখন বাংলার কৃষি ও কৃষকের প্রতি শ্রদ্ধা, অর্জন এবং অঙ্গীকারের প্রতীক। পাশাপাশি, কৃষির অগ্রযাত্রা পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নির্ধারণের এটি এক জাতীয় প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়েছে।

প্রাচীন বাংলায় কৃষি ছিল জীবনযাত্রার কেন্দ্রবিন্দু। নদীর পলিমাটি ও প্রাকৃতিক উর্বরতা এই ভূমিকে কৃষিকাজের জন্য উপযুক্ত করেছিল। মোগল আমল পর্যন্ত কৃষি উৎপাদন ছিল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। ব্রিটিশ আমলে জমিদারি প্রথা কৃষিকে করেছিল শোষণের শিকার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ ছিল কৃষিতে বিপর্যস্ত-ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ ও উৎপাদনহীনতার কঠিন বাস্তবতায় জর্জরিত। ‘কৃষিই হবে উন্নয়নের ভিত্তি’ এই দর্শনে সরকার কৃষি পুনর্গঠনের নীতি গ্রহণ করে। কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএআরআই), বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিআরআরআই) এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহ। এই সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টার ফলেই ১৯৮০-এর দশক থেকে ধান, গম ও সবজি উৎপাদনে বিপ্লব দেখা দেয়। আজ বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশ। ধান, সবজি, মাছ-মাংস ও দুগ্ধ উৎপাদনে আমরা বিশ্বে অগ্রগণ্য। এই রূপান্তরের পেছনে রয়েছে কোটি কৃষকের পরিশ্রম, কৃষি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন, এবং কৃষি নীতি ও নেতৃত্বের সুপরিকল্পিত দিকনির্দেশনা। বাংলাদেশের কৃষি এখন কেবল চাষাবাদ নয়-এটি জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর একটি সমন্বিত ক্ষেত্র।

অতীতের কৃষি ছিল পরিশ্রমনির্ভর; বর্তমান কৃষি হচ্ছে জ্ঞাননির্ভর। আজকের কৃষি শুধু জমি চাষ নয়- এটি এখন একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। কৃষি গবেষণাগারে উদ্ভাবিত হচ্ছে উচ্চফলনশীল বীজ, জলবায়ু সহনশীল জাত, জৈব সার প্রযুক্তি, এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনা। কৃষি এখন ‘প্রডাকশন’ থেকে ‘সাস্টেইনেবল প্রডাকশন’–এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেখানে পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা হচ্ছে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তার মেরুদণ্ড হলো ধান। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১২০টিরও বেশি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করেছে, যার মধ্যে লবণাক্ততা, খরা ও বন্যা সহনশীল জাতগুলি উপকূলীয় অঞ্চলে ধানচাষের মাধ্যমে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। এই উদ্ভাবনই বাংলাদেশকে ‘Rice self-sufficient nation’ বানিয়েছে। সবজি ও ফলের উন্নত জাতের জনপ্রিয়তা বাড়ায় সেগুলো এখন রপ্তানিযোগ্য পণ্যে পরিণত হয়েছে। শ্রম থেকে প্রযুক্তির রূপান্তরে যান্ত্রিকীকরণ বাংলাদেশের কৃষিতে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে। এখন প্রায় ৯০% জমিতে ট্রাক্টর বা পাওয়ার টিলার ব্যবহৃত হচ্ছে এবং ধান কাটা, মাড়াই ও শুকানোর জন্য কম্বাইন্ড হারভেস্টার ও রিপার মেশিন ব্যবহৃত হচ্ছে। এতে কৃষকের সময় ও শ্রম বাঁচছে এবং উৎপাদন ব্যয় কমছে।

বাংলাদেশের কৃষিতে এখন তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। কৃষকরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ফসলের রোগ নির্ণয়, বাজারদর, আবহাওয়া তথ্য ও সরকারি সহায়তা পাচ্ছেন। ড্রোন ইমেজিং, স্যাটেলাইট মনিটরিং ও রিমোট সেন্সিং ডেটা ব্যবহার করে জমির স্বাস্থ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। স্মার্ট কৃষি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) অর্থাৎ কৃষি ৪.০ বা ‘Smart Agriculture’-এর যুগে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। এআই ও আইওটি (Internet of Things) প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের রোগ শনাক্তকরণ, সার ও পানির সঠিক পরিমাণ নির্ধারণ এবং বাজার চাহিদা বিশ্লেষণ সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি এখন আর শুধু পুরুষের নয়—নারীর হাতও সমানভাবে এর অগ্রযাত্রায় যুক্ত। তারা বীজ বপন, রোপণ, ফসল সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। নতুন প্রজন্মের তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘স্মার্ট এগ্রিপ্রেনারশিপ’ শুরু করছে। ই-কমার্স ভিত্তিক কৃষিপণ্য বিক্রয় প্ল্যাটফর্ম, হাইড্রোপনিক ফার্মিং ইত্যাদি কৃষিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ গড়ে তুলেছে ‘Climate Smart Agriculture (CSA)’ মডেল। এই মডেলে উৎপাদন বৃদ্ধি, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং কৃষকের সহনশীলতা বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে এখন চাষ হচ্ছে লবণাক্ততা সহনশীল ধান, বন্যাপ্রবণ এলাকায় ফ্লোটিং গার্ডেন (ভাসমান কৃষি), শুকনো এলাকায় ড্রিপ সেচ ও সোলার কৃষি। বাংলাদেশের এই জলবায়ু সহনশীল কৃষি মডেল আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জমি ক্রমশ কমছে, উৎপাদন খরচ বাড়ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের কৃষিজমির প্রায় ৩০% জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়বে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তাই টেকসই কৃষি কৌশলই একমাত্র সমাধান।

কৃষি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তার ভিত্তি হলেও, এর প্রাণপুরুষ সেই কৃষক আজও সমাজে সবচেয়ে অবহেলিত। বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪০% কৃষির সঙ্গে যুক্ত, অথচ কৃষির মোট জিডিপি অবদান মাত্র ১৩–১৪%। এর মানে দাঁড়ায়, কৃষকের পরিশ্রমের প্রকৃত আর্থিক মূল্য সমাজে প্রতিফলিত হচ্ছে না। কৃষক ন্যায্যমূল্য পান না। এই বৈষম্যই কৃষক জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। কৃষিপণ্যের বিপণন ব্যবস্থা এখনও মধ্যস্বত্বভোগী নির্ভর। কৃষক থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে একাধিক ধাপ পার হয়, যেখানে কৃষক সর্বনিম্ন অংশ পান। কৃষি পণ্যের সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে ঘাটতি থাকায় প্রতি বছর প্রায় ২৫–৩০% কৃষিপণ্য নষ্ট হয়ে যায়। যদি কার্যকর কৃষি বীমা ব্যবস্থা চালু করা যায়, তাহলে কৃষকেরা উৎপাদনে ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন। নারী কৃষকের অবদানও প্রায়ই অদৃশ্য থেকে যায়। এখন সময় এসেছে নারী কৃষকদের স্বীকৃতি ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ার।

বাংলাদেশের কৃষি এখন অতীতের পরিশ্রমনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। ‘আগে কৃষি ছিল বেঁচে থাকার উপায়, এখন কৃষি উন্নয়নের হাতিয়ার।’ কৃষির ভবিষ্যৎ এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। প্রিসিশন ফার্মিং, স্মার্ট গ্রিনহাউস, ড্রোন ডেলিভারি সিস্টেম, বায়োইনফরমেটিক্স এবং এআই ভিত্তিক কৃষি নীতি নির্ধারণ-এই ধারণাগুলো আগামী দিনের কৃষিকে পুনর্গঠন করবে। বিশ্ব কৃষি বাজারে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হলে এই প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি বিপ্লবকে আরও বিস্তৃত করতে হবে। পাশাপাশি, কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ‘কৃষক-থেকে-ভোক্তা’ সরাসরি বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। কৃষিই কৃষ্টি, কৃষিই সমৃদ্ধি। বাংলাদেশের কৃষি আজ ঐতিহ্য, বিজ্ঞান ও উদ্ভাবনের সম্মিলন। কৃষকদের পরিশ্রমেই দেশ এগিয়েছে খাদ্যে স্বনির্ভরতা ও অর্থনৈতিক উন্নতির পথে। তাদের সম্মান, নিরাপত্তা ও মর্যাদা রক্ষাই হতে হবে আমাদের জাতীয় অঙ্গীকার। একটি টেকসই, প্রযুক্তিনির্ভর ও কৃষকবান্ধব কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হোক ২০২৫ সালের জাতীয় কৃষি দিবসের মূল অঙ্গীকার।

লেখক: কৃষিবিদ ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম