Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় পাতে ফিরছে দেশি মাছ

১১ বছরে ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ

Icon

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় পাতে ফিরছে দেশি মাছ

মাছে-ভাতে বাঙালি। এক টুকরো মাছ পাতে না পড়লে বাঙালির খাওয়াই যেন সম্পন্ন হয় না। আর এ চাহিদা পূরণ হতো দেশীয় প্রজাতির মাছ দিয়ে। কিন্তু নানা কারণে দেশীয় অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হওয়া বিদেশি মাছের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। তবে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত চেষ্টায় বাঙালির পাতে আবার ফিরতে শুরু করেছে দেশীয় প্রজাতির মাছ। বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ২৪ প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন। বিলুপ্তপ্রায় সব প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। প্রজনন ও সংরক্ষণ করে বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করে দেশীয় জাতের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। লাইভ জিন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশীয় সব প্রজাতির মাছ সংরক্ষণের কার্যক্রম চলছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট সূত্রে জানা যায়, গত এক যুগে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন প্রায় ৪ গুণ বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেন, দেশীয় মাছ বাঙালির প্রকৃত স্বাদ মেটাতে পারে। মাছে-ভাতে বাঙালি মানেই, একই সময় দেশি মাছে ভরা ছিল দেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশীয় মাছ ফিরিয়ে আনতে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণার মাধ্যমে দেশীয় মাছ ফিরিয়ে আনছেন। আমরা বিলুপ্তপ্রায় শতভাগ মাছ ফিরিয়ে আনব। দেশের নদী-নালা, পুকুর-খাল, বিলসহ সর্বত্র জলাশয়ে দেশীয় মাছ ছিটিয়ে দিয়ে দেশীয় মাছের বিল্পব ঘটাব।

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, বাংলাদেশে মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ৬৪ প্রজাতির মাছ বিলুপ্তপ্রায়। বিলুপ্তপ্রায় জাতগুলো বাছাই করে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সেই জাতগুলোর পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। ময়মনসিংহে প্রধান কার্যালয় ছাড়াও বগুড়ার সান্তাহার, নীলফামারীর সৈয়দপুর, যশোরসহ বিভিন্ন স্থানে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণে কাজ চলছে।

মৎস্য ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বিলুপ্তপ্রায় মাছের মধ্যে বর্তমানে পাবদা, গুলশা, গুজি আইড়, রাজপুঁটি, চিতল, মেনি, টেংরা, ভাগনা, খলিশা, কালীবাউশ, কই, বাটা, ফলি, বালাচাটা, শিং, মহাশোল, গুতুম, মাগুর, বৈড়ালি, কুঁচিয়া, গজার, সরপুঁটি ও গনিয়াসহ প্রায় ২৪ প্রজাতির মাছের অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। এসব মাছ বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে। যদিও ক্রেতারা বলছেন, দেশীয় মাছ ফিরে এলেও পূর্বের সেই স্বাদ নেই। দামও অনেক বেশি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, এ মাছের স্বাদ কম নয়। বরং আগের তুলনায় বেশি স্বাদ। আকারেও বড়।

মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জানান, ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় প্রজাতির মাছ ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় সব কার্যক্রম চলছে। দেশীয় মাছের জিন সংরক্ষণ, প্রজননের কৌশল উদ্ভাবন এবং চাষাবাদ পদ্ধতির কারণে সফলতা এসেছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে দেশীয় মাছের পোনা বিতরণ করছি। চাষীরাও এগিয়ে আসছেন। স্বাদ ও দাম ভালো হওয়ায় চাষীরা সম্মিলিতভাবে মাছ চাষ করছেন। তিনি বলেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশে ৯২৬টি হ্যাচারি রয়েছে।

যেখানে মাছ ও চিংড়ির রেণু উৎপাদন করা হয়। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে বছরে মোট রেণু উৎপাদনের পরিমাণ ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৫৪ কেজি। এর মধ্যে শুধু ময়মনসিংহ অঞ্চলে ২০০ কোটি পাবদা ও গুলশা মাছের পোনা উৎপাদিত হচ্ছে।

জানা যায়, দেশে মোট উৎপাদনের মাত্র ১৬ শতাংশ (৬ লাখ ৪০ হাজার টন) হচ্ছে সামুদ্রিক মাছ। বাকি ৩৭ লাখ ৪৪ হাজার টন অর্থাৎ ৮৪ শতাংশ মিঠা পানির মাছ। মৎস্য উৎপাদনে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ছোট মাছ দিয়ে। ২০০৯ সালে পুকুরে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার ৩৪০ টন- যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৪১ লাখ টনে উন্নীত হয়। অর্থাৎ ১১ বছরে দেশীয় ছোট মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। উৎপাদন আরও বাড়াতে ৫ সেপ্টেম্বর লাইভ জিন ব্যাংক উদ্বোধন করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী।

বিপন্ন প্রজাতির টেংরার কৃত্রিম প্রজনন দারুণ ভাবে সফলতা পেয়েছে। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার্থে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইন্সটিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, সৈয়দপুরে এর কৃত্রিম প্রজনন, পোনা প্রতিপালন এবং চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফলে মাঠপর্যায়ে এর চাষাবাদ শুরু হয়েছে ব্যাপকভাবে। বৈরালি মাছের জিন পুল সংরক্ষণেও সফলতা এসেছে।

এছাড়া বালাচাটা মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন হয়েছে। বালাচাটা মাছ অঞ্চলভেদে মুখরোচ, পাহাড়ি গুতুম, গঙ্গা সাগর, ঘর পইয়া, পুইয়া, বাঘা, বাঘা গুতুম, তেলকুপি ইত্যাদি নামে পরিচিত। পাহাড়ি ঝর্ণা ও অগভীর স্বচ্ছ জলাশয় এদের বেশি প্রিয়। প্রজাতিটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে ২০১৯ সালে দেশে প্রথমবারের মতো এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ কৌশল উদ্ভাবন করা হয়। গুতুম মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা এসেছে। এছাড়া খলিশা মাছের পোনা উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়ছে। সুস্বাদু খলিশা মাছের পোনা প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে ২০১৬ সাল হতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট, স্বাদুপানি উপকেন্দ্র সৈয়দপুর হতে গবেষণা পরিচালনা করে ২০১৮ সালে মাছটির কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদন কলাকৌশল উদ্ভাবনে সাফল্য লাভ করে। আনুপাতে ছোট্ট এ খলিশা মাছের ডিম ধারণ ক্ষমতা ৫ হাজার থেকে ১৪ হাজার পর্যন্ত। জাইত পুঁটি মাছের পোনা উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা এসেছে। ইন্সটিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্রে ২০২০ সালে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে এ পুঁটি মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হয়। গজার মাছের পোনা উৎপাদনেও সফলতা এসেছে।

মাছ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম