Logo
Logo
×

দ্বিতীয় সংস্করণ

বিটিসিএল’র এসটিএন প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি

কাজ পাচ্ছে নকল সনদধারী অখ্যাত কোম্পানি

সাইফ আহমাদ

সাইফ আহমাদ

প্রকাশ: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কাজ পাচ্ছে নকল সনদধারী অখ্যাত কোম্পানি

দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে নকল সনদের প্রমাণ মিললেও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) কাজ পাচ্ছে একটি অখ্যাত কোম্পানি। শুধু তাই নয়, কারিগরি সক্ষমতা না থাকা জিনিউ টেকনোলজিস লিমিটেড নামের এ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে দ্বিতীয় দরপত্রে কমানো হয়েছে প্রযুক্তিগত শর্ত। এক্ষেত্রে আইসিএক্সের সক্ষমতা ৫০ হাজার থেকে কমিয়ে ৩২ হাজার ট্রাঙ্ক করার সুপারিশ করেছেন প্রকল্প পরিচালক। এমন অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে সুইচিং ও ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এসটিএন) প্রকল্পে। এতে কানেক্টিভিটি শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য চরমভাবে ব্যাহত হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য, আলোচ্য কোম্পানিটির অনিয়ম ধরা পড়ায় প্রথম দরপত্র বাতিল করা হয়েছিল।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্পের টেন্ডার প্রক্রিয়া এককভাবে আমার সিদ্ধান্তে হয় না। এজন্য বিটিসিএলে একাধিক ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক মূল্যায়ন, কারিগরি মূল্যায়ন, আর্থিক তুলনা ও বোর্ডের অনুমোদন দরকার হয়। পাশাপাশি সাত সদস্যের কমিটি সবকিছু যাচাই-বাছাই করে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত দেয়।’ এদিকে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর যুগান্তরকে বলেন, ‘আইসিএক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর বদলে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে দরপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত কিছুটা অবাস্তব। বাজারে ভয়েস ও ডেটার চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এই অবস্থায় সক্ষমতা কমালে প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে পারে। ক্যাপাসিটি কম থাকলে চাহিদা মিটবে না। কলড্রপ, নেটওয়ার্ক জ্যাম ও গ্রাহক ভোগান্তিও বাড়তে পারে। দীর্ঘমেয়াদে এটি বিটিসিএলের জন্য রাজস্ব ক্ষতির কারণ হবে এবং ডিজিটাল কানেক্টিভিটি শক্তিশালী করার লক্ষ্যকে ব্যর্থ করে দিতে পারে।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রাহকসেবার মান উন্নয়ন, রাজস্ব বৃদ্ধি ও কলড্রপ কমাতে এসটিএন প্রকল্প হাতে নেয় বিটিসিএল। এ বছর ২১ এপ্রিল প্রকল্পের প্রথম দরপত্রে অংশ নেয় দুই চীনা প্রতিষ্ঠান। শর্ত ছিল ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জের (আইসিএক্স) ন্যূনতম সক্ষমতা ৫০ হাজার এসআইপি ট্রাঙ্ক। সে অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সরবরাহের দরপত্র জমা দেয় প্রতিষ্ঠানগুলো। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য সচিব হিসাবে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নিজেই সব কারিগরি প্রস্তাব ও তথ্য যাচাই-বাছাই করে মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমা দেন। সেই প্রতিবেদন চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য বিটিসিএলের পরিচালনা পরিষদ সভায় উপস্থিত করা হলে ওই পরিষদ সন্দেহ প্রকাশ করে। পরে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তৎকালীন যুগ্মসচিব (পরিচালনা পরিষদের সদস্য) শেখ সালেহ আহমেদকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি অধিকতর যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে। যাচাই-বাছাই কমিটির তদন্তে উঠে আসে, দরপত্রে অংশ নেওয়া প্রতিষ্ঠান জিনিউ টেকনোলজিস লিমিটেডের জমা দেওয়া অভিজ্ঞতা সনদ জাল। এমনকি ৫০ হাজার এসআইপি ট্রাঙ্ক সক্ষমতা প্রমাণেও ব্যর্থ হয় তারা। এই অনিয়মের কারণে টেন্ডারটি বাতিল করে পুনরায় ২৯ জুলাই দ্বিতীয় দফায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। আবারও দরপত্রে অংশ নেয় জিনিউ। এবার পিডি নিজ উদ্যোগে গত ১৩ আগস্ট কারিগরি বিনির্দেশ কমিটির আহ্বায়কের কাছে চিঠি পাঠান। সেখানে তিনি আইসিএক্সের ন্যূনতম সক্ষমতা ৫০ হাজার থেকে কমিয়ে ৩২ হাজার ৫০০ এসআইপি ট্রাঙ্ক করার সুপারিশ করেন। উদ্দেশ্য জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া প্রতিষ্ঠানটির দরপত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বিশেষ সুবিধা দিতে এ ধরনের সুপারিশের অর্থ হচ্ছে চলমান দরপত্র প্রক্রিয়ায় এক প্রকার অনৈতিক হস্তক্ষেপ। আরও বিস্ময়কর বিষয়, প্রকল্প পরিচালক মূল্যায়ন কমিটিকে প্রভাবিত করে তাদের অনুকূলে প্রতিবেদন দাখিল করান। এমনকি আগের যাচাই-বাছাই কমিটির প্রতিবেদন নথি থেকে গায়েব করা হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। বিটিসিএলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্প পরিচালক ইচ্ছাকৃতভাবে আগের কমিটির প্রতিবেদন সরিয়ে দিয়েছেন। এটি সুস্পষ্টভাবে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার লঙ্ঘন।’

এদিকে এসটিএন প্রকল্পের সর্বশেষ দরপত্র প্রক্রিয়ায় ন্যূনতম প্রযুক্তিগত সক্ষমতা কমিয়ে আনা হলেও জিনিউ আগের তুলনায় দাম কমায়নি। বরং তাদের সর্বশেষ প্রস্তাব প্রাথমিক দরপত্রের তুলনায় প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা বেশি দিয়ে দরপত্র জমা দেয়। প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের অভিমত-সাধারণত সক্ষমতা বা প্রযুক্তিগত শর্ত কমিয়ে দেওয়া হলে প্রকল্পের খরচও কমে আসার কথা। কিন্তু এসটিএন প্রকল্পে উলটো খরচ বেড়ে যাওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে কার স্বার্থে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। এই বাড়তি প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে জিনিউকে সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ফলে পুরো দরপত্র প্রক্রিয়া শুধু নয়, প্রকল্পের স্বচ্ছতা ও আর্থিক স্বার্থ নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের তৎকালীন যুগ্মসচিব (প্রথম দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সদস্য) শেখ সালেহ আহমেদ বলেন, ‘আমরা যাচাই-বাছাই কমিটি ডকুমেন্ট খতিয়ে দেখেছি। জিনিউ টেকনোলজিস লিমিটেডের নথিগুলো জাল বলে প্রতীয়মান হয়। যেখানে নিজস্ব ডোমেইন থেকে মেইল করার কথা, সেখানে তারা জিমেইল ব্যবহার করেছে। আমরা অনুসন্ধানে কোনো আপস করিনি। সবকিছু বিবেচনা করেই পুনরায় টেন্ডার করার সুপারিশ করেছিলাম।’

সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত পাবলিক প্রকিউরমেন্ট অ্যাক্ট (পিপিএ) অনুচ্ছেদ ৬৪ ও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস (পিপিআর)-এর অনুচ্ছেদ ১২৭ অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড করলে কিংবা জালিয়াতির আশ্রয় নিলে ক্রয় প্রস্তাব বাতিল ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার কথা রয়েছে।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘জাল সনদধারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক। এতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নষ্ট হচ্ছে, জাতীয় স্বার্থও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের দরপত্র বাতিল হওয়ার কথা। কিন্তু যদি দেখা যায় অনিয়মকারীরাই বারবার সুবিধা পাচ্ছে, তাহলে বোঝা যায় দুর্নীতি কত গভীরে প্রোথিত। অনিয়মকারীদের সুবিধা দুর্নীতিরই প্রমাণ। তিনি বলেন, এ অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

জানা গেছে ক্রয় প্রস্তাব বাতিল কিংবা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে বরং তড়িঘড়ি করে মূল্যায়ন কমিটিকে প্রভাবিত করে জিনিউের অনুকূলে আবারও প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। একই সঙ্গে ১১ সেপ্টেম্বর পরিচালনা পরিষদের সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব করা হয়। পরিচালনা পরিষদ আবারও সন্দেহ প্রকাশ করায় দ্বিতীয় দফায় তিন সদস্যবিশিষ্ট যাচাই-বাছাই কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সদস্য বিটিসিএল-এর পরিচালক ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যুগ্মসচিব (প্রশাসন) মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটি মাত্র মিটিং করেছি এখন পর্যন্ত। কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি। তবে যে প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আগেও জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল। নিয়ম অনুযায়ী এ ধরনের কোনো অনিয়ম ধরা পড়লে সংশ্লিষ্ট দরপত্রটি বাতিল হওয়ার কথা। এমনকি জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় আনার বিধানও আছে। সেই বিষয়টিও আমাদের পর্যবেক্ষণে রয়েছে। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি যাচাই করেছি। তবে বোর্ড এখনো সেই কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেওয়ার অনুমোদন দেয়নি।’

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম