Logo
Logo
×

উপসম্পাদকীয়

একমেরুকেন্দ্রিক কূটনীতির যুগ শেষ হতে চলেছে

Icon

জোনাথান হুইটল

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

একমেরুকেন্দ্রিক কূটনীতির যুগ শেষ হতে চলেছে

ফাইল ছবি

গাজায় এমন একটি কূটনীতির মূল্য বিশ্ব দেখেছে, যা নিয়মভিত্তিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার দাবি করে; কিন্তু তা বাছাই করে প্রয়োগ করে। গাজায় যুদ্ধবিরতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেরিতে হস্তক্ষেপ করেছে এবং তা শুধু এমন একটি দখলদারত্বকে রক্ষা করতে, যাকে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে) অবৈধ বলে রায় দিয়েছে। এক্ষেত্রে ভন্ডামিটা স্পষ্ট : ইউক্রেনের জন্য এক নিয়ম, গাজার জন্য আরেক।

এই বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব একমেরু কর্তৃত্বের কাঠামোগত পতনকেই চিহ্নিত করে, যা গত সপ্তাহে দক্ষিণ আফ্রিকায় জি২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি দ্বারা প্রকাশ পেয়েছে। গাজায় যুদ্ধবিরতি ফিলিস্তিনিদের জন্য রাজনৈতিক সমাধান বা নিরাপত্তা কোনোটাই দেয়নি। একই সময়ে গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে ফিলিস্তিনিদের অনুপস্থিতিতে।

এটা কোনো অস্বাভাবিক দৃশ্য নয়। স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক কূটনীতি এমনভাবে চলছে, যেখানে একটি শক্তিশালী দেশ রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থনৈতিক চাপ বা শর্তযুক্ত সাহায্যের মাধ্যমে কোনো সংঘাত সমাধান করে। এর চারপাশে একটা ব্যবস্থা গড়ে ওঠে মানবাধিকার সংগঠন, থিংকট্যাংক, মধ্যস্থতাকারী এবং পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দ্বারা-যাদের পশ্চিমা দেশগুলো অনেক সময় অর্থ দেয়, যারা এ ধারণা জোরদার করে যে, ওয়াশিংটনে একটা ফোন কলই যে কোনো সংকটের সমাধান করতে পারে। গাজায় যুদ্ধবিরতি দেখায় যে, ‘মাস্টার-কি’ এখনো তালা খুলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব ব্যবহার করেছে। সাহায্য ও পুনর্গঠনের কাজ সমন্বয় করতে মার্কিন সামরিক বাহিনী একটি সামরিক-বেসামরিক সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করেছে। বিভিন্ন দেশ এই ত্রুটিপূর্ণ চুক্তিকে একটি সাফল্য হিসাবে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এই ‘মাস্টার-কি’ কেবল দুই বছরের সম্পূর্ণ ধ্বংসের পরেই ব্যবহার করা হয়েছে, ব্যাপক মানবিক কূটনীতি সত্ত্বেও, এবং এমন একটি পদ্ধতিতে যা অবৈধ দখলদারত্বকে শক্তিশালী করে। প্রকৃতপক্ষে এটি কূটনীতির নৈতিক দেউলিয়াত্বকেই প্রকাশ করে।

আমরা এমন একটা সময়ের মধ্যে বাস করছি, যাকে আন্তোনিও গ্রামসি ত্রিশের দশকে ফ্যাসিবাদীদের দ্বারা কারাবন্দি অবস্থায় লিখেছিলেন, একটা অন্তর্বর্তী অবস্থা; যখন ‘পুরোনো বিশ্ব মরছে আর নতুন বিশ্ব জন্ম নিতে সংগ্রাম করছে।’ সেই শূন্যতার মাঝে পুনরুত্থিত ফ্যাসিবাদ এবং জাতিগত জাতীয়তাবাদের ‘রোগাক্রান্ত লক্ষণগুলো’ উদ্ভূত হয়।

তাহলে কী থাকে যখন একটি পরাশক্তি তালা খুলতে অস্বীকার করে? এটি এমন এক বিশ্ব যা আর একমেরুকেন্দ্রিক নয় বরং বহুমেরুকেন্দ্রিক এবং তা বিশৃঙ্খল। একক উদ্দেশ্যসাধনের শক্তির যুগ ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং ২০ শতকের জন্য তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলো পুরোনো মানচিত্রে আটকে আছে। যখন পশ্চিমা শক্তি অন্তর্মুখী হয়, তখন তাদের বৈধতা হয় সংকটের মুখোমুখি।

জাতিসংঘ এই পরিবর্তনশীল দৃশ্যপটে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালিয়েছে। এই পরিবর্তন জাতিসংঘকে উদীয়মান শক্তির সঙ্গে সারিবদ্ধ হয়ে, আঞ্চলিক অংশীদারত্বকে আলিঙ্গন করে এবং আন্তর্জাতিক আইনের ন্যায্য প্রয়োগকে সমর্থন করে তার বৈধতা নবায়ন করার একটি বিরল সুযোগ দিয়েছে। যদি এটি খাপ খায়, তাহলে এটি পুরোনো শৃঙ্খলা এবং নতুনের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করতে পারবে। যদি না করে, তাহলে এর মৃত্যু ঘটবে।

এই পরিবর্তনের মাঝে অর্থপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন শক্তিকেন্দ্র উঠে আসছে। দোহায় একটি মধ্যস্থতা হাব গড়ে উঠেছে। কাতার তার অনন্য রাজনৈতিক অবস্থান এবং কূটনৈতিক দক্ষতা ব্যবহার করে সেখানে আলোচনায় মধ্যস্থতা করেছে। বিভিন্ন বিভাজনের মধ্যে থাকা অংশীদারদের সঙ্গে তার খোলা চ্যানেল দোহাকে বিশ্বব্যাপী সংঘাত সমাধান আনয়নের একটি অপরিহার্য কেন্দ্র বানিয়ে তুলেছে, এমনকি তার সমালোচকদের কাছেও। আন্তর্জাতিক আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলা এবং হেগ গ্রুপ দেখায় কীভাবে বৈধতা পরিবর্তিত হচ্ছে-একটি পরিবর্তন যা একটি গণহত্যার ধ্বংসস্তূপের মধ্যে গড়ে উঠেছে। এর থেকে রাজনৈতিক প্রভাবের একটি নতুন রূপ উঠে আসতে পারে, যা ব্যাপকতর জোট এবং আধিপত্য ও অধিগ্রহণের পরিবর্তে জবাবদিহিতার ওপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে তৈরি হবে। দোহা ফোরামের থিম যেমন বলে, এটা হলো ‘প্রতিশ্রুতি থেকে অগ্রগতির দিকে’ যাওয়ার আহ্বান, যা ন্যায্যতার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তবে যখন দেশগুলো এ মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ভোট দিয়ে গাজার জন্য মার্কিন পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছে, তখন এই উদীয়মান ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। আলোচনার সঙ্গে পরিচিত কূটনীতিকদের মতে, দেশগুলো আমেরিকার চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে, যা প্রমাণ করে, অর্থনৈতিক স্বার্থ এখনো পুনরুজ্জীবিত উপনিবেশবিরোধী আন্দোলনকে ছাড়িয়ে যায়। এটা মনে করিয়ে দেয় যে, বহুমেরুতা ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা নয়; এটা প্রভাবের পুনর্বণ্টন মাত্র। এমন হওয়া জরুরি নয়।

গ্লোবাল সাউথ একটি ভূরাজনৈতিক ব্লক হতে পারে, যেটা নিজের আলোচনার টেবিল তৈরি করে এবং নিজের শর্ত সেট করে। ব্রিকস কোয়ালিশন অফ ইকোনোমিকসের (ব্রাজিল, রাশিয়া ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) ক্রমবর্ধমান আত্মবিশ্বাস এবং কিছু লাতিন আমেরিকার দেশের সরকারের কূটনৈতিক স্বাধীনতা ইতোমধ্যেই এই সম্ভাবনা দেখিয়েছে। এটা উপেক্ষা করা মানে ভবিষ্যৎকে উপেক্ষা করা। গত আগস্টে অনুষ্ঠিত ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে সদস্য রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে পশ্চিমা রাজধানীগুলোর দীর্ঘকালীন প্রভাব চ্যালেঞ্জ করে একটি বহুমেরুকেন্দ্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য আবারও চেষ্টা চালিয়েছে।

কূটনীতি, তা রাষ্ট্র, বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান, বা যারা তাদের সমর্থন করে তাদের দ্বারা পরিচালিত হোক না কেন, তাদের ‘মাস্টার-কি’-এর লজিক ছাড়িয়ে এগোতে হবে। এর জন্য দরকার মতাদর্শগত সততা এবং বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে একটি কৌশল। এর মানে হলো, আধুনিক সংঘাতের অসমতা মোকাবিলা করা, সম্পূর্ণ আন্দোলনকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ আখ্যায়িত করার প্রবণতাকে প্রত্যাখ্যান করা এবং বিভিন্ন ক্ষমতা কাঠামোর বৈধতাকে স্বীকার করা। বাস্তবসম্মত ফলাফলের জন্য বহুমুখী আলোচনা এবং যারা আসলে ক্ষমতা ধারণ করে-আঞ্চলিক জোট, সশস্ত্র গোষ্ঠী, নাগরিক-তাদের সঙ্গে বিজড়িত হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন।

যারা একটিমাত্র অশিষ্ট চাবি ধরে রাখছে, তারা পেছনে পড়ে যাবে। ফিলিস্তিনিরা, এবং যারা একমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার অধীনে কষ্ট পেয়েছে-তারা তাদের অভাব বোধ করবে না। শান্তি প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যৎ তাদের হাতে, যাদের কাছে অনেক চাবি আছে এবং যারা জানে কোন দরজা কখন খুলতে হয়। ‘মাস্টার-কি’র যুগ শেষ হয়ে আসছে।

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তরিত

জোনাথান হুইটল : ২০২২-২০২৫ মেয়াদে ফিলিস্তিনে জাতিসংঘ কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালনকারী দক্ষিণ আফ্রিকার

মানবাধিকার কর্মী

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম