|
ফলো করুন |
|
|---|---|
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গৌরব মুক্তিযুদ্ধ, যা হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনায়। এই চেতনা বাঙালির রক্তে মিশে আছে। তাই ধর্মের ভিত্তিতে গড়া রাষ্ট্র পাকিস্তান টিকতে পেরেছিল মাত্র ২৩ বছর। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে একটি ধর্মরাষ্ট্র থেকে জন্ম হয়েছিল জাতিরাষ্ট্রের।
আমরা অনেকে ধর্ম আর জাতিকে গুলিয়ে ফেলি। যেমন আমি ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান, কিন্তু জাতি পরিচয়ে বাঙালি। ধর্মনিরপেক্ষতাকে অনেকে ধর্মহীনতা বলেন। কিন্তু ধর্মনিরেপক্ষতা হলো রাষ্ট্রে সব ধর্মের সমান অধিকার। একাত্তরে এই চেতনাতেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি অসাধারণ স্লোগান ছিল, যা অল্প কথায় আমাদের মূল চেতনাকে ধারণ করে-‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খ্রিষ্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান; আমরা সবাই বাঙালি’। এটাই আমাদের চেতনা। ধর্মের সঙ্গে জাতীয়তার কোনো বিরোধ নেই। ধর্মের সঙ্গে উৎসবের কোনো বিরোধ নেই।
মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের সংবিধানেও অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঠাঁই হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি। কিন্তু সামরিক শাসকরা বারবার নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে ধর্মকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেছে। তবে এদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ সব সময়ই এর প্রতিবাদ করেছে। কার কী ধর্ম, সেটা ভুলে আনন্দ-বেদনায় একে অন্যের পাশে থেকেছে। উৎসব-পার্বণ একসঙ্গে উদ্যাপন করেছে। একটি জনপ্রিয় স্লোগান আছে-‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’। এই স্লোগানটিই আমাদের মৌলিক চেতনাকে ধারণ করে। ছেলেবেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি, ঈদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতাটুকু মুসলমানদের, উৎসবটা সবার। পূজার ধর্মীয় আচারটুকু হিন্দুদের, উৎসবটুকু সবার। ঈদের সেমাই, পূজার নাড়ু সবার ঘরেই পৌঁছে যায়।
শারদীয় দুর্গোৎসব হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু প্রতিবারই দুর্গাপূজায় উৎসবের পাশাপাশি শঙ্কাও থেকে যায়। পূজা এলেই বাংলাদেশের নানা জায়গায় প্রতিমা ভাঙচুরের খবর আসে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তি নানাভাবে বাংলাদেশের সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। কখনো ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে, কখনো পবিত্র কুরআন অবমাননার ধুয়া তুলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সৃষ্টি করা হয়, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সংখ্যালঘুরা। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ সংখ্যাগুরুদের জন্য লজ্জার, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের জন্য গ্লানির। আসলে কোনো দেশের সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি, অত্যাচার-নির্যাতনের দায় সেদেশের সংখ্যাগুরুদেরই। ইসলাম ধর্মও সবার ধর্ম পালন নিশ্চিত করে।
বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার চিত্র দেখে অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ বুঝি তার মূল চেতনা থেকে সরে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সংখ্যায় অনেক অল্প। তারা অন্ধকারে লুকিয়ে থাকে। তারা গুজব ছড়িয়ে শান্তি নষ্ট করে। ধর্মীয় গোঁড়ামি তো আছেই, অনেকে সংখ্যালঘুদের জমি দখল করতে, কোণঠাসা করতেও পরিকল্পিতভাবে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তবে এ সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের রুখে দাঁড়ানোর চিত্র আমাদের আশাবাদী করে। মুসলমান তরুণরা পূজামণ্ডপ পাহারা দেয়। একই ক্যাম্পাসে মসজিদ ও মন্দিরের অবস্থান অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনাকেই বারবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরে।
দুর্গাপূজা হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব বটে। কিন্তু এ দেশে পূজা আয়োজনে মুসলমানদের অংশগ্রহণই বেশি। গত চার বছর ধরে কাওরান বাজার মিডিয়াপাড়ায় শারদীয় দুর্গোৎসবের আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে দেখেছি ডেকোরেটর, লাইটিং, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা আয়োজনে মুসলমানদের সম্পৃক্ততাই বেশি। পূজার আয়োজনে সহায়তায়ও হিন্দুদের চেয়ে মুসলমানরা এগিয়ে। এটাই আসলে বাংলাদেশ, এটাই সর্বজনীনতা।
অসাম্প্রদায়িকতা সব ধর্মেরই মূল কথা। কোনো ধর্মেই অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষের কথা নেই। সব ধর্মই পরমতসহিষ্ণুতা, পর ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শেখায়। কিছু সাম্প্রদায়িক অপশক্তি সংঘাত সৃষ্টি করে আসলে ইসলাম ধর্মেরই অবমাননা করে। ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশে কোনোদিন এই অপশক্তির ঠাঁই হবে না। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে এই অন্ধকারের শক্তি কোনোভাবেই আমাদের সম্প্রীতি নষ্ট করতে না পারে।
প্রভাষ আমিন : লেখক ও সাংবাদিক
