Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

গল্প

আমাদের টোয়োটা সিয়েন্তা

Icon

যাকিয়া সুমি সেতু

প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আমাদের টোয়োটা সিয়েন্তা

সাজেক-বাংলাদেশের ছাদের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা এক স্বপ্নের গ্রাম। পাহাড়ের চূড়ায় সকাল মানেই মেঘের ভেলায় ভেসে থাকা। দূরে লুসাই পাহাড়ের ধূসর নীল রেখা, নিচে মাচাং ঘরের পাশে জুমচাষের লাল-সবুজ জমি। সারা রাত বৃষ্টি ঝরে গিয়ে ফেনিয়ে তুলেছে কাসালং নদীর স্রোত; পাহাড়ের বুক থেকে নামছে ঝরনাধারা, কংলাক ঝরনা, নাচ্যাই ঝরনা-যেন পাহাড়ের চোখের জল, আনন্দে নাকি বেদনায় ঝরছে বোঝা যায় না। নিচে রঙিন ছাতার মতো চা-স্টল আর ঢালে ঢালে শিমুল, পলাশ, নাম না জানা বুনো ফুল!

রূপক আর চুপকথা দাঁড়িয়ে আছে রিসোর্টের বাঁশের বারান্দায়। চারপাশে চাক, লুসাই, ত্রিপুরা গ্রামগুলো ঘুম থেকে জেগে উঠছে ধোঁয়া তুলতে তুলতে। চুপকথা কফির কাপে ধোঁয়া ভাসিয়ে বলে : ‘দেখো রূপক, এ মেঘগুলো যেন কাসালং নদীর স্রোত, ঢেউ হয়ে উলটোদিকে বয়ে যাচ্ছে আকাশে।’

রূপক হাসে চুপকথার কাজলভরা চোখে চোখ রেখে : ‘তুমি সবকিছুকেই নদী বানিয়ে ফেলো।’

চুপকথা লজ্জা পায়, রূপককে বলে : ‘দেখো নদীই আমাদের জন্মভূমির প্রবাহিকা। সাজেকে নদী না থাকলেও এ ঝরনাগুলো নদীরই সন্তান।’ রূপক আবারও হাসে, এরই মধ্যে দুজনেরই চোখ পড়ে রিসোর্টের নিচে, যেখানে ঢাল বেয়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে ইমন আর ইনানি। ইমনের হাতে ছোট্ট কাঠের নৌকা, স্থানীয় এক ত্রিপুরা কারিগর বানিয়েছে। ইনানি কুড়িয়ে নিচ্ছে বুনো ফুল, লাল, বেগুনি, অর্কিড।

ইনানি ছুটে এসেই বাবার কোলে বসে। ওর ব্যাগ থেকে ফুল বের করে দেয় মাকে। ‘মা, এ ফুলগুলো যেন মেঘের গায়ে লাগানো রং, তাইনা?’

চুপকথা মেয়ের লাল হয়ে যাওয়া মুখটি মুছে দিয়ে বলে : ‘এগুলো তোমার মতো, মিষ্টি।’

রূপক মেয়েকে আদর করে, বলে : ‘আমার পরি মেয়েটা, চলো ভাইয়াকে নিয়ে আসি।’

ইমন বাবার গলা জড়িয়ে বলে : ‘আমি এই তো! বাবা, আমরা যদি নিজের গাড়ি পেতাম, তাহলে আবার সাজেকে আসতাম ঝরনার গান শুনতে, তাই না মা?’ রূপক, চুপকথা হাসে আর ভাবে-এ স্বপ্ন তারা পূরণ করবে, সততার ছায়ায়। সততার সঙ্গেই এত বছর ধরে চলছে রূপক আর চুপকথা। অথচ যদি অসৎ জীবনযাপন করত, তাহলে আদরের ছেলের স্বপ্ন আজই পূরণ করত। রূপক-সরকারি কর্মকর্তা। সৎ এবং ভালো মানুষ। সরকারি চাকরির পথে কত প্রলোভন! কিন্তু রূপক সেসব থেকে নিজেকে দূরে রেখেছে। লিগ্যাল ওয়েতে মানুষের উপকার করেছে যতটা সম্ভব।

অফিসের কলিগরা যখনই রূপককে প্রলুব্ধ করে ঘুস নিতে, তখন রূপক বলে : ‘আল্লাহর ঘরে সব প্রমাণ সঞ্চিত।’

রূপকের বিশ্বাস-যে হৃদয়ে পরকালের ভয় নেই, সে হৃদয়ই দুর্নীতির বিষে কলুষিত। আর পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র তো সেই ব্যক্তি, যে ঘুস খায়, মানুষের সম্পদ ক্ষমতায় দখল করে, যার চাহিদা কোনোদিন মেটে না। অথচ মানুষের জন্য বরাদ্দ মাত্র সাড়ে তিন হাত জমি।

রূপক বিয়ে করেছে একটি আদর্শ সৎ পরিবারে। চুপকথার বাবাও একজন সৎ মানুষ-বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কন্ট্রোলার অব অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফিন্যান্স পদ থেকে অবসরে নিয়েছেন সততার সঙ্গে। তার নির্লোভ নিরহংকার জীবনের উত্তরাধিকার একমাত্র কন্যা চুপকথা। বাবার সততার আলো আর বিদুষী মা’র নিয়মতান্ত্রিক মুসলিম জীবনবোধ যেন চুপকথার রক্তে প্রবাহিত। চুপকথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ও পিএইচডি করে এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছে। তার পাঠদান যেন নদীর ধারা-শান্ত, প্রবহমান, কিন্তু গভীর। ক্লাসের প্রতিটি মুহূর্ত শিক্ষার্থীদের অন্তরকে ভাসিয়ে দেয় সততা, দায়িত্ব ও মানবিকতায়। রূপকের এত বছর পরও মনে আছে, ওদের বিয়ের মাত্র তিন দিন পর এক সন্ধ্যায় চুপকথা রূপককে বলেছিল-‘আমি তোমাকে পরকাল পর্যন্ত ভালোবাসি।’ রূপকের চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিল : ‘এই দুনিয়ায় তুমি আমার জন্য, আমার খুশির জন্য যত অন্যায় করবে, আমার সুখের জন্য যত ঘুস খাবে, তার বিনিময়ে তুমি পরকালে কঠিন শাস্তি পাবে। কিন্তু তোমার শাস্তি হোক, আমি চাই না।’

রূপক, চুপকথার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। চুপকথা বলে : ‘আমার কোনো চাহিদা নেই। শুধু প্রতিশ্রুতি দাও, জীবনে কখনো হারাম খাবে না, ঘুস নেবে না। এতে আমরা হয়তো সবার মতো বিলাসী জীবন পাব না, কিন্তু অন্তত সৎ থাকব, এটাই আমাদের অহংকার।’

সেই মুহূর্তেই রূপকের মনে হয়েছিল, এ নারী কেবল তার স্ত্রী নয়, সে তার সত্যিকারের জীবনসাথি। এরপর রূপকের হাত ধরে চুপকথা, রূপকের কত অফিসিয়াল প্রোগ্রামে গিয়েছে-প্রসাদঘেরা বাড়ি, ঝলমলে হোটেল, আলো-আঁধারির রাজকীয় ভোজসভা। সেখানে রূপকের ব্যাচমেটের স্ত্রী থেকে শুরু করে আরও সিনিয়র ভাবিরা বারবার চুপকথাকে সাবধান করেছে-‘এই দেশে সততার জায়গা নেই।’ রূপকথার শুনে মনে হতো, তাদের কথায় এক অদৃশ্য ভয়, এক আত্মসমর্পণের স্বর। কিন্তু চুপপকথার মুখে ফুটে উঠত এক নির্ভীক আলোর হাসি-যেন রাতের আকাশে ঝলসে ওঠা বজ্রালোকে সত্যের ঘোষণা। সে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলত-‘আপনারা খেয়ে যতটা এগিয়ে যাবেন, আমরা এ পথে না গিয়েও কোনো অংশে পিছিয়ে থাকব না, ইনশাআল্লাহ।’

রূপককে ম্যানেজ করতে না পেরে কত অফিসার, কতজন ছুটে এসেছে বাসায়। কেউ গাড়ি নিয়ে এসেছে, কেউ নতুন বাড়ি উপহারের দলিল, কেউ ঝলমলে মোবাইল আর সোনাদানা, হীরের অলংকারের পসরা সাজিয়েছে। কিন্তু চুপকথা সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছে। অনেকেই অপমানিত হয়ে ফিরে গেছে, আবার কেউ কেউ চুপকথার দৃঢ়তার কাছে মাথা নত করেছে।

রূপকের পরিবার থেকেও প্রতিনিয়ত রয়েছে প্রবল চাপ এবং একরাশ বিরক্তি-‘সবাই নিচ্ছে, তোমরা কেন পেছনে থাকবে? ভবিষ্যতের কথা ভেবে, একটুখানি আপস করো। তোমরা যা করছ সামনের দিনগুলোতে তোমাদের জন্য দুঃসহ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।’

কিন্তু চুপকথার নির্লোভ চেতনা আর নির্মল ভালোবাসা রূপককে সে পথে হাঁটতে দেইনি কখনো। চুপকথা তার মা-বাবার কাছ থেকেই শিখেছে-ঘুস, হারাম উপার্জন মানে শুধু অর্থ না, বরং মাথা নত করে বিবেককে বিক্রি করে দেওয়া এবং নিজকে ছোট করা। সবচেয়ে বড় কথা, মহান আল্লাহর দেওয়া রিজিক থেকে ভরসা হারানো। রূপক সব সময় ভাবে, একজন স্ত্রী যদি সত্যিকারের আদর্শ মানুষ হয়, তাহলে স্বামীর হৃদয়ও মজবুত হয়ে ওঠে; সে তখন পরিবারকে, এমনকি একটি প্রজন্মকেও হারাম থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। আর সেজন্যই রূপক সব ঝড়কে জয় করতে শিখেছে।

রূপক আর চুপকথা এ অসৎ সমাজের বিপরীতেই প্রতিনিয়তই যুদ্ধ করে যাচ্ছে-তারা জানে, অসৎ আর হারাম উপার্জনের বিশাল অর্থ সম্পদ কখনোই সম্মান বয়ে আনে না; বরং সত্যিকারের মর্যাদা মানুষ অর্জন করে সততা, নৈতিকতা আর আত্মসম্মানের আলোয়।

সাজেকের মেঘের মনোলোভা প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ শেষে রূপকের পরিবার ঢাকায় ফিরে আসে। পাহাড়ি ঝরনার মতো বাচ্চাদের আনন্দ আর চুপকথার উচ্ছ্বাস মেখে রূপক পরম তৃপ্তি নিয়ে অফিস শুরু করে। এরই মধ্যে একটি অফিসিয়াল অর্ডার রূপককে অভিভূত করে তোলে।

যথারীতি কাজ শেষ করে রূপক অফিস থেকে ফিরল এক রহস্যময় উজ্জ্বলতা ভরা মুখ নিয়ে; যেন সাজেকের ভোরের কুয়াশা ভেদ করা সোনালি রোদ তার হাসির ভাঁজে গোপনে আশ্রয় নিয়েছে। স্টাডিরুমে চুপকথাকে জড়িয়ে ধরে বলে : জানো চুপকথা আজ সরকারি অর্ডার হয়েছে-সব ডিএসদের গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ করে টাকা দেবে!’

চুপকথার চোখে খুশির জল উপচে পড়ে। অনেক দিনের স্বপ্ন আর উত্তেজনায় দুজনেই বিহবল হয়ে পড়ে। শেষমেশ সেই প্রতীক্ষিত মাহেন্দ্রক্ষণ এসে যায়-সবাই মিলে বের হলো গাড়ি কিনতে। শোরুমের কাচের দরজা পেরোতেই-চোখ ঝলসে দিল সারি সারি চকচকে গাড়ি, মাথার ওপরে ঝুলে থাকা আলো যেন তারার মালা হয়ে ঝলমল করছে। মালিক জাফর আহমেদ এগিয়ে এলেন, খুব দ্রুত কথা বলেন কালাসং নদীর মতো। এক এক করে তুলে ধরলেন বিখ্যাত গাড়ির নাম-প্রতিটি যেন আলাদা এক জগৎ :

‘দেখুন স্যার, এখানে নিসান এক্স-ট্রেইল, আধুনিক ডিজাইন আর শক্তিশালী ইঞ্জিনের জন্য খুব জনপ্রিয়। আর এই যে হোন্ডা সিআর-ভি, পরিবারের জন্য প্রশ্বস্ত আর আরামদায়ক। শেষটায় দেখুন-এ টোয়োটা সিয়েন্তা কমপ্যাক্ট, স্নিগ্ধ, অথচ ভেতরে যেন এক ছোট্ট প্রাসাদ।’

চারজনের দৃষ্টি ধীরে ধীরে এসে থামল একটি গাড়ির দিকে-ঝরঝরে স্নিগ্ধতায় ভেজা, পরিমিত রেখায় বোনা এক নীরব মোহ-টোয়োটা সিয়েন্তা। মনে হলো, এ যেন গাড়ি নয়, বরং এক স্বপ্ন, যা সাজেকের প্রভাতের কুয়াশা পেরিয়ে আরও দূরের বন হাওয়ায় ছুটে নিয়ে যাবে।

গাঢ় নীল মডেলের দিকে তাকিয়ে চুপকথা ফিসফিস করে বলে : ‘রূপক, এই রঙটা যেন বর্ষার দিনে পাহাড়ে ভেসে থাকা নীল মেঘের ছায়া।’ সেই মুহূর্তেই সব ঠিক হয়ে গেল। তারা কিনবে টোয়োটা সিয়েন্তা, দাম-১৯ লাখ টাকা। সরকারি বাজেটের ৩০ লাখ টাকার চেয়েও অনেক কম। ততক্ষণে শোরুমের ভেতর সব আলো জ্বলে উঠেছে, ঝলমলে মায়াবী আলো-টেবিলের ওপর রাখা কাগজপত্রে কলমের ছোঁয়া পড়তে যাচ্ছে ঠিক, তখনই জাফর আহমেদ এর কণ্ঠে নেমে এলো এক অদ্ভুত সুর : ‘আমি ত্রিশ লাখ লিখে দিচ্ছি স্যার, বাকি ১১ লাখ টাকা আপনারা রেখে দিন-আপনারা চাইলে এ টাকায় কোনো বিজনেস করতে পারবেন অথবা ব্যাংকে ডাবল স্কিমেও রেখে দিতে পারবেন। সরকারি বাজেট, সবাই এভাবেই নেয়।’

কথাটা শুনেই চুপকথা আর রূপকের মন বেদনায় ভরে ওঠে-চোখের ভেতরে জমাট বাঁধে নীল ছায়া, যেন দূরে সাজেকের বর্ষা-আকাশ গাঢ় হয়ে আসছে। চুপকথা বলে ওঠে : আপনি এসব কী বলছেন? আমরা অসৎভাবে কখনো টাকা নেইনি। জানেন তো প্রতিটি অন্যায় ফেরেশতারা দেখে, হিসাব লিখে রাখে। মহান আল্লাহ কঠিন শাস্তি দেবেন। আর আমরাও কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আত্মার ক্ষতি আছে।’

জাফর আহমেদ চমকে উঠেন : ‘আত্মার ক্ষতি?’

রূপকের কণ্ঠে বর্ষার নদীর গর্জন: ‘হ্যাঁ, নদী যদি নিজের উৎস ভুলে যায়, সে শুকিয়ে মরে যায়। মানুষও তেমনি-সততা হারালে ভালো আত্মা মরে যায়। আজ পর্যন্ত আমার হাতে এক টাকাও ঘুস লাগেনি, জীবনে কখনো হারাম খাইনি-আজ কেন কালো স্রোত বইতে দেব নিজের ভেতরে!’

জাফর আহমেদ আশ্চর্য হয়ে যায় : ‘কেন এতে ক্ষতি তো নেই স্যার, সবাই-ই তো দেখি এসব করছে। আমার এই হাতে কতজনকেই তো কতভাবে লিখে দিয়েছি।’

রূপক বিচলিত হয়ে বলে : ‘দেখুন দুনিয়ার লাভের জন্য আখেরাত নষ্ট করব না। আজ পর্যন্ত এক টাকাও ঘুস খাইনি, আজ কেন মিথ্যা লিখে নেব? আল্লাহকে তো আর ফাঁকি দিতে পারব না।’ চুপকথা বলে : ‘এমনও তো হতে পারে, এ অন্যায় টাকার কারণে গাড়িতেই বড় দুর্ঘটনা হলো এবং কারও জীবন চলে গেল, তখন কী হবে? আমরা আল্লাহর নেয়ামতের ওপর সন্তুষ্ট, শোকর।’

জাফর আহমেদ নিশ্বাস ফেললেন। তার চোখে দেখা দিল বিস্ময়, লজ্জা, আর এক অদ্ভুত বিনয় এবং কৌতূহল-যেন সে প্রথমবার দেখল, কীভাবে কেউ সত্যকে বুকে নিয়ে দাঁড়ায়; হৃদয়ের দরজা গড়া যেন কষ্টি পাথরে-যেখানে ঘুস, মিথ্যা, দুর্নীতি, হারাম কখনো ঢুকতে পারবে না। সেই মুহূর্তে, ঘরের বাতাসে এক নীরব সত্য ভাসতে লাগল। জাফর আহমেদ অনুভব করে : ‘সবাই হয়তো ধনী হতে পারে, কিন্তু সৎ মানুষ সবাই না।’

১৯ লাখ টাকার রিসিটটি রূপকের হাতে দিয়ে জাফর আহমেদ বলে : ‘সৎ মানুষের গল্প বইয়ে পড়েছি, জীবনে এই প্রথম দেখলাম। দোয়া করবেন, মৃত্যুর আগে অন্তত আপনাদের মতো না হলেও কাছাকাছি ইমান নিয়ে যেন মরতে পারি।’

তারপর রূপক পরিবার বুকভরা উচ্ছলতায় গাড়ি নিয়ে আসে। পথে টোয়োটা সিয়েন্তা যেন ছুটে চলছে কাসালং নদীর পাড়ের স্মৃতি বুকে নিয়ে। পরদিনই রূপক অজস্র খুশি নিয়ে অফিসে উপস্থিত হলেন, গাড়ি কেনার বেচে যাওয়া ১১ লাখ টাকা নিয়ে। কিন্তু এ সততার পদক্ষেপে উঠল ধূলি ছোঁয়া ঝড়-বস এবং সিনিয়রদের চোখে যেন এক অচেনা অদ্ভুত ঘটনা, সবাই নদীর বাঁধ হয়ে দাঁড়াল। একজন কোর্সমেট বলল : ‘তুমি বোকা নাকি রূপক? এত টাকা ফেরত দেয় কেউ? রেখে দাও, কে দেখছে? সরকার তো দেখবে শুধু ভাউচার।’ রূপক উত্তর দিল : ‘তাতে কী, আল্লাহ তো দেখছেন! তা ছাড়া সরকারি অর্ডারে তো লেখা ছিল, যদি গাড়ি কেনার পর টাকা বাঁচলে সরকারি ফান্ডে জমা দিতে।’

‘তোমাকে কে বলেছে গাড়ির টাকা ফেরত আনতে?’ একজন সিনিয়র প্রশ্ন করলেন। আরেকজন সিনিয়র বললেন : ‘তোমার জন্য আমরা তো ধরা খাব। তুমি চাইলে টাকাটা রেখে দিতে পারতে-এত সৎ হওয়ার দরকার কী তোমার?’

রূপকের চোখে তখন অদৃশ্য নদীর নীল গভীরতা-শান্ত, স্থির, কিন্তু অটল, বলল : ‘এই টাকা রাখতে হলে গাড়ির শোরুমের মালিককে দিয়েও তো আমাকে মিথ্যা টাকার রিসিট লেখাতে হতো। আমি তো আজ পর্যন্ত কোনো দুর্নীতি করিনি, হারাম পথে যাইনি, ঘুস খাইনি।’

একটু থেমে আবার রূপক শুরু করে : ‘এই ১১ লাখ টাকার জন্য আমার এত বছরের সততার বিসর্জন দিয়ে কী লাভ! তা ছাড়া সন্তানদের জীবনও ঝুঁকিতে পড়তে পারে, তারা অমানুষের মতো বেড়ে উঠতে পারে। তখন আমার কী হবে?’

বস শত বিরক্তি নিয়ে বলে : ‘ভাবি মানে তোমার বউ জানে তোমার এই কীর্তির কথা?’ রূপকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে : ‘জানে স্যার। ওর তো সম্পূর্ণ নিষেধ। ও বলেছে যত কষ্ট আসুক, এমনকি গাছতলায় থাকতে হলেও সে আমার পাশে থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।’

অপর একজন সিনিয়র বললেন : ‘তোমার বউ যখন এমন, তাহলে টাকা দিয়ে আর কী করবে? আমাদের বউ তো টাকা ছাড়া কিছুই বোঝে না, অনন্ত চাহিদা। তাই ইচ্ছে না থাকলেও অনেক সময় বউকে খুশি করতে বাধ্য হয়েই করি।’

বস শান্ত, কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলে : ‘তোমাকে বুঝিয়ে বলেও তো কোনো লাভ নেই। শোন এভাবে টাকা ফেরত দেওয়া যায় না। পে-অর্ডার করে দাও।’ পরদিন যথাযথভাবে পে-অর্ডারের মাধ্যমে টাকা ফেরত দেয়। সারা অফিসে এ নিয়ে মহাহইচই পড়ে গেল।

পরের সপ্তাহেই সচিব আর মন্ত্রীর তলব। রূপকের বুক ঘুমন্ত নদীর মতো কাঁপছে-ভয়, উৎকণ্ঠায়। সবিনয়ে মন্ত্রীর রুমে ঢুকতেই সচিব এবং মন্ত্রীর চোখ জোড়া নিবিষ্ট হয়ে ওঠে রূপকের দিকে। সচিব হাসিমুখে বলে : ‘এই যে স্যার আমাদের রূপক। ওর কথাই বলছিলাম।’

মন্ত্রী রূপকের দিকে এগিয়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে : ‘এত সৎ অফিসার আমার ডিপার্টমেন্টে আছে, জানতাম না তো! আপনার সচিব স্যার আপনার সততার অনেক গল্পই আমাকে বলেছেন।’

রূপককে আরও অভয় দিয়ে সস্নেহে হেসে বলেন : ‘আপনাকে দেখার জন্যই ডেকেছি। আমি অনেক খুশি। আপনি ডিপার্টমেন্টের সম্পদ, বাংলাদেশের গর্ব।’ মন্ত্রীর আর সচিবের কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে রূপক গাড়িতে উঠে এসে বসে। বুকের ভেতরটা আজ পরম আনন্দে আকাশ হয়ে গেছে। অকপটেই চোখের কোণে ভেসে উঠল স্ত্রী চুপকথার মুখটি-নরম আলোয় ভেজা, নদীর জলের মতো স্বচ্ছ। রূপক ভাবে, যদি প্রতিটি ঘরে চুপকথার মতো স্ত্রী থাকত, তাহলে আর ঘুস খেয়ে নিজের পাপের বোঝা অযথা ভারী করত না কেউ, দুর্নীতি করত না, হারাম পথে যেত না; বাংলাদেশ হতো সত্যিকারের একটি আদর্শ দেশ। আর এ দেশের প্রতিটি সন্তান হতো আলোর নদী-তাদের বুকের সেই আলোতে জ্বলজ্বল করত সততার সূর্য; অটল, অবিনাশী, অমোঘ, অনিবার্য...

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম