বাংলা কবিতা পাঠের অনন্য সূচনা
শব্দায়ন- এ স্ট্যান্ডআপ পোয়েট্রি প্ল্যাটফর্ম
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯:২৫ পিএম
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
কবিতা মানবের মেধা, মনন, অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি প্রকাশের চিরন্তন মাধ্যম। এর মাধ্যমে মানুষ কখনো কখনো প্রাণ-প্রকৃতি-ব্রহ্মাণ্ডের সাথে একাত্ম অনুভব করে। একক মানুষের অন্তর্গত অনুভূতি যখন উচ্চারিত হয়, তখন তা ব্যক্তি থেকে সমষ্টির হয়ে ওঠে।
আদিকালে ব্যাধের ক্ৰৌঞ্চ শিকারের দৃশ্য দেখে বাল্মিকীর যে শোক জন্মেছিলো, সেটি ছিল কেবল ব্যক্তিগত। কিন্তু যখন তিনি উচ্চারণ করেন— “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ/ যৎ ক্ৰৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্”—তখন তা হয়ে ওঠে সর্বজনীন। উচ্চারিত শব্দের যে মোহনীয় শক্তি, তা সবাইকে আচ্ছন্ন করে, প্রভাবিত করে, আপ্লুত করে।
আদিকাল থেকেই বাংলার দর্শন, অর্থশাস্ত্র কিংবা জ্যোতিষশাস্ত্রে কবিতার প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন ছায়া রয়েছে। কখনো তা এসেছে গীতিকবিতায়, কখনো মঞ্চে উচ্চারণে, আবার কখনো মানুষের নিভৃত অনুভবে।
একান্তের অনুভূতিমালাকে সমষ্টির কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রয়াসেই ‘শব্দায়ন – এ স্ট্যান্ডআপ পোয়েট্রি প্ল্যাটফর্ম’ এর যাত্রা। তাই এটি নিছক কবিতা পাঠ নয়, বরং পারফরমের জন্য নতুন ও অভিনব এক প্ল্যাটফর্ম। তবে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এই মাধ্যম সম্পূর্ণ নতুনও নয়; চর্যাপদ থেকে খনার বচন, বৈষ্ণব পদাবলী থেকে পুঁথিপাঠ- সবখানেই পারফরমের চর্চা বিদ্যমান। সেই উত্তরাধিকারসূত্রকেই শব্দায়ন একার্থে নতুনভাবে ধারণ করেছে।
বাংলাদেশে কবিতা পাঠের দীর্ঘ পরম্পরা থাকলেও স্ট্যান্ডআপ পোয়েট্রির মাধ্যমে কবিতায় যুক্ত হবে নতুন মাত্রা। এখানে কবিতা হবে মূল কেন্দ্রবিন্দু, যার সাথে যুক্ত হবে আবহসঙ্গীত, নৃত্যসহ অন্যান্য শিল্পের উপাদান।
শব্দায়নের অন্যতম লক্ষ্য প্রতিষ্ঠিত এবং তরুণ কবি-লেখকেদের জন্য একটি মুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা- যেখানে তারা নিজেদের সৃষ্টি ও ক্ল্যাসিক সাহিত্য বৃহত্তর পরিসরে উপস্থাপন করতে পারবেন। প্রবীণ এবং নবীনের এই মেলবন্ধনই শব্দায়নের শক্তি, যেখানে কবিতা হবে ভাবের বিনিময় ও সৃজনশীলতার অনন্য মাধ্যম।
এরই ধারাবাহিকতায় ২৬ আগস্ট ঢাকার গোয়েথে-ইন্সটিটিউটে উদ্বোধন করা হয় প্ল্যাটফর্মটির। সেখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল ১৪ জন কবি ও আবৃত্তিশিল্পী বাংলাসহ মান্দি, ইংরেজি ও জার্মান ভাষায় কবিতা পরিবেশন করেন। এসব কবিতা পরবর্তীতে আয়োজক ও সহযোগিদের ওয়েবসাইট ও সামাজিক মাধ্যমে অডিও-ভিজ্যুয়াল কনটেন্ট হিসেবে প্রচার করা হবে।
উদ্বোধনী আয়োজনে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন দেশের প্রতিনিধিত্বশীল কবি, সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। অনুষ্ঠানের মূল আয়োজক ছিল অতঃপর শব্দায়ন; বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে গোয়েথে-ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ, পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল ইউসিএসআই ইউনিভার্সিটি এবং ব্র্যান্ডিং পার্টনার বিজ্ঞাপনী সংস্থা মাত্রা।
উদ্বোধন-পরবর্তী সময়ে এই উদ্যোগ দেশের আটটি বিভাগে পর্যায়ক্রমে আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি, দেশ-বিদেশে যারা নতুন আঙ্গিকে কবিতাপাঠ আয়োজন করতে চান তারাও নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে এই প্ল্যাটফর্মের আয়োজক হতে পারবেন। আয়োজকদের কবি ও কবিতা নির্বাচনে স্বাধীনতা থাকবে, তবে পাঠের প্রস্তুতি ও অডিও-ভিজ্যুয়াল প্রযোজনায় শব্দায়নের নির্দেশিকা অনুসরণ করতে হবে। এর ফলে তারা কনটেন্টগুলো অতঃপর শব্দায়নের ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচারের সুযোগ পাবেন।
২০১১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে সূচনা করা অতঃপর শব্দায়ন ২০১৯ সাল থেকে অডিও-ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে কবিতা ও শিল্পকেন্দ্রিক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তাদের কাছে স্ট্যান্ডআপ পোয়েট্রি প্ল্যাটফর্ম কেবল একটি আয়োজন নয়- এটি এক সাংস্কৃতিক আন্দোলন। কবিতা পাঠকে নতুন ধারায় উপস্থাপন করা এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে কবিতাপ্রেম জাগরুক করাই শব্দায়নের মূল লক্ষ্য।
