Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

আজাদুর রহমানের কবিতার পথ

Icon

উম্মে সায়মা

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আজাদুর রহমানের কবিতার পথ

মানুষের পৃথিবী বিভাজনের মানচিত্র, যেখানে জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের অদৃশ্য কাঁটাতার-এ যেন এক আদিম অলাতচক্র, যেখানে মানবাত্মা নিরন্তর দগ্ধ হয়। এ বিভাজনদুষ্ট পৃথিবীতে কবিতা এক পরম উপশম। এ শুধু অক্ষরের বিন্যাস নয়, এ এক সেতু, যা ভেঙে যাওয়া মননকে জোড়া লাগায়; এমন এক আলোকবর্তিকা, যা বিভেদের ঊর্ধ্বে তুলে ধরে ভালোবাসার শাশ্বত সত্যকে। কবিতা তখন শুধু শিল্প নয়, হয়ে দাঁড়ায় এক নিরাময়, এক ঐকতান। কবি আজাদুর রহমানের কাব্যজগৎ সেই উপশমেরই রূপক। তার লেখনী শুধু শব্দ সাজানো নয়, বরং আত্মার গভীরে প্রোথিত স্মৃতির অন্বেষণ। প্রকৃতির নিসর্গ, বাউলতত্ত্বের গভীরতা আর মানুষের ভেতরের নদী-সবই তার কবিতায় একাকার হয়ে মিশে যায়। আত্ম-অন্বেষণের এ দীর্ঘ যাত্রায় তিনি শুধু নিজের মুখের দিকে তাকিয়েই খুঁজে নেন সৃষ্টির প্রেরণা। এ প্রেরণার নতুন নাম ‘পথটাকে সোজা করে ধরুন আমি হাঁটছি’।

আজাদুর রহমানের লেখনীতে যে আত্মসমর্পণ দেখা যায়, তা শুধু কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা নয়, বরং এক ধরনের জীবন-দর্শন। তিনি কবিতাকে দেখেন এক সহযাত্রী হিসাবে, যা জীবনের নিসর্গের সঙ্গে মিলেমিশে থাকে-যেমন নীল ব্যাকটেরিয়া আর সবুজ শৈবালের সহাবস্থান। আজাদুরের ভাষায়, ‘আত্মা আর কিছু নয়, শুধু স্মৃতি।’ মানুষের হাড়-মাংসের গঠন থেকে শুরু করে চুল-চামড়া পর্যন্ত সবকিছুই একরকম; যে জিনিস আলাদা সেটি হলো স্মৃতি। আর সেই স্মৃতিই তার কবিতার সারমর্ম।

কুষ্টিয়ায় থাকার সুবাদে তিনি বহু প্রবীণ বাউলের সংস্পর্শ পেয়েছেন। ইয়াকুব ফকিরের মুখে শোনা ‘পাঁচটা মানুষের মুখ দেখি, পাঁচটা জ্ঞান বাড়ে’-এ বাক্য আজও তার কণ্ঠে ফিরে ফিরে আসে। এ যেন মানুষের মুখপানে তাকিয়ে জ্ঞান বৃদ্ধির এক সহজ সূত্র। আজাদুর রহমান তাই মানুষ আর প্রকৃতিকে পড়েন গভীর মনোযোগে। আজাদুর রহমানের সৃষ্টিশীল জীবন অন্যদের থেকে আলাদা। তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের মতো হতে চান কি না, তিনি স্পষ্ট করে বলেন- না। ‘আমি কেবল আমার মুখের দিকে তাকিয়েই কবিতা লিখি।’ কারণ তিনি জানেন, ‘মৃত্যু ছাড়া বাদ বাকি সব মজ্জাশূন্য কথাবার্তা, দিন শেষে কোনো কিছুই আসলে তেমন কিছু না!’ এ অবস্থান তার লেখায় নিয়ে আসে এক ধরনের মুক্তি ও স্বতন্ত্রতা। তিনি কারও প্রতিমা গড়ে এগোতে চান না, বরং নিজের মুখের রেখা দেখে নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পান। এ আত্মবিশ্বাসী সুরই তাকে করে তুলেছে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী কবি।

বাউলদের সান্নিধ্য আজাদুরকে শিখিয়েছে-সংস্কার আর ধর্মাধর্মের বাইরেও আছে সত্য-মিথ্যার এক অদ্ভুত খেলা। তিনি দেখেছেন কীভাবে মানুষের বানানো বৃত্তের বাইরে গিয়ে সত্য ও মিথ্যা পরস্পরকে লুকিয়ে রাখে। তাই তার কবিতায় স্বপ্নের উপাদান আসে বাস্তবের ভেতর থেকেও। ‘স্বপ্ন’ কবিতায় তিনি লিখেছেন-

‘আপনি হয়তো স্বপ্নের ভেতরে জেগে আছেন,

আর চারপাশে যা কিছু ঘটছে তা সব আসলে বানানো গল্প...’

এ স্বপ্নময় নির্মাণে পাঠক কখনো কফিনের ওপরে রাখা নিঃসঙ্গ রজনীগন্ধার গন্ধ পান, কখনোবা নিজের হারিয়ে যাওয়া সত্তাকে খুঁজে পান সংসারের দৈনন্দিন ক্লান্তিক্লিষ্টতায়।

আজাদুর রহমানের কবিতায় বারবার আসে পাখি আর উড়াল। ‘মানুষ হয়ে জন্মালে ওড়া যায় না’-এই বেদনাটুকু তার সৃষ্টির মর্মে প্রোথিত। তিনি নিজেকে কখনো পাখির কাছাকাছি নিয়ে যান, কখনো গাছের ফাঁকে রেখে আসেন মানুষের ক্লান্তি। তার কবিতা ‘ভাঁটফুলের বন’ তাই কেবল এক কল্পনার দৃশ্য নয়, বরং আমাদের সবার অবচেতনের আঙিনা। এভাবেই তিনি মানুষ আর পাখির মাঝামাঝি এক সত্তা হয়ে ওঠেন-যে সত্তা না পারে ঠিকমতো হাঁটতে, না পারে উড়তে। এই সীমারেখার ভেতর থেকে তিনি খুঁজে নেন মুক্তির আভাস। আবার ‘বন্ধু’ কবিতায় অনাবিল মানবিক আকাঙ্ক্ষা, মৃত্যুর সঙ্গে রোমান্টিক আলাপচারিতা ফুটে ওঠে। এ কবিতার চিত্রকল্পে ধরা পড়ে জীবনের অস্থায়িত্ব আর মৃত্যুর প্রতি ধীরে ধীরে মেনে নেওয়া এক মানবিক স্বভাব। যেন বৃষ্টির মেঘ আর শীতের কুয়াশা মিলেমিশে তৈরি করছে সময়ের এক দীর্ঘ ধ্বনি।

আজাদুর রহমান মনে করেন-‘যে মুহূর্তে আপনি আপনার সামনে ভাড়াটে কাউকে আদর্শ/টার্গেট ঠিক করলেন, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে আপনি নিজের সঙ্গে প্রতারণা শুরু করলেন। আপনার কাজ হচ্ছে আপনি হয়ে ওঠা। আমার কাজ হচ্ছে আমি হয়ে ওঠা।’ এই আত্মবিশ্বাসই তার কবিতাকে করে তুলেছে জীবন্ত। তিনি অন্যের ছায়া অনুসরণ করেন না। তার ভরসা কেবল নিজের মুখ, নিজের অন্তরের নদী।

আজাদুর রহমানের কবিতায় নিঃসঙ্গতা থাকে, কিন্তু তা বিষণ্ন নয়; বরং তা এক গভীর আত্মদর্শনের আহ্বান। ‘নিঃসঙ্গ একটি লাইন’ কবিতায় তিনি বলেন-‘বড় জোর একটা লাইন লিখে দিতে পারি/ কাটা পড়া ট্রেনের মতো অকেজো, ক্লান্ত/ মর্মাহত একটা লাইন।’ এই একটিমাত্র লাইনের মধ্যে তিনি গুঁজে দেন জীবন-সংগ্রাম, ব্যর্থতা, ভালোবাসা আর মানুষের অন্তরের গোপন আর্তি। অফিস-সংসার-বাজারের যান্ত্রিকতায় যে মানুষ প্রতিদিন নিজেকে হারিয়ে ফেলেন, সেই মানুষও আজাদুরের কবিতায় নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান।

তিনি সময়কে খণ্ড খণ্ড করে গ্রহণ করেছেন। মানুষের মিথ্যা, সম্পর্কের ভাঙন-সবই তার কবিতার উপাদান। ‘মনের মাছেরা’ কবিতায় রাত, অন্ধকার আর অন্তর্জগতের ভ্রমণ এক অনন্ত নদীর স্রোতে রূপ নেয়। ‘আলো নিভিয়ে দিলেই ঘুম পাবে না/তুমি যে রকম ভাবছ/অন্ধকার সে রকম নয়’-লাইনগুলো যেন অন্ধকারেরও ভেতরে আলোর আভাস খুঁজে দেয়। এ কবিতায়ই আমরা দেখি-থিতিয়ে পড়া বালির মতো অন্ধকার ক্রমে ফুটিয়ে তোলে জোছনাভেজা এক পুকুর, যেখানে মানুষ হয়ে যায় মাছ, নদী হয়ে যায় অনন্ত, আর স্মৃতিহীন ভেসে যাওয়া মানুষ ভুলে যায় নিজের নাম, দেশ, ফেরার পথ।

আজাদুর রহমান মনে করেন-মৃত্যুর পর মানুষকে নিয়ে কে কী ভাবল, বলল সেটা অর্থহীন। তাই আনন্দই তার একমাত্র পুঁজি। তিনি লিখেছেন ‘পথটাকে সোজা করে ধরুন আমি হাঁটছি’ নিজের তাগিদে, নিজের আনন্দে। আজাদুর রহমান নিজেকে কখনো রবীন্দ্রনাথ বা লালনের জায়গায় বসাতে চাননি। তবু তার মধ্যে আছে সক্রেটিসের দার্শনিক দৃষ্টি, লালনের আধ্যাত্মিক সুর, বাউল সাধুর মুক্তি আর বাবার মানবিক স্নেহ। তিনি বলেন, ‘আমি যদি আবার জন্মাই তো এই আজাদুর রহমান হয়েই জন্মাব, ভাঙা ভাঙা কবিতা লিখব, গাঁইগুঁই করে জীবন কাটাব।’ এই উচ্চারণ কেবল একটি ব্যক্তিগত স্বপ্ন নয়; বরং প্রতিটি মানুষের জন্য এক অনুপ্রেরণা-তুমি যেমন, তেমন হয়েই থেকো, নিজের মুখে তাকাও, নিজের ভেতরকার নদীটাকে চিনে নাও। তবেই হয়তো আমরা অন্ধকারের ভেতর থেকেও খুঁজে পাব সেই নীলাভ-সবুজ শৈবাল, যে জীবনের প্রতিটি কণায় বহন করে আলো আর আত্মার স্মৃতি।

‘পথটাকে সোজা করে ধরুন আমি হাঁটছি’। প্রচ্ছদ : দেওয়ান আতিকুর রহমান। সৃজন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। মূল্য : ২৫০ টাকা।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম