রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ: সম্পর্ক, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়
প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৫, ১০:১৩ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল এমন একটি নির্বাচন, যেখানে জনগণ তাদের ইচ্ছা, মতামত ও প্রত্যাশাকে ভোটের মাধ্যমে প্রতিফলিত করতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কেবল ভোট প্রদান নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও সামাজিক প্রক্রিয়া- যা নির্বাচন কমিশন, রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, গণমাধ্যম, নাগরিক সমাজ এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সমন্বয়ে পরিচালিত হয়। এই সমন্বয়ের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি পক্ষ হলো রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা। একদিকে রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সক্রিয় প্রতিদ্বন্দ্বী, অন্যদিকে পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের মান, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা মূল্যায়নের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। ফলে এই দুই পক্ষের সম্পর্ক কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিষয় নয় বরং গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও আস্থার ভিত্তি।
বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী এমন বহু নির্বাচন দেখা গেছে, যেখানে নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং সরকারের বৈধতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একইভাবে এমন উদাহরণও আছে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর সন্দেহ, মেরুকরণ ও অবিশ্বাস নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার সম্পর্ক আজকের গণতান্ত্রিক বাস্তবতায় নতুনভাবে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
১. নির্বাচন পর্যবেক্ষণ: একটি কাঠামোগত ও বৈশ্বিক প্রক্রিয়া
নির্বাচন পর্যবেক্ষণ আজ শুধু একটি ‘ইভেন্ট-ভিত্তিক’ কার্যক্রম নয়, বরং আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ডের অংশ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কার্টার সেন্টার, ওএসসিই এবং বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলিক সংস্থা বহু বছর ধরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিকে উন্নত করে চলেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও কয়েকটি বড় নির্বাচন আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষিত হয়েছে, যা আমাদের নির্বাচনি প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম সূচক।
পর্যবেক্ষণের মূল কাজ তিনটি- স্বচ্ছতা মূল্যায়ন, আচরণবিধি পরীক্ষা এবং জবাবদিহিতার ওপর সুপারিশ প্রদান। পর্যবেক্ষকেরা দেখেন, বিদ্বেষমূলক বক্তব্য, সহিংসতা, প্রশাসনিক চাপ, কারচুপি, ভোট কেন্দ্র দখল, ভোটার হয়রানি, মিডিয়া পক্ষপাত, আচরণবিধি লঙ্ঘন ইত্যাদি কতটা ঘটেছে। আবার তারা পর্যবেক্ষণ করেন ভীতি, আতঙ্ক, অনিয়ম বা রাজনৈতিক চাপ ভোটারদের অংশগ্রহণে প্রভাব ফেলেছে কিনা।
কিন্তু পর্যবেক্ষণ যতই শক্তিশালী হোক, এটি কখনও রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া সম্পূর্ণ হতে পারে না। কারণ দলই মাঠের বাস্তবতা প্রকাশ করে, তথ্য দেয়, অভিযোগ তোলে, এজেন্ট পাঠায় এবং ভোটের পরিবেশকে যেভাবে গঠন করে, পর্যবেক্ষকরা তার ওপর ভিত্তি করেই রিপোর্ট তৈরি করে।
২. রাজনৈতিক দল: নির্বাচনের কেন্দ্রবিন্দু
যে কোনো গণতান্ত্রিক নির্বাচনের শক্তি নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও তাদের আচরণের ওপর। দলই নির্বাচনকে প্রাণবন্ত করে, প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে, ভোটারকে সংগঠিত করে এবং জনমতের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু দলগুলোর কর্মপদ্ধতি, মেরুকরণ, ভাষা, প্রচারণার ধরন এবং আচরণবিধি মেনে চলার প্রবণতা নির্বাচনকে সুষ্ঠু বা বিতর্কিত-দুই দিকেই নিয়ে যেতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবিশ্বাস যত বাড়ে, পর্যবেক্ষণের প্রতি সন্দেহ তত বৃদ্ধি পায়। উদাহরণ স্বরূপ, একটি দল যদি মনে করে যে নির্বাচন কমিশন তাদের বিপক্ষে কাজ করছে, তাহলে তারা পর্যবেক্ষকের ওপর নির্ভরতা বাড়ায়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল কখনো কখনো পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিকে অপ্রয়োজনীয় হিসেবে ভাবতে পারে। এই মনস্তত্ত্বই দুই পক্ষের সম্পর্ককে জটিল করে তোলে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক মেরুকরণ অর্থাৎ দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির বিরোধ, নির্বাচনী আস্থাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ফলে পর্যবেক্ষকদের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। কিন্তু এই ভূমিকাই আবার দলগুলোকে আন্তরিক সহযোগিতার বদলে সন্দেহের জায়গায় দাঁড় করিয়েছে।
৩. টানাপোড়েনের বাস্তবতা: আস্থাহীনতা ও রাজনৈতিক ব্যাখ্যা
রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অবিশ্বাসের কারণে। পরিবেশ উত্তপ্ত থাকলে রাজনৈতিক দলগুলো পর্যবেক্ষক সংস্থাকে বিদেশি স্বার্থের প্রতিনিধি বলে আখ্যা দেয়। আবার অন্যপক্ষ দাবি করে পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট আসলে রাজনৈতিক দলকে আড়াল করে। এই পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষকেরা যাই বলেন, তা রাজনৈতিক দল নিজের সুবিধা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে।
নির্বাচনের দিনে অনেক সময় পর্যবেক্ষকদের কেন্দ্র প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হয়, তাদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের চাপ থাকে, আবার কখনো ভোটার বা এজেন্ট তথ্য দিতে ভয় পায়। ফলে পর্যবেক্ষণ পুরোপুরি স্বাধীন হয় না। অপরদিকে দলগুলোও অভিযোগের বন্যায় পর্যবেক্ষকদের বিভ্রান্ত করতে পারে, এমনটাও দেখা গেছে।
এভাবে পর্যবেক্ষণ ও রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক একটি ‘টানটান দড়ির লড়াই’-এ পরিণত হয়, যেখানে আস্থা কম, স্বচ্ছতা সীমিত এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বেশি।
৩. মাঠপর্যায়ে পর্যবেক্ষকদের যে বাস্তব চ্যালেঞ্জ
নির্বাচন যত বড় হয়, পর্যবেক্ষণের কাজ তত কঠিন হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে একাধারে হাজার হাজার কেন্দ্র, কখনো সহিংসতা, কখনো প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা, আবার কখনো রাজনৈতিক চাপ, এসবই পর্যবেক্ষকদের কাজকে জটিল করে তোলে। পর্যবেক্ষকদের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো সত্যিকারের তথ্য সংগ্রহ। অনেক সময় তাদের দেওয়া তথ্য একপক্ষ সন্তুষ্ট হলেও অন্যপক্ষ পুরোপুরি বাতিল করে দেয়। আবার রিপোর্ট প্রকাশের পরে তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণও হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ময়দানে নিরাপত্তা ঝুঁকিও থাকে।
এই পরিস্থিতি নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও কার্যকারিতা সীমিত করে ফেলে, যা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদান।
৪. উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা: সম্পর্কের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো
বিশ্বের অনেক গণতান্ত্রিক দেশে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার সম্পর্ক অত্যন্ত সংগঠিত ও কাঠামোবদ্ধ। ইউরোপে নির্বাচন পর্যবেক্ষকেরা রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং কমিশনের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেন। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের আগে ‘Pre-Observation Assessment’ হয়, যেখানে দলগুলো পর্যবেক্ষকদের ব্রিফ করে। আফ্রিকার ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া-এসব দেশেও পর্যবেক্ষণ একটি সামাজিক আন্দোলনের মতো প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশে এই কাঠামো এখনো সম্পূর্ণ গড়ে ওঠেনি, তবে সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের দেশে নাগরিক সমাজ শক্তিশালী, গণমাধ্যম সচেতন এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বেশি, যা নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রকে আরও উন্নত করার সুযোগ তৈরি করে।
৫. সমাধানের পথ: সহযোগিতা, প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ ও স্বচ্ছতার চর্চা
এই সম্পর্ককে আরও সুশৃঙ্খল করতে হলে প্রথমেই নির্বাচন কমিশনকে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় শক্তিশালী করতে হবে। কমিশনকে উচিত রাজনৈতিক দল ও পর্যবেক্ষকের মধ্যে নিয়মিত সংলাপ আয়োজন করা, যাতে ভুল বোঝাবুঝি কমে। প্রশিক্ষণ, যৌথ ব্রিফিং, ডেটা শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ও হেল্পডেস্ক- এসব ব্যবস্থা গড়ে তুললে উভয় পক্ষের আস্থা বাড়বে।
পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রেও প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানো, প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ ডেটা সংগ্রহ, স্বচ্ছ রিপোর্টিং এবং জনমুখী যোগাযোগ। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলকেও নির্বাচন আচরণবিধি সম্পর্কে নিজেদের কর্মীদের শিক্ষিত করা, পর্যবেক্ষকের সঙ্গে সহযোগিতা করা এবং তথ্য ভুয়া হলে যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্বশীলতা দেখাতে হবে।
গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজকেও এই সম্পর্ক মজবুত করতে ভূমিকা পালন করতে হবে। গণমাধ্যমের কাজ হলো পক্ষপাতহীনভাবে রিপোর্ট উপস্থাপন করা এবং রাজনৈতিক ব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতাকে তুলে ধরা। নাগরিক সমাজ নির্বাচন সংস্কার নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে, যা গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী করবে।
গণতন্ত্র কেবল রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের বিষয় নয়, এটি একটি সাংবিধানিক সংস্কৃতি, যার প্রতিটি স্তরে আস্থা, স্বচ্ছতা এবং দায়িত্ববোধ থাকতে হয়।রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সম্পর্ক সেই সংস্কৃতিরই অংশ। এই সম্পর্ক যত বেশি সহযোগিতামূলক হবে, নির্বাচন তত বেশি গ্রহণযোগ্য হবে; আর সম্পর্ক যত বেশি বিরোধপূর্ণ হবে, নির্বাচনের ফলাফল তত বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
অতএব, গণতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলকে বুঝতে হবে, পর্যবেক্ষক প্রতিপক্ষ নয়; তারা নির্বাচনের আস্থা রক্ষায় সহযোগী। আর নির্বাচন পর্যবেক্ষকদেরও উপলব্ধি করতে হবে, রাজনৈতিক বাস্তবতা ও মাঠপর্যায়ের জটিলতা বুঝে নিরপেক্ষতা বজায় রাখাই তাদের মূল দায়িত্ব।
যে দেশে রাজনৈতিক দল ও নির্বাচন পর্যবেক্ষণের সম্পর্ক স্বচ্ছ, সম্মানজনক ও জবাবদিহিতামূলক, সেই দেশেই গণতন্ত্র দৃঢ় হয়, ভোটার আস্থা বাড়ে এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিডি) ও পিএইচডি গবেষক

