Logo
Logo
×

আনন্দ নগর

বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে ব্যক্তিগত আয়োজনের অভিযোগ

নিরাপত্তা ইস্যুতে বাতিল হচ্ছে কনসার্ট

শীতকাল হচ্ছে কনসার্ট মৌসুম। এ মৌসুমের শুরু থেকেই একাধিক কনসার্টের ঘোষণা আসে। যেখানে দেশের জনপ্রিয় শিল্পী ও ব্যান্ডের পাশাপাশি প্রধান আকর্ষণ হিসাবে পারফর্ম করার কথা বিদেশি শিল্পীদের। তালিকায় ছিলেন ভারত পাকিস্তানের জনপ্রিয় একাধিক শিল্পী। কিন্তু নিরাপত্তা ইস্যুতে প্রসাশনের অনুমতি না পাওয়ায় একে একে বাতিল হতে থাকে বিদেশি শিল্পীদের সব কনসার্ট। কিন্তু অবাক করা তথ্য হচ্ছে, এসব বিদেশি শিল্পী নিয়েই দেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ব্যক্তিগত সব কনসার্ট! বিস্তারিত রয়েছে এ প্রতিবেদনে।

Icon

রিয়েল তন্ময়

প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত বছর বেশ কিছু কনসার্ট হলেও, এ বছর তাতেও আসছে বাধা। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বলে কনসার্টের অনুমতি দিচ্ছে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। আয়োজক প্রতিষ্ঠান সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে, এমনকি টিকিট বিক্রি করা হয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত প্রশাসনিক অনুমতি না মেলায় হচ্ছে না কনসার্ট। এসব কনসার্টে বিদেশি শিল্পীদের পারফর্ম করার কথা থাকায় দেশের দর্শকদের মধ্যেও ছিল বাড়তি এক উত্তেজনা। ফলে বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠান পরিকল্পনার পর এসব আয়োজন বাতিল হওয়ায় একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আয়োজকরা, অন্যদিকে টিকিটের টাকা ফেরত না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়ছেন দর্শকরাও।

১৪ নভেম্বর ‘লেজেন্ডস লাইভ ইন ঢাকা’ শিরোনামে এক কনসার্টে ঢাকায় পারফর্ম করার কথা ছিল পাকিস্তানি সংগীতশিল্পী আলী আজমতের। আয়োজনে অংশ নিতে অনুষ্ঠানের তিন দিন আগেই ঢাকা এসে পৌঁছান এ শিল্পী। কিন্তু কনসার্টের দিন সকালে আয়োজক প্রতিষ্ঠান জানায়, স্থগিত করা হয়েছে আয়োজন। একই কনসার্টে গান করার কথা ছিল নগরবাউল জেমসেরও। ২৮ নভেম্বর স্টেইজ কো-এর আয়োজনে ‘সাউন্ড অব সোল’ শিরোনামের একটি কনসার্টে গান করার কথা ছিল পাকিস্তানের জনপ্রিয় ব্যান্ড জল’র। রাজধানীর ৩০০ ফুটের স্বদেশ অ্যারেনায় আয়োজিত এ কনসার্টও স্থগিত করা হয়। এতে আরও পারফর্ম করার কথা ছিল দেশের দুই ব্যান্ড ওয়ারফেজ ও লেভেল ফাইভের। নিরাপত্তাজনিত কারণে বাতিল করা হয় ভারতের সংগীতশিল্পী অনুভ জৈনের কনসার্টও। ১২ ডিসেম্বর ১০০ ফুটের কোর্টসাইড মাদানি অ্যাভিনিউতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল এ কনসার্ট। এর আগে ২৫ নভেম্বর আয়োজক প্রতিষ্ঠান হাইপনেশন এটি স্থগিত করে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ‘ওয়েভ ফেস্ট : ফিল দ্য উইন্টার’ শিরোনামের একটি কনসার্টে অংশ নিতে ঢাকায় আসে পাকিস্তানি ব্যান্ড কাভিশ। কিন্তু সব প্রস্তুতি থাকার পরও তারা আর মঞ্চে উঠতে পারেনি। আয়োজক প্রতিষ্ঠান প্রাইম ওয়েভ কমিউনিকেশনস জানায়, তাদের প্রস্তুতিতে কোনো ধরনের গাফিলতি ছিল না। প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইনফতার দানিয়াল বলেন, ‘কাভিশ ব্যান্ডের শিল্পীরা ঢাকায় পৌঁছেছেন, যে কোনো মূল্যে আমরা এ আয়োজন সফলভাবে সম্পন্ন করতে চেয়েছিলাম। বেশ কয়েকটি ধাপ পার করে অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন ছিল, ভেন্যু, শিল্পীদের পারিশ্রমিক, সবই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে অনুমতি না মেলার কারণ আমাদের জানা নেই।’ একই আয়োজনে গান করার কথা ছিল দেশের দুই ব্যান্ড শিরোনামহীন ও মেঘদল’র।

সর্বশেষ বাতিল হয়েছে পাকিস্তানের জনপ্রিয় শিল্পী আতিফ আসলামের কনসার্ট। ১৩ ডিসেম্বর অর্থাৎ আজ ঢাকায় গান করার কথা ছিল তার। অনুমতি থেকে সব প্রস্তুতি শেষের দিকে বলেও জানিয়েছিলেন আয়োজকরা। তবে শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তাজনিত কারণে ছাড়পত্র পায়নি প্রতিষ্ঠানটি। তাই বাতিল হয়েছে কনসার্টটি। এক ফেসবুক পোস্টে বিষয়টি নিজেই জানিয়েছেন আতিফ আসলাম। বাংলাদেশি ভক্তদের উদ্দেশে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি লিখেছেন, ‘প্রিয় বাংলাদেশি ভক্তরা, অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় নির্ধারিত কনসার্টে আমরা পারফর্ম করছি না। এর কারণ হলো, কনসার্টের আয়োজক ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় স্থানীয় অনুমতি, নিরাপত্তা ছাড়পত্র ও লজিস্টিকস (সরঞ্জাম/ব্যবস্থাপনা) বিষয়গুলো ঠিক করতে পারেননি।’ কনসার্টের আয়োজন করেছিল ‘মেইন স্টেইজ ইনক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সহ-আয়োজক হিসাবে ছিল ‘স্পিরিট অব জুলাই’। তবে কনসার্ট বাতিলের বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেননি আয়োজকরা। ১৩ ডিসেম্বর পূর্বাচলের চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে (সিবিএফসি) কনসার্টটি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, কনসার্টের মোট মুনাফার ৪০ শতাংশ অর্থ প্রদান করা হবে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে। এ অর্থ জুলাই আন্দোলনে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে দীর্ঘ মেয়াদে সহায়তায় ব্যয় করা হবে। আতিফ আসলাম ছাড়াও সংগীতপরিচালক ও প্রযোজক ফুয়াদ, নেমেসিস ব্যান্ডসহ দেশের আরও শিল্পীদের এ কনসার্টে পারফর্ম করার কথা ছিল।

কেন কনসার্টের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না? এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা অনুবিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আপাতত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কোনো কনসার্টের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। কয়েক দিনে ৫-৬টি আবেদন এসেছে, তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় দেড় মাস হলো এই অনুমোদন দেওয়া বন্ধ রয়েছে। তার আগে ১০-১২টি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে অভিযোগ উঠেছে কনসার্টের (স্থগিত হওয়া) জন্য ঢাকায় আসা এসব বিদেশি শিল্পীদের নিয়ে ‘ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান’ করা হয়েছে। ‘মেইন স্টেইজ ইনক’র স্বত্বাধিকারী নিশা সালাম গণমাধ্যমে বলেন, “সম্প্রতি যেসব কনসার্ট স্থগিত হয়েছে, সেসব আয়োজনের শিল্পীদের দিয়ে নির্দিষ্ট দিনের আগে বা পরে ‘প্রাইভেট অনুষ্ঠান’ করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের জন্য যেদিন আলী আজমতের কনসার্ট বাতিল করা হলো, তার ঠিক আগের দিনই ঢাকার বসুন্ধরা আইসিসিবিতে আলী আজমতের একটি প্রাইভেট কনসার্ট হয়েছে। জল’র কনসার্ট যেদিন স্থগিত হলো, তারাও কিন্তু দেশে এসে গুলশান ক্লাবে একটি প্রাইভেট কনসার্ট করেছে। এমনকি পাকিস্তানি গায়ক ফারহান সাঈদ চট্টগ্রামের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানেও গান গেয়ে গেছেন।” প্রশাসনের প্রতি প্রশ্ন রেখে এই আয়োজক বলেন, ‘তাহলে কি সরকার শুধু প্রভাবশালী ও ধনীদের জন্যই বিনোদনের ব্যবস্থা রাখছে, আর সাধারণ মানুষের কনসার্টগুলোকে নিরাপত্তার অজুহাতে একের পর এক বাতিল করে দিচ্ছে? অথচ আমরা কিন্তু নিয়ম মেনে ভ্যাট ও ট্যাক্স দিয়ে শিল্পীদের আনছি, তবু এ বৈষম্যের কারণ কি আমরা বুঝতে পাচ্ছি না?’

স্থগিত হওয়া কনসার্টে বিদেশি শিল্পীর পাশাপাশি দেশের শিল্পীদেরও পারফর্ম করার কথা ছিল। একের পর এক কনসার্ট স্থগিত ও ভেন্যু পরিবর্তনের ঘটনায় প্রশ্ন তুলছেন তারাও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিল্পী বলেন, ‘নিরাপত্তা ইস্যুতে যদি কনসার্ট স্থগিত বা স্থানান্তর করা হয়, তাহলে জনসমাগম হয়, এমন অন্যান্য আয়োজন ও প্রচারণা কেন একইভাবে নিয়ন্ত্রণে আসছে না? এ কনসার্ট ঘিরে তৈরি হওয়া জটিলতার কারণ কী, আমরা জানতে চাই। প্রশাসন কেন শুধু কনসার্টকেই জনসমাগমের স্থান হিসাবে দেখছে?’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা অনুবিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ভোটকে সামনে রেখে সরকার যে কোনোভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চায়। সেই বার্তা সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিভিন্নভাবে দেওয়া হয়েছে। কনসার্টে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, যার ঝুঁকি নিতে চাইছে না সরকার।’ বেশি টাকা দিয়ে ‘প্রাইভেট কনসার্ট’-এর অনুমতি মিলছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অনুমতিই দিচ্ছি না। ওরা কীভাবে করছে, বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের কাছে কেউ অবহিত করেননি।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শেষ মুহূর্তে কনসার্ট বাতিল হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন আয়োজকরাই। কারণ তখন সব ধরনের পেমেন্ট আগেই পরিশোধ করা থাকে। এতে একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতি হয়, অন্যদিকে বিদেশি শিল্পীরা এভাবে ফিরে গেলে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি দেশের বিনোদন অঙ্গন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম