হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি
মো. মোস্তাকিম আহমেদ, পুরান ঢাকা
প্রকাশ: ২৪ জুন ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঘোড়া দিয়ে টানানো গাড়ি টমটম মিশে আছে ঢাকার ইতিহাসের অংশ হয়ে। আর পুরান ঢাকার টমটমের সঙ্গে মিশে আছে ঢাকার ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ছিটেফোঁটা। তবে আজ সেই টমটম ঘোড়ার গাড়ি হারাতে বসেছে ঢাকার রাস্তা থেকে। তাদের টগবগিয়ে চলা এখন আর সচরাচর দেখা যায় না। আধুনিক যানবাহনের দৌড়ে টিকতে না পেরে হারিয়ে যেতে বসেছে ঢাকার ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়। কেননা এ যানজটের শহরে যান্ত্রিক বাহনের ভিড়ে অযান্ত্রিক বাহন হিসাবে ঘোড়ার গাড়ি বড্ড বেমানান।
এখন এ ব্যস্ত শহরে ঘোড়ার গাড়ি বেমানান হলেও রাজধানীর টমটমের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস। ঢাকার নবাবদের প্রধান বাহন হওয়ায় সাধারণের কাছে টমটম ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। একসময় ঢাকার অলিগলি কাঁপিয়ে বেড়ানো বাহন টমটম আজ যেন কেবল স্মৃতির পাতায় ঠাঁই নিচ্ছে। পুরান ঢাকার রাস্তায় ২০০ বছর ধরে চলা ঐতিহ্যবাহী এ ঘোড়ার গাড়ি এখন বিলুপ্তিপ্রায়। জানা যায়, ১৮৩০ সালে পুরান ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন। কারও কারও মতে, শাঁখারীবাজারে আর্মেনীয় বণিকদের প্রতিষ্ঠান ‘সিরকো অ্যান্ড সন্স’ ১৮৫৬ সালে ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন করে। জমিদারি বাহনের পাশাপাশি এটি তখন আর্মেনীয়দের ব্যবসার মাল টানার কাজেও ব্যবহৃত হতো। এরপর নবাবি শাসনামলেও ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন ছিল। পরবর্তী সময়ে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। কয়েক বছর আগেও সদরঘাট-গুলিস্তানের মধ্যে প্রায় ৫০টি টমটম চলত। মাসখানেক আগেও ২৫টি টমটমই টিকে ছিল। বর্তমানে সেই টমটম চলা একদমই বন্ধ। ঘোড়ার গাড়ি মালিক সমিতির সভাপতি আলী আজগর বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত ঘোড়ার গাড়ি রাখার দুটি স্ট্যান্ড বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও আজ আমরা ঘোড়ার গাড়ি চালাতে পারি না। পুলিশ কমিশনার নির্দেশনা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন গুলিস্তান রাস্তায় গাড়ি চালানো। গাড়ি চালানোর অনুমতি দিয়েছে বাবুবাজার থেকে সিকশন রাস্তা দিয়ে। সেই রাস্তায় যাত্রী নেই, তাই ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে সংসার চালানো দায়।
ঘোড়ার গাড়ি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শামীম হোসেন বলেন, ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে আমরা আমাদের পরিবার চালাতাম। মানুষকে বিনোদন দেওয়ার জন্য নিজেদের ঈদ অনুষ্ঠান বন্ধ করেও আমরা রাস্তায় রয়েছি। কিন্তু বর্তমানে টমটম চালানোর অনুমতি না থাকায় আমাদের জীবনধারণ কষ্টকর হয়ে পড়েছে। রাস্তায় গাড়ি চললে প্রতিদিন ১৭০০ থেকে দুই হাজার টাকা আয় হয়। কিন্তু এখন আমাদের সব আয় বন্ধ। আমরা নিজেরাই খাব কী আর ঘোড়াকেই খাওয়াব কী? একটা ঘোড়ার প্রতিদিন ৮০০ টাকার খাবার লাগে। একটা গাড়ির সঙ্গে চারটি পরিবার জড়িত, আমাদের সেই স্টাফদের অবস্থা আরও খারাপ। গাড়ি বের করলেই পুলিশ র্যাকারে পাঠাবে। তাহলে তো ১২০০ টাকা বিল উঠবে। যেখানে আয়ই নেই, সেখানে র্যাকারের বিল দেব কেমন করে?
পারিবারিকভাবে টমটম ব্যবসায় যুক্ত রজ্জব আলী আরশ বলেন, ‘ব্যবসা টিকে আছে দুটি কারণে। প্রথমটি হলো, বংশগত ব্যবসা ছাড়তে পারি না। দ্বিতীয়ত, শীতকাল এলে বিয়েশাদির সময় গাড়ির কিছু চাহিদা তৈরি হয়। এ সময় গাড়ি ভাড়া দিয়ে কিছু আয় হয়। তবে যেভাবে সবকিছুর খরচ বাড়ছে এবং গুলিস্তান থেকে সদরঘাট সড়কে চলাচল নিষেধ এসেছে, তাতে অচিরেই হয়তো এ ব্যবসায় ইতি টানতে হবে। সহকারী পুলিশ কমিশনার নাজমুল হক (ট্রাফিক-ফুলবাড়িয়া জোন) বলেন, গুলিস্তান থেকে সদরঘাট পুরোটাই ব্যবসায়িক এলাকা এবং সারাক্ষণ এখানে ব্যস্ততা লেগেই থাকে। বর্তমানে গুলিস্তান-সদরঘাট রাস্তায় যাতায়াতের জন্য রিকশা, বাস, সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেট কার রয়েছে। এতসব যান্ত্রিক যানবাহন থাকা সত্ত্বেও ঘোড়ানামক অবলা প্রাণীর গাড়িতে করে অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন করা কেবলই যানজট সৃষ্টির নিয়ামক এবং অমানবিকতাও বটে। অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহনের কারণে প্রাণীগুলো ক্লান্ত হয়ে শহরের পিচঢালা পথে চলতে গিয়ে ঘোড়ার পায়ের খুর ক্ষয় হয়ে নরম মাংস বের হয়ে যায়। এতে তাদের চলাচলে কষ্ট হয়। এ অবলা প্রাণী চলতে চলতে যখন পায়ের ব্যথায় থেমে যায়, তখন কোচোয়ান ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে আবারও চলতে বাধ্য করেন।
