Logo
Logo
×

বিজ্ঞান

প্রাণীরা কি ভূমিকম্পের আগাম বার্তা দিতে সক্ষম? যা বলছে গবেষণা

খালিদ হাসান

খালিদ হাসান

প্রকাশ: ২৫ নভেম্বর ২০২৫, ০৪:৩৪ পিএম

প্রাণীরা কি ভূমিকম্পের আগাম বার্তা দিতে সক্ষম? যা বলছে গবেষণা

গ্রাফিক্স: চমং মারমা

প্রাণীরা ভূমিকম্প আগাম টের পায়— এ ধারণাটি বহুদিনের প্রচলিত বিশ্বাস হলেও এখনো এর পক্ষে স্পষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মেলেনি। তবুও নানা অভিজ্ঞতা, প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা ও সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা এই প্রশ্নকে আবার আলোচনার কেন্দ্রে ফিরিয়ে এনেছে—প্রাণীরা কি সত্যিই প্রাকৃতিক দুর্যোগ আগাম টের পায়?

দুর্যোগের ক্ষতি এড়ানো বন্যপ্রাণীর জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ টিকে থাকার কৌশল। তাই তারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য নির্দিষ্ট কিছু অভিযোজন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। কিছু গবেষণা ও নানা ধরনের অভিজ্ঞতালব্ধ ঘটনা থেকে ধারণা করা হয় যে প্রাণীদের একটি ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়’ আছে, যা তাদেরকে বিপদ আসার আগেই সতর্ক করে।

প্রাচীন গ্রিস থেকে বর্তমান পৃথিবী: গল্পের দীর্ঘ ইতিহাস

খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৩ সালে গ্রিসে বড় ভূমিকম্পের আগে ইঁদুর, বেজি, সাপ, কাঁকড়া ও বিছা তাদের গর্ত ও বাসস্থান ছেড়ে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে—এমন বর্ণনা ইতিহাসে রয়েছে। শত শত বছর ধরে এমন গল্প বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে আছে। সাম্প্রতিক সময়েও মাছ, পাখি, গৃহপালিত পশু থেকে শুরু করে বন্যপ্রাণীর অস্বাভাবিক নড়াচড়ার বহু গল্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্থানীয় অভিজ্ঞতায় উঠে এসেছে।

তবে এসব অভিজ্ঞতা যতই বিস্ময় জাগাক, বিজ্ঞানীরা সতর্ক—আখ্যান আর প্রমাণ এক জিনিস নয়।

বিজ্ঞান কী বলছে?

ভূমিকম্পে দুটি তরঙ্গ তৈরি হয়—ছোট ‘পি’-ওয়েভ এবং বড় ‘এস’-ওয়েভ। বৈজ্ঞানিকভাবে বহু গবেষণা দেখায়—প্রাণীরা ভূমিকম্প ঘটার কয়েক সেকেন্ড আগে ক্ষুদ্র ‘পি’-ওয়েভ অনুভব করতে পারে। দ্রুতগতির ‘পি’-ওয়েভ তরল, কঠিন ও গ্যাস—সবকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে পারে, যেখানে এস-ওয়েভ শুধু কঠিনের মধ্য দিয়ে যায় এবং যে ‘ধাক্কা’ মানুষ অনুভব করে তা মূলত ‘এস’-ওয়েভের প্রভাব।

ছবি: সংগৃহীত

খুব নগণ্য সংখ্যক মানুষও ‘পি’-ওয়েভ অনুভব করতে পারলেও বেশ কিছু প্রাণী ঘ্রাণ, স্পর্শ বা শ্রবণশক্তির মাধ্যমে এটি টের পেতে পারে বলে ধারণা করা হয়। তাই অনেক প্রাণী ভূমিকম্পের ঠিক আগে অস্থির হয়ে ওঠে। কিন্তু এটি কয়েক সেকেন্ড আগাম সতর্কতা মাত্র—ঘণ্টা কিংবা দিন নয়।

প্রথম গবেষণা শুরু করে চীনে

১৯৬৬ সালের ৮ মার্চ সকালে একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প চীনের শিনতাই শহরে (বেইজিং থেকে প্রায় ২২০ মাইল দক্ষিণে) আঘাত হানে। ভোরে ঘুমন্ত মানুষের ওপর বাড়িঘর ধসে পড়ে। এ ঘটনায় প্রায় ৮ হাজার মানুষ নিহত এবং ৩০ হাজারের বেশি আহত হয়। ১৯৪৯ সালের কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর জনবহুল এলাকায় এটিই ছিল প্রথম বড় ভূমিকম্প, তাই রাজনৈতিক নেতৃত্ব ঘটনাটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখে।

পরদিনই বিজ্ঞানীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে যান। ভূ-ভৌতবিদ, ভূতাত্ত্বিক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের গবেষকরা অনুসন্ধান শুরু করেন। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে গবেষকেরা মাঠপর্যায়ে সাক্ষাৎকার ও তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ সময় ভূমিকম্পের আগাম লক্ষণ নিয়ে অসংখ্য মানুষের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণের বহু বর্ণনাও সামনে আসে।

২৩ মার্চ আরেকটি বড় কম্পনের পর চীনা একাডেমি অব সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব বায়োফিজিক্সের গবেষকেরা শিনতাইয়ে পৌঁছে প্রাণীর অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তারা প্রায় দুই মাস ধরে আশপাশের বিভিন্ন কমিউন ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করেন।

১৯৬৬ সালের মে মাসে শিনতাইয়ে প্রথম প্রাণী-পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এর আগে প্রাণীদের আচরণবিষয়ক গবেষণা মূলত ঘটনার পর মানুষের স্মৃতিনির্ভর ছিল। নতুন কেন্দ্রটি নিয়মিত ও পদ্ধতিগতভাবে প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণের সুযোগ তৈরি করে। এখানে গবেষণা ও ভূমিকম্প পূর্বাভাস দুটোই চলত।

ছবি: সংগৃহীত

বেইজিংয়ের গবেষণাগার থেকে পিকিনিজ কুকুর, বানর, বড় সাদা মুরগি, ইঁদুর নিয়ে আসা হয়—সব মিলিয়ে কেন্দ্রটি একটি ছোট চিড়িয়াখানার মতো হয়ে ওঠে। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে বায়োফিজিক্স, জুলজি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত হয় ‘ভূমিকম্প জীববিজ্ঞান গবেষণা দল’। তারা শিনতাই অঞ্চলে আরও কয়েকটি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র তৈরি করে বিভিন্ন প্রাণীর ওপর গবেষণা চালান।

এরপর চীনা বিজ্ঞানীরা পরে ব্যাপক পরিমাণে পরিসংখ্যান, চার্ট, ডায়াগ্রাম, শতকরা হিসাব ইত্যাদি ব্যবহার করে তথ্যকে পরিমাণগত রূপ দেন। ক্লাস্টার বিশ্লেষণসহ বিভিন্ন পরিসংখ্যান পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রাণীর আচরণ নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়।

চীনা বিজ্ঞানীদের মতে, পতঙ্গ ও কীটপতঙ্গ খুবই কম সংখ্যক ক্ষেত্রে আচরণগত সংকেত দেখায়। মাছ তুলনামূলক বেশি প্রতিক্রিয়া দেখালেও তাদের আচরণ—যেমন সাঁতার বা লাফ—ব্যাখ্যা করা কঠিন।

ইতালিতে নজিরবিহীন গবেষণা

জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট অব অ্যানিম্যাল বিহেভিয়রের বিজ্ঞানী মার্টিন ভিকেলস্কি এই বিষয়ে ব্যতিক্রমী এক গবেষণা পরিচালনা করেন। ইতালির ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে তিনি ছয়টি গরু, পাঁচটি ভেড়া ও দুটি কুকুরের শরীরে বিশেষ সেন্সর স্থাপন করেন এবং কয়েক মাস ধরে তাদের আচরণ বিশ্লেষণ করেন।

ছবি: সংগৃহীত

ফলাফল বিস্ময়কর—ভূমিকম্পের প্রায় ২০ ঘণ্টা আগে প্রাণীগুলোর সক্রিয়তা স্পষ্টভাবে বেড়ে যায়। তারা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি নড়াচড়া করে, বিশেষত ৪৫ মিনিটের একটি নির্দিষ্ট সময়সীমায়। তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা ৪.০ মাত্রার ওপরে বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প সঠিকভাবে আগাম পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হন। আটটি বড় ভূমিকম্পের মধ্যে সাতটি সঠিকভাবে শনাক্ত হয়।

এই ফলাফল গবেষকদের নতুন প্রশ্নে নিয়ে যায়—প্রাণীদের কি সত্যিই এমন জিনগত প্রবণতা আছে যা তাদের ভূমিকম্পের আগাম ইঙ্গিত দেয়? বিবর্তনের ধারায় কি তারা এমন প্রবৃত্তি গড়ে তুলেছে, যা বিপদ এড়ানোর প্রাকৃতিক প্রবণতার অংশ হয়ে উঠেছে?

গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত, বিতর্ক থামেনি

তবে এ বিষয়ে বিজ্ঞানীদের নিজেদের মধ্যেই ঐকমত্য নেই। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী হুইট গিবন্স বলেন—মানুষের উচিত ভূমিকম্প শনাক্তকরণে বিজ্ঞানীদের সিসমিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার ওপর বিশ্বাস রাখা, প্রাণীর আচরণের নয়।

ছবি: সংগৃহীত

অন্যদিকে ১৮০টি বৈজ্ঞানিক প্রকাশনার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে ১৬০টি ভূমিকম্পের আগে প্রাণীদের ৭০০টির বেশি অস্বাভাবিক আচরণের নথি—যা একধরনের সম্পর্কের ইঙ্গিত দেয়। যদিও এখনো এটি নির্ভরযোগ্য পূর্বাভাস পদ্ধতি হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণীদের বেঁচে থাকার কৌশল

বিজ্ঞানীরা মনে করেন—বিপদ এড়ানো প্রাণীদের হাজার বছরের বিবর্তনধর্মী দক্ষতা। অগ্নিকাণ্ডের আগে পাখির হঠাৎ উড়ে যাওয়া, ঝড়ের আগে পোকামাকড়ের গর্তে ঢুকে পড়া বা সুনামির আগে বন্যপ্রাণীর উঁচু ভূমির দিকে ছুটে যাওয়া—এসব আচরণ প্রাকৃতিক প্রবৃত্তিরই অংশ।

প্রাণীরা হয়তো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সব ধরনের আগাম সংকেত পায় না, তবে পরিবেশের ক্ষুদ্রতম পরিবর্তন—বায়ুচাপ, কম্পন, শব্দ বা গন্ধ—মানুষের তুলনায় তারা অনেক দ্রুত শনাক্ত করতে পারে।

ছবি: সংগৃহীত

আগাম সতর্কতার ভবিষ্যৎ: প্রাণী কি হতে পারে ‘লাইভ অ্যালার্ম সিস্টেম’?

বিশ্বের নানা দেশে এখন প্রাণীদের ওপর সেন্সর লাগিয়ে রিয়েল-টাইম ডেটা সংগ্রহের প্রকল্প চলছে। কেউ কেউ ধারণা করছেন—প্রাণীর আচরণ পর্যবেক্ষণ একদিন ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থার অংশ হতে পারে। আবার অনেকে সতর্ক করছেন—এটি এখনো প্রমাণিত বিজ্ঞান নয়, তাই শুধুমাত্র প্রাণীর আচরণের ওপর নির্ভর করা বিপজ্জনক।

প্রাণীরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ পুরোপুরি পূর্বাভাস দিতে পারে—এমন দাবি এখনো যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক সমর্থন পায়নি। তবে প্রাণীদের অস্বাভাবিক আচরণ, বিবর্তনজনিত প্রবৃত্তি এবং সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো ইঙ্গিত দেয়—তাদের সংবেদনশীলতা মানবজাতির জন্য ভবিষ্যতে নতুন আলোচনার পথ খুলতে পারে। 

তথ্যসূত্র: সাইয়েন্স ডিরেক্ট, বিবিসি, টিআরটি ওয়ার্ল্ড

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম