Logo
Logo
×

বাতায়ন

ফ্যাসিস্টের বিচার যে বার্তা দেয়

Icon

আবদুল আউয়াল ঠাকুর

প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ফ্যাসিস্টের বিচার যে বার্তা দেয়

বাংলাদেশে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রপ্রধান শেখ হাসিনার মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে গণ-অভ্যুত্থানে বিদায় নেওয়ার ১৬ মাসের মাথায় অপরাধের আংশিক বিচার সম্পন্ন হয়েছে। দেশপ্রেমিকদের বিচারিক প্রক্রিয়ায় হত্যা করার অসৎ উদ্দেশ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পুনঃগঠিত হওয়ার পর এ বিচার সম্পন্ন হলো। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক ড. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত এ ট্রাইব্যুনাল ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা এবং ১৫ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। তার সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও একই সাজা দেওয়া হয়েছে। রায়ের পর ফ্যাসিস্ট আক্রান্ত পরিবারগুলো ভেসেছে আনন্দতাশ্রুতে। বিএনপি বলেছে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। জামায়াত বলেছে, রায় আন্তর্জাতিক মানের হয়েছে। এনসিপি রায় দ্রুত কার্যকর করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেছে। অ্যামনেস্টি মনে করে, ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি পাওয়া দরকার। এ বিচারের ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বশেষ স্বৈরাচারের বিচার অনুষ্ঠিত হলো বা হতে পারল। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ফ্যাসিস্ট উড়ে গিয়েছিলেন সেনা অভ্যুত্থানে, দ্বিতীয়জন কারারুদ্ধ হয়েছিলেন, তৃতীয় ফ্যাসিস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন। সে কারণেই ভেবে দেখার রয়েছে আমরা আসলে কোন পথে যাচ্ছি।

সোমবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যে উল্লাস বয়ে গেছে, সেটি আসলে নতুন কোনো বিষয় নয়। এটি আসলে ৫ আগস্টে ঘটে যাওয়া আনন্দানুষ্ঠানেরই নবসংস্করণ। আমরা যদি একটু পেছনে ফিরি, তাহলে দেখব ৯ বছরের সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের সেই রাতের দৃশ্য। সারা রাত মানুষ আনন্দ করে রাতকে দিনে পরিণত করেছিল। মানুষের বাঁধভাঙা জোয়ারের আসলে যে বার্তা ছিল, সেটি হলো, আর যাতে কোনো স্বৈরাচার জাতির ঘাড়ে চেপে বসতে না পারে। কার্যত সেবার নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ বিএনপি ও তাদের জোটকে বিজয়ী করে সেই ম্যান্ডেটই ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ইতিহাসের নির্মমতায় তা টিকে থাকেনি। নানা অজুহাতে আবার ফিরে এসেছিল ফ্যাসিবাদ।

আরও একটু আগে যাই। যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার রক্তশপথ নিয়ে আমরা নিজেদের পতাকা অর্জন করেছিলাম, সেই দেশে মাত্র তিন বছরের মাথায় নেমে আসে বাকশালের স্বৈরাচার। সে বিবেচনায় স্বাধীনতার পর মাত্র বছর দুয়েক কোনোভাবে টেনেহিঁচড়ে ভাঙা-খোঁড়া-লুলা পায়ে মানুষের অধিকার টিকে থাকে। লাল ঘোড়ার খুরের নিচে পিষ্ট হতে শুরু করে মানুষ। সে এক ভয়াবহ চিত্র ছিল। আবু সালেহর ভাষায়, রক্ত দিয়ে পেলাম এ কোন স্বাধীনতা। বলা হয়ে থাকে, ২৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা লাল ঘোড়ার খুরে নিহত হয়েছিল। ১৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর জাতীয়ভাবে নাজাত দিবস পালন করা হয়। হাজার হাজার মানুষ সেদিন নারায়ে তাকবির ধ্বনি দিয়ে আনন্দ উৎসবে মেতে উঠেছিল।

মানুষ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদের রায় ঘোষণা করেছিল। তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত সেদিন দৃঢ়প্রত্যয় ঘোষণা করেছিল স্বৈরাচার ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে। জনতার রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া। নিষিদ্ধ বাকশালের কারাগার থেকে তিনি মুক্ত করতে চেয়েছিলেন জাতিকে। দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়ে দেশকে স্বাভাবিক করার প্রাণান্ত চেষ্টায় রত ছিলেন তিনি। একটা আবহ তৈরিও করেছিলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী। কিন্তু সেটি টিকল না। এক গভীর চক্রান্তের অংশ হিসাবে তিনি নিহত হলেন। এরপর দৃশ্যপট দ্রুত বদলাতে থাকল। একটি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে সামরিক শাসন দেওয়া হলো। কেন এ সামরিক শাসন, সেটি পরিষ্কার হলো ক্রমশ। নজিরবিহীনভাবে আওয়ামী লীগ সেই সামরিক শাসনকে সমর্থন করেছিল। আঁতাতের নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। পুরোটা ধরা পরল ’৮৬ সালের নির্বাচনে। নিজেদের জাতীয় বেইমানের খাতায় নাম লিখিয়ে ওই নির্বাচনে তারা অংশ নিল। ভারতীয় পত্রপত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দিল্লির ইচ্ছায় আওয়ামী লীগ নির্বাচনে গিয়েছে। সেই নির্বাচনে কথিত বিরোধী দলে থেকে নিজেদের ক্ষমতার গন্ধে রুষ্ট করেছিল।

নবযাত্রার শুরু সেখান থেকেই। আজ যে ফ্যাসিস্টের আলোচনা, তার সূত্রপাত হয়েছিল ’৮২ সালের সামরিক শাসন থেকে। আরেকটু পিছিয়ে বলা যায়, প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যার মধ্য দিয়ে। এই যে চক্রান্ত, তার শেষপ্রান্তে এসেছিল গত সাড়ে ১৫ বছরের কথিত নির্বাচন। প্রতিবেশীর করা চক্রান্তের অংশ হিসাবে জনগণকে ধোঁকার মুখে ফেলে পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যা কেবল প্রহসন বললে ভুল হবে, এটি ছিল ভারতীয় মোসাহেব তৈরির তালিকা প্রণয়নের শিডিউল। সম্প্রতি একজন বিশ্লেষক বলেছেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে প্রমোশন, চাকরি, রিক্রুটমেন্ট-সব জায়গাতেই ছিল র-এর প্রভাব। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। বিষয়টি নিয়ে কথা বাড়ালে নানা কথা আসে। সত্য হচ্ছে, মেরুদণ্ডহীন প্রাণীকে অন্যের ওপর নির্ভর করেই চলতে হয়। সংবিধান অনুযায়ী দেশের জনগণ দেশের মালিক হলেও সেই জনগণ যখন শত্রুতে পরিণত হয়, তখন নির্ভরতা অন্যের ওপর হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। গত সাড়ে ১৫ বছরেই এটা ঘটেছে, সেকথা বলা সংগত নয়। মূলত স্বাধীনতার পর থেকেই এটা চলে আসছিল। ধীরে ধীরে এরা আসন পেতে বসেছে, বিস্তৃত হয়েছে। এটাই মূলত ফ্যাসিবাদ। বাংলাদেশকে করতলগত করতে এরা নানা কৌশলে কথা বলে, কাজ করে।

ধরুন রায়ের পর ভারতের বিবৃতির কথা। নিয়মানুযায়ী রায়ের পর অভিযুক্তকে ফিরিয়ে দেওয়াই সাধারণ রীতি। সেখানে তারা নানা কথার তুবড়ি উড়িয়েছে। এক্ষেত্রে দুটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার কিছুদিন আগে ক্যাপ্টেন মাজেদকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে সেখানকার গোয়েন্দা কৌশলে আটকে বাংলাদেশে হস্তান্তর করা হয়েছিল। ধরুন, আল্লামা দেলাওয়ার হুসাইন সাইদীর সেই রাজসাক্ষী সুখরঞ্জন বালির কথা, যাকে এই আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ভারতে। এসবে কোনো সমস্যা না হলে এখন সমস্যা হবে কেন? আসলে খেলতে চাচ্ছে ফ্যাসিবাদের মোড়ল। খেলাটা খুব ছোট নয়, অনেক বড়। সে কারণেই সর্বশেষ ফ্যাসিস্টের বিচারের পর প্রকৃত বিবেচনায় ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণ এবং ফিরিয়ে আনার বিষয়টি ভাবা জরুরি।

গত ৫৪ বছরের মধ্যে প্রায় ৩০-৩৩ বছর দেশ শাসন করেছে কোনো না কোনোভাবে ফ্যাসিবাদ। আমরা গত ১৫ বছর যেমন সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছি, অতীতের চেয়ে তা কিছুটা হলেও ভিন্নতর। এর মূল্যায়নেও ভিন্নতা রয়েছে। জুলাই-আগস্টের ঘটনায় নিহত-আহতের পরিসংখ্যান নিয়ে ভিন্নতা রয়েছে। এ অলোচনা শুধু সাম্প্রতিক বিষয়েই নয়, বিবেচনায় আনতে হবে গত সাড়ে ১৫ বছরের সামগ্রিকতা। ২০১৩ সাল পর্যন্ত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির শহীদ হয়েছেন ১ হাজার ৫৫১ জন। গুরুতর আহত হয়েছেন ৪২৩ জন। ষড়যন্ত্র মামলায় আসামি হয়েছেন ৬০ লাখ। ফ্যাসিস্ট প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যারা আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর বজলুল হুদা। তার ভাই নুরুল হুদা ডিউক অভিযোগ করেছেন, তার ভাইকে সরাসরি জবাই করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামজিক মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বিষয় হচ্ছে, জাতীয় মেধা-মননকে শেষ করে দেশে ভিন্ন দেশীয় আচার-আচরণ প্রবেশ করিয়ে জাতিকে সর্বস্বান্ত করা। স্বৈরাচার বলতে কেবল শাসনক্ষমতায় থাকা দুর্বৃত্তদেরই বোঝায় না, বরং এর ব্যাপ্তি অনেক বিস্তৃত। প্রেসিডেন্ট জিয়া চালু করেছিলেন বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। সংবিধানে যুক্ত করেছিলেন বিসমিল্লাহ, দিয়েছিলেন আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের কথা। এগুলো শুধুই কথার কথা নয়। আমাদের জাতিসত্তা খুঁজতে গেলে এর প্রতিটি বিষয়ে গভীর তাৎপর্য পাওয়া যাবে। আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার সঙ্গে স্বৈরাচার নির্মূলের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে।

ফ্যাসিস্টের বিচারে যে উল্লাস-আনন্দ, বাঁধভাঙা খুশির জোয়ার, তার মূলে রয়েছে স্বৈরাচার রুখে দেওয়ার অঙ্গীকার। এ কাজটি করতে হলে প্রথমত নির্বাচনকে সচল রাখতে হবে। আর সেই সঙ্গে নজর রাখতে হবে নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে যাতে স্বৈরাচারের পুনরাবির্ভাব না ঘটে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের ইতিহাস যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে নিঃশঙ্কচিত্তে বলা যাবে বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়া, গণতন্ত্রের সম্রাজ্ঞী খালেদা জিয়া কখনো নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত রাখতে, ক্ষমতা আটকে রাখতে চাননি। বরং নিজেকে বিপন্ন করেছেন দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যখন সম্পদ লুটসহ নানা গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, সে বিবেচনায় সাবেক আওয়ামী লীগ তথা বিএনপিবিদ্বেষী শাসনামলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছিল, আদালত তাকে উদ্দেশ্যমূলক বলে উল্লেখ করেছে। আজ পর্যন্ত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির অভিযোগ দাঁড় করানো যায়নি। খোদ আওয়ামী আমলেই তারেক রহমান কথিত দুর্নীতির মামলা থেকে খালাস পেয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে চলছিল প্রতিহিংসার মামলা।

যখন নির্বাচন আসছে, তখন অনেক কথা হচ্ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বৈরাচার চিহ্নিত। তাকে মোকাবিলাই রায়ের আসল বার্তা। সে বার্তা কার্যকর করতে হলে সবাইকে আন্তরিক থাকতে হবে একটি স্বচ্ছ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে। সংশ্লিষ্ট সবার অন্তরিকতাই কেবল স্বৈরাচার রুখতে পারে। আর সেটাই আজকের মূল প্রত্যাশা।

আবদুল আউয়াল ঠাকুর : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম