ঐক্যের সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
ব্রি. জে. এইচ আর এম রোকন উদ্দিন (অব.)
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা যে প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেছেন-জাতীয় গণভোট, জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির অন্তর্ভুক্তি-তা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে নতুনভাবে পুনর্গঠনের দিকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসাবে দেখা উচিত। দীর্ঘদিন ধরে যে রাজনৈতিক অচলাবস্থা, অবিশ্বাস এবং মুখোমুখি অবস্থান আমাদের গণতান্ত্রিক যাত্রাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, এ প্রস্তাবনাগুলো সেই অচলাবস্থা ভাঙার জন্য এক বাস্তবসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো-বড় রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ছোট দল পর্যন্ত অধিকাংশ রাজনৈতিক সত্তা এসব প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে। এ ধরনের ঐকমত্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরল একটি দৃষ্টান্ত। প্রধান উপদেষ্টা খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে সব পক্ষের দাবি, উদ্বেগ ও ভিন্নমতকে গ্রহণযোগ্যভাবে বিবেচনা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি শুধু শান্তি ও স্থিতিশীলতার রূপরেখা দেননি, বরং বহু বছরের রাজনৈতিক ক্ষত মেরামতেরও একটি আশাব্যঞ্জক পথ উন্মোচন করেছেন।
এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংঘাত, বিভ্রান্তি বা সংঘর্ষের কোনো যৌক্তিকতা নেই। যখন দেশের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী অস্থায়ী কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক দাবিগুলোকে সমন্বিতভাবে স্থান দিয়েছে, তখন কোনো দলই আর বিশৃঙ্খলার অজুহাত তুলে অপরাজনীতি করার অধিকার রাখে না। বরং এখন সময় রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের পুনর্গঠন, নতুন নেতৃত্ব প্রস্তুত করা এবং জনগণকে সামনে রেখে নির্বাচনি প্রস্তুতিতে মনোযোগী হওয়ার। বাংলাদেশ আজ জুলাই বিপ্লবের পর এক নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে আছে-যেখানে জনগণ একটি নতুন ধরনের রাজনীতি দেখতে চায়। তারা চায় না ফিরে যেতে সেই পুরোনো যুগে, যেখানে রাজনীতি মানে ছিল সংঘর্ষ, দোষারোপ, প্রতিহিংসা ও ক্ষমতার একচেটিয়া দখলদারত্ব। বরং জনগণের স্বপ্ন হলো এমন একটি রাজনীতি, যেখানে থাকবে প্রতিযোগিতা কিন্তু সঙ্গে থাকবে শিষ্টাচার; থাকবে মতবিরোধ কিন্তু থাকবে সংলাপের পথ; থাকবে দলীয় অবস্থান কিন্তু থাকবে জাতীয় স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রাখার দৃঢ়তা। প্রধান উপদেষ্টার প্রস্তাবগুলো সেই নতুন রাজনীতির ভিত্তি গড়ে দেয় : গণভোটের মাধ্যমে জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন, সংসদে পিআর সিস্টেম চালু। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব হলো-আত্মসমালোচনা করা, নিজেদের সংগঠন ও নেতৃত্বকে আধুনিক চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং ইতিবাচক প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হওয়া। কোনো দলকে আর বিভাজন, উত্তেজনা বা ভয়ের রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া উচিত নয়। বরং প্রতিটি দলকে জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে নিজেদের অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ অনেক কিছু হারিয়েছে-বিশ্বাস, স্থিতিশীলতা এবং সমানাধিকার। কিন্তু তারা এখনো আশা হারায়নি। তারা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায় এমন নেতাদের দিয়ে, যারা অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যৎ নির্মাণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। জুলাই বিপ্লবের রক্ত শুধু প্রতিরোধের প্রতীক নয়-এটি আমাদের রাজনৈতিক পুনর্জন্মের প্রতীক। এখন আর সংঘর্ষ নয়, এখন প্রয়োজন দায়িত্বশীলতা। এখন আর বিভাজন নয়, এখন সময় ঐক্যের। এখন আর ক্ষমতার লোভ নয়-এখন সময় জাতির ভবিষ্যৎ রক্ষার।
যদি রাজনৈতিক দলগুলো এখনো অবুঝের মতো লড়াই-বিতর্ক, অবিশ্বাস ও ক্ষমতার খেলায় লিপ্ত থাকে, তাহলে ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। কারণ পথ এখন পরিষ্কার-দেশকে এগিয়ে নেওয়ার রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক সাহস ও দূরদৃষ্টি দেখানোর পালা। বাংলাদেশ এক নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনায় দাঁড়িয়ে। দলগুলো যদি বুদ্ধিমত্তা ও দায়িত্ববোধ দেখায়, তবে এ নির্বাচন শুধু সরকার গঠনের প্রক্রিয়া হবে না, এটি হবে জাতীয় পুনর্জাগরণের সূচনা। এ সুযোগ হারানো মানে আরেকটি অন্ধকার দশকে পতন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রমাণ করে, প্রতিবার যখন দলগুলো নিজের সংকীর্ণ স্বার্থে বন্দি হয়েছে, তখনই রাষ্ট্রকে ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়েছে। ১/১১-এর আগের সময়টা ছিল সেই দৃষ্টান্তের সবচেয়ে তিক্ত উদাহরণ-যেখানে ক্ষমতার লড়াই, একে অপরকে নিশ্চিহ্ন করার মানসিকতা এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস পুরো জাতিকে এক অচলায়তনে পরিণত করেছিল। রাজনীতি তখন আর জনগণের সেবা ছিল না; তা হয়ে উঠেছিল প্রতিহিংসার প্রতিযোগিতা। প্রশাসন পক্ষপাতদুষ্ট, বিচারব্যবস্থা রাজনীতির হাতিয়ার, আর সাধারণ মানুষ হয়ে উঠেছিল নিছক দর্শক। ঠিক সেই দিকেই আমরা আবার হাঁটছি, হয়তো আরও দ্রুতগতিতে। আজকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান এতটাই শক্ত করে ফেলেছে যে, তারা জনগণের কণ্ঠস্বর শুনতেও রাজি নয়। ‘আমিই ঠিক, অন্যরা ভুল’-এ মানসিকতা তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিয়েছে। ফলাফল হলো, সংলাপের জায়গায় এসেছে সংঘাত, আলোচনা বদলে গেছে আগুন-ঝরানো বক্তৃতায়, আর গণতন্ত্রের আদর্শ ডুবে গেছে ব্যক্তিগত স্বার্থের কাদায়। যারা এক সময় গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করেছে, তারাই এখন সেই গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হানছে মিথ্যা প্রচারণা, গুজব, সহিংসতা ও ভয় দেখানোর রাজনীতির মাধ্যমে। এ আত্মবিধ্বংসী রাজনীতির সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা। যখন রাজনীতিকরা নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত, তখন প্রশাসন অকার্যকর হয়ে পড়ে, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, আর বিদেশি প্রভাবশালী শক্তিগুলো সেই দুর্বলতাকে সুযোগ হিসাবে নেয়। গণতন্ত্র তখন নামমাত্র থাকে-ভোট, সংসদ, দল-সবই থাকে, কিন্তু তার ভেতরের প্রাণ চলে যায়। এটি সেই ‘নরম একনায়কতন্ত্র’, যেখানে স্বাধীনতার আড়ালে থাকে দাসত্ব, আর জনগণের নামে চলে ক্ষমতার ব্যবসা।
এর মধ্যেই আবার মাথা তুলছে পরাজিত শক্তি-আওয়ামী লীগের অপরাধ চক্র ও তাদের বিদেশি প্রভুরা। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রত্যক্ষ প্ররোচনা ও সহায়তায় তারা পরিকল্পনা করছে নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে ভণ্ডুল করার, ভয় ও বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার। তাদের লক্ষ্য একটাই-যেভাবেই হোক, নির্বাচনকে বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত করে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে তারা আবারও ক্ষমতায় অনুপ্রবেশ করতে পারে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন তথাকথিত গণমাধ্যমের মাধ্যমে মিথ্যা গুজব, বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে, যেন মানুষ বিশ্বাস করে, দেশে অরাজকতা ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই। কিন্তু তারা ভুল করছে। এই দেশ এখন আগের বাংলাদেশ নয়। দেশপ্রেমিক মানুষ আজ অনেক বেশি সচেতন। তারা জানে, স্বাধীনতার পর থেকে যত সংকট এসেছে, সব কিছুর মূলে ছিল ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ ও বিদেশি প্রভাব। এবার জনগণ সেই ভুল আর করবে না। ভারতের প্ররোচনায় বা কোনো কূটনৈতিক চাপের মুখে তারা নিজের ভবিষ্যৎ কাউকে বন্ধক দেবে না। এ দেশ একবার রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে-দ্বিতীয়বার আর পরাধীনতার শৃঙ্খল পরবে না। দেশপ্রেমিক শক্তি এবার যেভাবেই হোক, প্রতিরোধ গড়ে তুলবে-যে শক্তিই দেশের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা করবে, তারা জাতির ক্রোধের মুখে পড়বে।
এখন সময় এসেছে শক্ত অবস্থান নেওয়ার। যারা বিদেশি প্ররোচনায় কাজ করছে, যারা নির্বাচন বিলম্বিত করতে চাইছে, তাদের সরাসরি জাতির শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। গণতন্ত্র মানে বিশৃঙ্খলার স্বাধীনতা নয়; গণতন্ত্র মানে জবাবদিহি ও দায়িত্ববোধ। যদি রাজনৈতিক নেতারা এটা না বোঝেন, তবে তাদের নেতৃত্বের নৈতিক অধিকার নেই। এদিকে কিছু তথাকথিত আন্দোলনও চলছে, যার উদ্দেশ্য কোনো বাস্তব সমস্যা সমাধান নয়, বরং মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়া। এসব আন্দোলন পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হচ্ছে যেন দেশবাসী মূল সমস্যাগুলো-দুর্নীতি, কর্মসংস্থান, ন্যায়বিচার ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার-ভুলে যায়। জনগণ আজ এসব নাটক আর বিশ্বাস করে না। তারা ফলাফল চায়, প্রতিশ্রুতি নয়। যদি রাজনীতিকরা এ বাস্তবতা না বোঝেন, তবে তাদের সময় শেষ।
বাংলাদেশ আজ এক মোড় ঘোরানোর মুহূর্তে দাঁড়িয়ে। জুলাই বিপ্লবের চেতনা এখনো জীবিত আছে। সেই চেতনার পুনর্জাগরণই আজ দরকার-একটি সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, যেখানে ভোট, স্বাধীনতা ও মর্যাদা থাকবে বিদেশি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। যদি এবারও আমরা ব্যর্থ হই, তাহলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। আগামী কয়েক সপ্তাহই ঠিক করে দেবে-বাংলাদেশ এগোবে, নাকি আবারও অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখনই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে-শক্তি ভাগাভাগির জন্য নয় বরং রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য। একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচনি প্রক্রিয়া, পারস্পরিক সংযম এবং বিদেশি প্রভাব থেকে মুক্ত সিদ্ধান্ত-এগুলোতেই জাতীয় নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে।
এটি চূড়ান্ত মুহূর্ত। যদি রাজনীতিকরা এখনো দায়িত্বশীল আচরণ না করেন, তাহলে আবারও রাস্তাই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে এবং ইতিহাস তাদের নাম মনে করবে বিশ্বাসঘাতক হিসাবে। দেশ আর কোনো রাজনৈতিক উন্মাদনা সহ্য করতে পারবে না। বাংলাদেশের জনগণ এখন এমন একটি সরকার চায়, যা তারা নিজের হাতে বেছে নেবে, কোনো বিদেশি শক্তি চাপিয়ে দেবে না। তারা এমন এক গণতন্ত্র চায়, যা ঐক্য ও মর্যাদার ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে, বিভেদ ও বিশৃঙ্খলার ওপর নয়। সময় শেষ হয়ে আসছে, এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি রাজনৈতিক দলগুলো না জাগে, তারা শুধু নির্বাচনের সুযোগই হারাবে না, হারাবে দেশকেও।
ব্রি. জে. এইচ আর এম রোকন উদ্দিন (অব.) : নিরাপত্তা বিশ্লেষক
