গাইবান্ধার ১৬৫ চরাঞ্চলের চিত্র
স্বামীর কথায় ভোট দিতে হয় নারীদের
সিদ্দিক আলম দয়াল, গাইবান্ধা
প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
গাইবান্ধার ৫টি সংসদীয় আসনের অধিকাংশ নারীরা নিজের ইচ্ছায় কোনো দিন তার মনোনীত প্রার্থী বা মার্কায় ভোট দিতে পারেনি। স্বামী, শ্বশুর শাশুড়ি আর মিয়া মুরুব্বিদের কথায় ভোট দিতে হয়। ইউপি সদস্য চেয়ারম্যান এমনকি এমপি ভোটেও স্বামীরা যা বলেন সেই মার্কায় সিল মারতে হয়। এ অবস্থা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, সাদুল্লাপুর, সাঘাটা, ফুলছড়ি, গোবিন্দগঞ্জ, পলাশবাড়িসহ ৭ উপজেলার গ্রামীণ নারী ভোটারদের চিত্র।
গাইবান্ধার তিস্তা যমুনা, ব্রহ্মপুত্র নদীর ১৬৫টি চরাঞ্চলের ভোটের হিসাব কিতাব আলাদা। ওখানে কেন্দ্র আলাদা হলেও ভোট হয় গোষ্ঠীগত ভাবে। দলমত নির্বিশেষে যার নাম বেশি শোনা যায় তার বাক্সেই পড়ে ভোট। আর মার্কা নির্ধারণ করেন পরিবারের কর্তা। সে কারণে ভোট দিতে হয় স্বামী অথবা পরিবারের কর্তার ইচ্ছায়। অনেকেই আবার বিয়ের আগে নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পেয়েছেন। কিন্তু বিয়ের পর না। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চর কাপাসিয়ার ভাটি বুড়াইল গ্রামের বাসিন্দা ময়না, আফরোজা, জাহিমা, আফিয়া, মমতাজ, জাহানারা। ভোটার হওয়ার পর স্বামীর বাড়িতে এসে কোনো দিন ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজ ইচ্ছা প্রয়োগ করতে পারেনি। তাদের কথা হচ্ছে আমরা মেয়ে মানুষ। আমাদের অভিভাবক যা বলবেন তাই শুনতে হয়। সিল মারতে হয় স্বামীর পছন্দের সেই মার্কায়। এ অবস্থা গাইবান্ধার গ্রাম ও তিস্তা যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর চরাঞ্চলের চিত্র।
মাঠপর্যায়ে খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে তাদের মুখে শোনা গেছে এমন কথা। গাইবান্ধার গ্রামাঞ্চলে নারী ভোটারদের মধ্যে ভোট দেওয়া নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। অনেক ভোটার আছেন তারা কোন দিন নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পারেনি। স্বামী, শ্বশুর আর নিকটতম স্বজনদের প্রভাবিত হয়ে ভোট দিয়েই চলছেন।
গাইবান্ধা শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে মালিবাড়ি ইউনিয়নের নয়নসুখ গ্রাম। এই গ্রামের গৃহিণী ময়নাসহ শত শত নারী। কেউ মাঠে কাজ করেন, কেউ আবার স্বামী শ্বশুরদের সঙ্গে গৃহস্থলির কাজ ছাড়াও ধান মাড়াই থেকে শুরু করে গবাদি পশুর যত্ন করেন। ময়না বলেন, এ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের ভোট ছাড়াও উপজেলা চেয়ারম্যান এবং দুবার এমপি ভোটও দিয়েছেন স্কুলের সেন্টারে গিয়ে। তার পিতা বলেছিল ওমুককে ভোট দিতে কিন্তু পারেনি। ভোট দিয়েছে তার স্বামী ফুলমিয়ার কথা অনুযায়ী। তার কথা হলো এখন স্বামীর বাড়িই নিজের বাড়ি, স্বামীর কথা না শুনলে পাপ হবে। তাই বাবার কথা না শুনে স্বামীর কথা অনুযায়ী ভোট দিয়েছি। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা বলতেই বলেন ভোট দেব তবে ছোলের বাপ যাকে ভোট দিতে বলবে তাকেই ভোট দেমো। এই গ্রামের বাসিন্দা কৃষক আব্দুস সাত্তার। তার সাফ কথা। তার পরিবারের ৫ জন ভোটার আছে। তারা সবাই তার কথায় ওঠে বসে। ৫ ভোটারের মধ্যে কে কোথায় ভোট দেবেন তা আমিই নির্ধারণ করব। আমার বউ আম্বিয়া খাতুনের একই কথা তিনিও বলেন স্বামী যা বলব তাই শুনব। কামারজানির বারোবলদিয়া গ্রামের কহিনুর বেগম। তিনি বলেন এর আগে ভোট নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল। স্বামী বলেন একটা আর আমি বলি আরেক মার্কা। এই নিয়ে দুজনের তর্কবিতর্কের কারণে ভোট সেন্টারে যাওয়া হয়নি। কোহিনুর পড়ালেখা জানেন অল্প। তাই নিজের স্বাধীনতায় ভোট দিতে চায়। কিন্তু স্বামী সাত্তারের কথা আমি যা বলব সেই মার্কায় ভোট দিতে হবে। না হলে ভোটের সেন্টারে যাওয়া হবে না। গাইবান্ধার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলজুড়ে নারীদের অধিকার বঞ্চিত হয়ে আসছে। ব্রহ্মপুত্র নদী বেষ্টি চর খারজানি। এই গ্রামের অধিকাংশ নারী ভোটার ভোটের আগের দিনও জানতে পারে না কাকে ভোট দেওয়া হবে। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে বাস করলেও চরাঞ্চলের ইউপি সদস্য চেয়ারম্যান আর স্বামী শ্বশুরের কথা মতো ভোট দিতে হয়। এমন কথা জানালেন জোলেখা বেগম। তিনি বলেন আমাগো ভোট তো দিয়া দিছি। খালি সিল মারা বাকি আছে। চেয়ারম্যান আর মেম্বরা যে মার্কায় সিল মারতে বলেন হামরাও সেই মার্কায় ভোট দেই। হামার যাই উপকার করে, বিপদের সময় আসিয়া খোঁজখবর নেয় তাকে ভোট দেই। তবে চরাঞ্চলজুড়ে নারীরা মাঠে ময়দানে গতর খাটলেও তাদের ভোটের অধিকার সম্পর্কে কেউ তাদের কোন সহযোগিতা করে না। ভোট এলে হয়তো তাদের কপালে কোন লাভ লোকসানের হিসাব না থাকলেও তারা তাদের ইচ্ছে মতো ভোট দিতে পারে না।
সকালে ভোট শুরু হলে স্বামী আর স্বজনরা এসে একখানে জড়ো করে সেন্টারে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে বলেন অমুক মার্কায় ভোট দিব। সেই আদেশ পেয়েই গ্রামীণ এসব পরিবারের নারীরা ভোট দিয়ে থাকেন। একথা বলেন সুন্দরগঞ্জ উপজেলার চর বেলকার গৃহিণী সাইবানী বেগম। তিনি বলেন এবার তাদের মধ্যে ভোটের আনন্দ থাকলেও তারা নিজের মতে ভোট দেওয়ার ক্ষমতা নেই। স্বামী যা বলবেন সেই মার্কায় সিল দিয়ে আসবেন।
