ভারতীয় গণমাধ্যমের ভাষ্য
মন্দির থেকে জন্ম নিচ্ছে এক হিন্দুরাষ্ট্র
ইন্দ্রানী দাশগুপ্ত
প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাঁচশ’ বছরের দাসত্বের ইতিহাসের অবসান হয়েছে। ৫০০ বছরের ব্যথা সেরে উঠেছে। এক নবরূপের পথে আমরা চলেছি। এ কথাগুলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী অযোধ্যার রামমন্দিরে ভগোয়া ধ্বজা বা ধর্ম ধ্বজা উত্তোলনের পর দেশের মানুষকে বলেন। প্রতিটি চ্যানেলে সেই ভাষণ দেখায়, প্রতিটি খবরের কাগজে সেই কথাগুলো লেখা হয়, কেউ উৎকোচ পেয়েছেন এবং আরও পাওয়ার আশায় এক নতুন যুগের সূচনার কথা জানালেন। কেউ আবার জেলে যাওয়া আটকাতে এ মন্দিরের পেছনে যে বিরাট স্থাপত্যবিদ্যা কাজ করেছে, এ মন্দিরই যে ভারতের আত্মাকে জুড়বে, এ মন্দির যে দেশের ঐক্যের প্রতীক, এমন ব্যাখ্যা দিলেন। মোদ্দা কথা হলো, যে যেভাবে পারলেন, এ নতুন যুগের ভোরে নিজেদের আখের গোছানোর কাজ করলেন।
হিন্দু সমাজে এক বিশাল আলোড়ন দেখা দিল, রামরাজ্য এসে গেল! স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মন্দির থেকেই শুরু হলো নবনির্মাণ, আসছে রামরাজ্য। এরকম একটা সময় আরেকজন প্রধানমন্ত্রীর কথা মনে পড়তে বাধ্য, তিনিও দেশের নতুন মন্দিরের উদ্বোধন করেছিলেন। এক নবনির্মাণ সেদিনও শুরু হয়েছিল। সেদিনের সেই নবনির্মাণের নায়ক সময় পেয়েছিলেন ১৭ বছর। মাথায় রাখতে হবে, সদ্য দেশ বিভাগের পর লুট হয়ে যাওয়া এক দেশের হাল ধরেছিলেন সেই নবনির্মাণের নায়ক। হ্যাঁ, জওহরলাল নেহেরুর কথাই বলছি। ’৪৭-এর ১৫ আগস্ট তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন। ভাকরা-নাঙ্গাল নদী বাঁধ তৈরি হয়েছে, উৎপাদন হবে জলবিদ্যুৎ।
নেহেরু বলেছিলেন, এটাই হলো আধুনিক ভারতের মন্দির। টেম্পেলস অফ মডার্ন ইন্ডিয়া। সেই স্থাপত্য নিয়ে কথা বললে যদি আবার জেলে পুরে দেয়, তাই আপাতত ওই রামমন্দিরের মাহাত্ম্য নিয়ে কথাবার্তা।
’৪৭ সাল। দেশের মানুষের খাদ্য চাই। অসংখ্য উদ্বাস্তুর মাথার উপর ছাদ চাই। ওধারে চীনের আস্ফালনে ছুরি, এধারে দুর্ভিক্ষ। এমন পরিপ্রেক্ষিতে তিনি স্বপ্ন দেখছেন, নতুন ভারতের নতুন মন্দিরগুলোর। সেটারও ছিল নবনির্মাণ। আসুন সেই নবরূপের খোঁজখবর নেওয়া যাক। ভাকরা-নাঙ্গাল ড্যাম দিয়ে শুরু হয়েছিল নতুন ভারতের মন্দিরের শুরু। মারা যাওয়ার আগে এ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে যন্ত্রপাতি দরকার, তার জন্য ভারত হেভি ইলেক্ট্রনিক্স লিমিটেডের (ভেল) পরিকল্পনা করেছিলেন নেহেরু। আজও সেই ভেল এক লাভজনক প্রতিষ্ঠান। গতকালও যখন বাকি শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে, ভেলের শেয়ারের দাম কিছুটা হলেও বেড়েছে। নেহেরুর সময় তৈরি হলো অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স (এমস)। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার এক নতুন অগ্রগতি শুরু হয়েছিল এই এমসের হাত ধরে। এই এমস-এ গত বছরে রামমন্দির উদ্বোধনের জন্য একবেলার ছুটি ঘোষণা করা হয়েছিল। এক মন্দির বন্ধ রেখে অন্য মন্দিরের উদ্বোধন হচ্ছে। তাই শেষে চারধার থেকে চিৎকার-চেঁচামেচি হওয়ার পরে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। আজও দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মাথায় বসে আছে এই এমস, যা ছিল ভারতের প্রথম নবনির্মাণের একটা পিলার।
লাইফ ইন্স্যুরেন্স করপোরেশন অফ ইন্ডিয়া, সেই নেহেরুর সময় শুরু হয়। দেশের মানুষ যাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিমার সুযোগ পায়, তার জন্য এলআইসি পথচলা শুরু করে। এরই সঙ্গে এলো ওএনজিসি, অয়েল অ্যান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি। নিজেদের তৈলভান্ডার খুঁজে বের করতে হবে, ক্রুড অয়েল পরিশোধন করতে হবে। হ্যাঁ, নবনির্মাণের প্রথম পুরোহিতের হাত ধরেই ওএনজিসির পথচলা। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অফ ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজাইনের রূপরেখা তৈরি হলো, কাজও শুরু করল ওই জওহরলাল নেহেরুর সময়। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, যা আজকেও সারা দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পড়াশোনার অন্যতম জায়গা, সেটাও ওই সময় শুরু হয়। ইস্পাত কারখানা ভেলাই, রাউরকেল্লা, দুর্গাপুর-বিশাল উদ্যোগ, লাখো মানুষের চাকরি। আর মজার কথা, তখন আমাদের ১ ট্রিলিয়ন ইকোনমিও নয়; কিন্তু এসব হচ্ছে রাষ্ট্রের টাকায়। আর আজ সেসব বিক্রি করা হচ্ছে। আজ যা কিছু হচ্ছে, তা হচ্ছে আদানি, আম্বানি বা তাদের মতো দু-চারটে হাউজের জন্য। এদিকে দেশের অর্থনীতি নাকি ৫ ট্রিলিয়ন ইকোনমি হবে আর কিছুদিনের মধ্যে।
গান্ধীর কথা মাথায় রেখেই পরিকল্পনায় ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেছিলেন নেহেরু। খাদি ও গ্রামোদ্যোগ কমিশনও তৈরি হয়েছিল এ সময়। তখন স্মার্ট সিটি বলা হতো না; কিন্তু গড়ে উঠেছিল বড় শহর, তার পরিকাঠামো। সঙ্গে নিলেন কাদের? নিজে একাই পুরোহিত হয়ে থাকার ইচ্ছে তো নেহেরুর ছিল না। নিজেই বিজ্ঞানী, নিজেই ম্যাথমেটিশিয়ান, নিজেই নালির গ্যাস থেকে স্টোভ জ্বালাচ্ছে বা a+b-এর মাহাত্ম্য বোঝাচ্ছে, এরকম ইচ্ছা নেহেরুর ছিল না। তিনি সঙ্গে নেন মহারথীদের হোমি জাহাঙ্গীর ভাবা, বিক্রম সারাভাই, পিসি মহালানবিশ, ভার্গিস কুরিয়েন, এসএস ভাটনাগর, সিডি দেশমুখ-একেকজন একেক দিকপাল। শুরু হয় ইসরোর পরিকল্পনা। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট নতুন করে সাজানো হয়, প্রথম জেনারেশন কম্পিউটারও আসে সেখানে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হয়, অনুপ্রেরণা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। প্ল্যানিং কমিশন তৈরি হলো। নেতাজি বহু আগেই তার বিস্তৃত পরিকল্পনা করে গেছেন। নেতাজির সেই প্ল্যানিং কমিশন অবশ্য এখন নাম পালটে নীতি আয়োগ।
ওদিকে আইআইটি শুরু হয়, রেলপথের বিস্তারের হার আজও রেকর্ড। সেই সময় সূত্রপাত ইন্ডিয়ান অয়েলের, আমূলের, যা আজও পৃথিবীর ১০০টি কোম্পানির মধ্যে অন্যতম। ভার্গিস কুরিয়েনের হাত ধরে দেশে দুধের ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতার দিকে এগোনো হলো। শিশুদের দুধ দরকার। গ্যালন গ্যালন দুধ শিবের মাথায় ঢালার জন্য নয়, পুষ্টির জন্যই দরকার, বুঝেছিলেন নেহেরু। শুরু করেছিলেন নবনির্মাণ। সেই নায়ক মাত্র ১৭ বছর পর ১৯৬৪-তে যখন মারা যাচ্ছেন, তখন ৩০-এ মে ‘দি ইকোনমিস্ট’ পত্রিকায় লেখা হচ্ছে : ‘Through all the long years of his premiership, he retained his magical grip on the great masses of people.’ তিনি দেশের নতুন মন্দিরের নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তার সঙ্গেই দেশের মানুষের সঙ্গে ছিল তার আত্মিক সম্পর্ক।
আজকে যে প্রধানমন্ত্রী এক মন্দিরের উপরে তাদের বহুকালের স্বপ্ন, সেই ভগওয়া ধ্বজা উত্তোলন করে নবভারতের নির্মাণের, ভারতের নবজাগরণের কথা বলছেন, তার রাজত্বকালে মাত্র ১০ বছরে ডি-মনিটাইজেশনের মতো দেশকে জ্যান্ত দমানো পরিকল্পনা আমরা দেখেছি। দেখেছি আনপ্ল্যান জিএসটি এনে আবার সেই অর্থনীতিকেই আরও বিপন্ন করতে। দেশের যাবতীয় সম্পদ, যার মালিকানা ছিল দেশের মানুষের কাছে, তা বেচে দেওয়া হচ্ছে। দেশের মানুষের গড় আয় কমছে, সম্পদ কমছে; কিন্তু বাড়ছে আদানি, আম্বানির মতো করপোরেট জায়েন্টদের সম্পদ। দেশে আজ যে বৈষম্য, তা তো আমরা স্বাধীনতার পরও দেখিনি। দেশ ৫ ট্রিলিয়ন ইকোনমি হয়ে লাভ কী, যদি মানুষের মাথাপিছু আয় না বাড়ে, উলটো কমে যায়?
তিনি নতুন কালচক্রের কথা বলছেন। রামমন্দিরের আঙিনা থেকে রামরাজ্যের কথা বলছেন। কেমন সেই রামরাজ্য? খানিকটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা তো স্বয়ং তুলসীদাস নিজেই করেছিলেন। তিনিই বলেছেন, কম বয়সে যেন কেউ মারা না যায়, কেউ যেন অসুস্থ না থাকে। সবাই নীরোগ আর সুন্দর স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। কেউ যেন দরিদ্র বা দুঃখী না হয়, কেউ যেন মূর্খ বা শুভ লক্ষণহীন না হয়। হ্যাঁ, এটাই রামরাজ্যের শর্ত। আর বাস্তব অবস্থা কী? দারিদ্র্যের মাপকাঠিতে আমরা ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স এ কথাই বলছে। হ্যাপিনেস ইনডেক্সে আমরা ১৩৬টি দেশের মধ্যে ১২৬-এ দাঁড়িয়ে আছি, নেপাল ও বাংলাদেশের পরে। দেশের ৭ শতাংশ মানুষের হাতে ৮০ শতাংশ সম্পদ। দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষের হাতে সম্পদ আছে মাত্র ২০ শতাংশ। যে দেশের প্রায় ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষ নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত, সেই দেশে নবনির্মাণ শুরু হচ্ছে একটি মন্দিরকে দিয়ে? হ্যাঁ, এ মন্দির এক বিরাট আবেগ তৈরি করেছে। সেই আবেগ দিয়ে একটা নির্বাচনই তো জেতা সম্ভব; কিন্তু সেই আবেগ দিয়ে ভুখা পেটে অন্নের জোগান দেওয়া তো সম্ভব নয়। নেহেরু যখন সেই নবনির্মাণের কাজে ব্যস্ত, তখন আজকের নবনির্মাণের হোতারা জাতির পিতাকে খুন করার চক্রান্ত নিয়ে ব্যস্ত। সারা দেশে দাঙ্গার পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি করা যায়, তার কাজে ব্যস্ত।
১৯৪৯-এ তারই অঙ্গ হিসাবেই বিতর্কিত এক মসজিদে রামলালার মূর্তি রেখে আসা হলো। তাই নিয়ে বারবার কমিউনাল টেনশন তৈরি করা হলো। দাঙ্গার আগুন জ্বালানোর চেষ্টা ধারাবাহিকভাবেই চলেছিল। সেই তারাই, সেদিনের দাঙ্গাবাজরা, স্বাধীনতার আগের বিশ্বাসঘাতকরা আজ দেশপ্রেমের কথা বলছে। নবনির্মাণের, নবজাগরণের কথা বলছে। ১৯৪৭-এর পর নবনির্মাণের ইতিহাসের সবচেয়ে মূল্যবান নির্মাণ হলো আমাদের সংবিধান। সেই সংবিধানের প্রতিটি পাতার, প্রতিটি মূল্যবোধকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে এ আধুনিক নবনির্মাণের শুরু। এ নবনির্মাণ নয়। কালাপাহাড়ের মতো দেশের সব আশা-আকাঙ্ক্ষার ওপর এক চূড়ান্ত আঘাত।
কলকাতাটিভির ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ অনুষ্ঠান থেকে সংকলিত
