Logo
Logo
×

সুরঞ্জনা

বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদাতা বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনে প্রেরণা জুগিয়েছেন, শক্তি আর সাহসের উৎস ছিলেন বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব। বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের ৯১তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি। লিখেছেন-

Icon

সেলিনা হোসেন

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২১, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বঙ্গবন্ধুর প্রেরণাদাতা বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা

ফাইল ছবি

ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় নারী তার জ্ঞান দিয়ে পরিচর্যা করেছে সমাজকে। এগিয়েছে সমাজের স্রোত। আজকে এ ধারাবাহিকতায় এবং তার ৯১তম জন্মদিনে স্মরণ করি একজন অসাধারণ প্রজ্ঞার মানুষ বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবকে। তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একজন সাহসী নারী। দুর্বার সাহসে ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে দিয়েছিলেন দূরদর্শী চিন্তার বার্তা। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ ফেলার সাহসী বার্তা তাকে ইতিহাসের মানুষ করেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, জেন্ডার সমতার ইতিহাসে তিনি আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের মানুষ। ব্যক্তিজীবন থেকে রাজনৈতিক জ্ঞানের জায়গায় তিনি জেন্ডার সমতার বলয় তৈরি করেছিলেন স্বামী জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে দাঁড়িয়ে। দু’জনের পরিশীলিত জীবনের নানা সূত্রে কোথাও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যের জায়গা তৈরি হয়নি। বাংলার জনজীবনে এ এক দিগন্ত বিথারি উদ্ভাসন। জেন্ডার সমতার আলোয় ঝরেছে টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির প্রাঙ্গণে অজস্র শিউলি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি রচনা করেন জেলখানায় রাজবন্দি থাকার সময়। তিনি এ বইয়ের প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনে স্ত্রী ফজিলাতুননেছার কথা লিখেছেন : ‘আমার সহধর্মিণী একদিন জেলগেটে বসে বলল, বসেই তো আছ, লেখ তোমার জীবনের কাহিনি।’ একই পৃষ্ঠার এ অংশ শেষ করেছেন এভাবে : ‘আমার স্ত্রী যার ডাকনাম রেণু-আমাকে কয়েকটা খাতাও কিনে জেলগেটে জমা দিয়ে গিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ যথারীতি পরীক্ষা করে খাতা কয়টা আমাকে দিয়েছেন। রেণু আরও একদিন জেলগেটে বসে আমাকে অনুরোধ করেছিল। তাই আজ লিখতে শুরু করলাম।’

জেন্ডার সমতার সূত্র থেকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এখানে পারিবারিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে দেশ-জাতির জন্য সময়ের ইতিহাস রচনা দু’জনেই গভীরভাবে ভেবেছেন। রাজনীতির কারণে কারাবন্দি স্বামীকে অনুপ্রেরণা দিয়ে উৎসাহিত করেছেন সময়ের ছবি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য ধরে রাখতে। সম্পর্কের এ গভীর বোঝাপড়া জেন্ডার সমতার অনন্য উদাহরণ।

বঙ্গবন্ধু পুরুষতন্ত্রের আধিপত্যের চিন্তা থেকে রেণুকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি আড়াল করতে পারতেন। কিন্তু করেননি। পারিবারিক জীবনের সমতা অনায়াস সত্যে তুলে ধরেছেন। বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেণুর কথা বলেছেন, সহযোগিতার সূত্র ধরে। লেখাপড়ার সময় কলকাতায় থাকাকালে খরচের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন : ‘আব্বা ছাড়াও মায়ের কাছ থেকেও আমি টাকা নিতে পারতাম। আর সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত, বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই, নিজে মোটেই খরচ করত না। গ্রামের বাড়িতে থাকত, আমার জন্যই রাখত।’

আর এক জায়গায় নিজের অসুস্থতার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন : ‘আমার জ্বর ভয়ানকভাবে বেড়ে গেছে। ... রেণু কয়েকদিন আমাকে খুব সেবা করল। যদিও আমাদের বিবাহ হয়েছে ছোটবেলায়। ১৯৪২ সালে আমাদের ফুলশয্যা হয়। জ্বর একটু ভালো হলো। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী।’ স্বামীর আধিপত্যের জায়গা থেকে এ পরিবারের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রিত হয়নি। দুজনেই বোধ ও চেতনার জায়গা থেকে একজন খনা, একজন মদনমোহন তর্কালঙ্কায় হয়ে উঠেছেন ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে। ব্যক্তি সম্পর্কের ঊর্ধ্বে রাজনীতির প্রসঙ্গটিও বঙ্গমাতা নিজের জ্ঞানে স্রোতের সমান্তরালে রেখেছিলেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার স্মৃতিচারণে বলেছেন : ‘আমার জীবনেও আমি দেখেছি যে, গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনোদিন আমার স্ত্রী বাধা দেয় নাই। এমনও দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনের ১০-১১ বছর আমি জেল খেটেছি। জীবনে কোনোদিন মুখ কালা কিংবা আমার ওপর প্রতিবাদ করেনি। তাহলে বোধহয় জীবনে অনেক বাধা আমার আসত। অনেক সময় আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গেছি আমি একআনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারিনি আমার ছেলেমেয়েদের কাছে। আমার সংগ্রামে তার দান যথেষ্ট রয়েছে।’

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ধানমণ্ডির ৩২নং বাড়িতে নেতাকর্মীদের ভিড়। প্রত্যেকেই সেদিনের ভাষণে কী বলা হবে তার নানা মতামত দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু দোতলায় উঠে এলে রেণু বললেন, অনেকে তো অনেক কথা বলেছেন, তুমি নিজে ঠিক কর তুমি কি বলবে। তোমার সামনে লাখ লাখ মানুষ লাঠি-বৈঠা নিয়ে বসে আছে। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রাইফেলের নল তোমার সামনে। তোমার নিজেকে ভেবে কথা বলতে হবে। তুমি পনেরো মিনিট শুয়ে থেকে চিন্তা কর। বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যাওয়ার আগে ১৫ মিনিট চুপচাপ শুয়েছিলেন। তারপর একটি অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন যেটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যিক দলিলে স্বীকৃত হয়েছে। অসাধারণ ভাষণটি বিশ্ব জয় করেছে।

ইতিহাসে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের ভূমিকা উল্লেখ না করলে ইতিহাসের সবটুকু সত্য বিবৃত করা হবে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিবের কথাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

বঙ্গবন্ধু প্রেরণাদা বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম