Logo
Logo
×

ইসলাম ও জীবন

দারাসবাড়ি মসজিদ

Icon

কাউসার লাবীব

প্রকাশ: ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দারাসবাড়ি মসজিদ

সত্তর দশকের কথা। সবে দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীন দেশের সোনাফলা মাটিতে চাষ করতে গেলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক কৃষক।

লাঙল দাবাতেই ইটের মতো শক্ত কী যেন লাগল। খুঁড়ে দেখলেন আবির রং-এর ইট। এক ইট। দুই ইট। তিন ইট। ইটের সঙ্গে ইট। চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপালে। কী হতে পারে? ফিরে এসে পাড়ার মানুষকে জানালেন। এককান দু’কান করে খবর পেল স্থানীয় প্রশাসন।

খোঁড়া হলো মাটি। বেরিয়ে এলো ‘দারাসবাড়ি মসজিদ’। বাংলার প্রথম যুগের মুসলিম স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন। আবারও প্রমাণিত হলো, বাংলার প্রতিটি ভাঁজে মিশে আছে কুরআনি আবেশ। ইসলামের ঘ্রাণ। নির্মল আলোর ছোঁয়া।’

মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল খ্রিষ্টাব্দ চতুর্দশ শতাব্দীতে। বাংলার আদি রাজধানী গৌড়ের ফিরোজপুরে। তখনকার শাসক সুলতান শামস উদ্দীন ইউসুফ শাহের আদেশে এটি নির্মাণ হয়। তখন এর নাম ছিল ফিরোজপুর মসজিদ। পঞ্চদশ শতাব্দীতে ওই এলাকার শাসক নিযুক্ত হন সুলতান হোসেন শাহ।

মসজিদের অদূরে দারাসবাড়ি নির্মাণ করেন। আরবি দরস অর্থ পাঠ। তাই তৎকালীন শিক্ষাঙ্গনকে বলা হতো দারসবাড়ি বা দারাসবাড়ি। দারাসবাড়ির সুনাম, সুখ্যাতিতে এলাকার নামও পাল্টে যায়। হয় দারাসবাড়ি। এর সঙ্গে পাল্টে যায় মসজিদের নামও। পরিচিত হয় ‘দারাসবাড়ি মসজিদ’ নামে।

সমকালীন স্থাপত্যের বিচারে এর আয়োতন বেশ বড়ই বলা যায়। দৈর্ঘ্যে ৯৯ ফুট ৫ ইঞ্চি। প্রস্থে ৩৪ ফুট ৯ ইঞ্চি। সঙ্গে যুক্ত ১০ ফুট সাত ইঞ্চির অনন্য এক বারান্দা। পশ্চিমে কারুকার্য খচিত ৯টি মেহরাব। উত্তর, দক্ষিণে ৩টি করে জানালা।

নির্মাণশৈলী প্রমাণ করে এতে মহিলাদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থাও ছিল। কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে ছাদ। পূর্ণিমা রাতে চাঁদের আলোয়ে ভেতরটা ঝলমল করে। চারপাশের দেওয়ালও জৌলুস হারিয়ে অস্তিত্ব নিয়ে কোনোরকম টিকে আছে।

এ মসজিদটি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষে চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবস্থিত। কবিতার নদী মহানন্দার তীর ধরে কয়েক কিলোমিটার ভেতরে। মসজিদের পাশে দিঘি। দিঘির এপারে মসজিদ। ওপারে মাদ্রাসা। এক সময় এ মসজিদের মিনার থেকে মোয়াজ্জিনের সুমধুর আজান ভেসে আসত।

আকুল হতো মুমিনের প্রাণ। রবের ডাকে ছুটে আসত প্রাণের মসজিদে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে যেত আমির, ফকির। ভুলে যেত ভেদাভেদ। পাপের গ্লানি মুছতে লুটিয়ে পড়ত প্রভুর পায়ে। জপন করত ‘সুবহানা রাব্বিআল আলা’।

দিঘির ওপারের মাদ্রাসা ছিল মুকুলে ভরা। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সন্তানরা এসে প্রাণ জুড়াত। ইমানি রং-এ রঙিন হতো। খুঁজে পেত স্রষ্টাপ্রেম। ধর্মের প্রতি ভালোবাসার টান। বিনিসুতার আবেগ। তাদের ওজুতে তরঙ্গায়িত হতো দিঘির সবুজ পানি।

অবুঝ হাতে তুলে নিত পবিত্র কুরআন। ভোরের আলোর মিষ্টি ছোঁয়ায় ভেসে আসত মধুর আওয়াজ ‘ফাবিআয়্যি আলা-ই রব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।’

আজ এর সবই অতীত। অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে ছাদহীন দারাসবাড়ি মসজিদ। এখন আর বাজে না আজানের সুর। ভেসে আসে না কুরআনের ধ্বনি। শেষ রাতে কেউ আর বলে ওঠে না, ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম।’ কালের আবর্তে এক সময়ের সজিব দুটি মুসলিম স্থাপত্য আজ অস্তিত্ব রক্ষার আকুতি করছে।

আমরা আশা নিয়েই বাঁচি। আশার মালা গাঁথি। আশা রাখি মহানন্দার অপরূপ সৌন্দর্যে আবারও যোগ হবে দারাসবাড়ির আজানের ধ্বনি। উচ্চারিত হবে, ‘হাইয়া আলাস সালাহ’। এ শুনে কেউ হয়তো বলে উঠবে, ‘কে ওই শোনাল মোরে আজানের ধ্বনি। মর্মে মর্মে সেই সুর, বাজিল কি সুমধুর, আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনি। কি মধুর আজানের ধ্বনি!

লেখক : আলেম, প্রাবন্ধিক

 

দারাসবাড়ি মসজিদ

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম