মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম গোপন করার অভিযোগ
এনসিটিবিতে আবারও সক্রিয় ‘সিন্ডিকেট’
আজ থেকে ক্রমান্বয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত করা হবে
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
মাধ্যমিক স্তরের নতুন বই (২০২৬ সালের) ছাপানোর বেশির ভাগ কাজ বাগিয়ে নিতে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে একশ্রেণির মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি দরপত্রে অনিয়মের কারণে তিন শ্রেণির ক্রয় সংক্রান্ত আদেশ বাতিল করে দেয় সরকার। পরে সিন্ডিকেট ভাঙতে দরপত্রের আইনে সংশোধন আনা হয়। এতে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু বিতর্কিত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে এনসিটিবির বেশকিছু আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা মাঠে নামেন। তারা একই নিয়মে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করতে শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে সুপারিশ করেন। এজন্য প্রেস মালিকদের আন্দোলনের ভয়ভীতিও দেখান। তাই একই নিয়মেই আজ থেকে ক্রমান্বয়ে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র পুনরায় উন্মুক্ত করা হবে। একই সঙ্গে এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে কাগজের শর্ত শিথিল করে নির্দিষ্ট মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানে কাজ দেওয়ার পরিকল্পনাও করা হচ্ছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
চলতি বছর এক শ্রেণির মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের ৩০ শতাংশ নিুমানের বই দিয়েছে। এসব বই পড়তে শিক্ষার্থীদের চোখের সমস্যাসহ নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। অথচ এসব মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি এনসিটিবি। বইয়ের মান যাচাই করতে এনসিটিবি সব জেলা থেকে বেশকিছু বই সংগ্রহ করে। এতে অনেক আওয়ামীপন্থির মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। কিন্তু এই রিপোর্ট এনসিটিবি মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নামে গোপন রেখেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া চলতি বছরের শুরুতেই এনসিটিবির চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হয়। কিন্তু এই পদে কাউকে নিয়োগ না দিয়ে আওয়ামীপন্থি এক কর্মকর্তাকে চেয়ারম্যানের রুটিন দায়িত্বে দেওয়া হয়। তিনি আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। শিক্ষাজীবনে ছাত্রলীগ করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি তিনিও অবসরে যাচ্ছেন। তাকে আরও দুই মাস চুক্তিভিক্তিক নিয়োগ দিতে কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কারিকুলামে ৭ মার্চের ভাষণ রাখাসহ এনসিটিবির এসব কর্মকাণ্ডে শিক্ষা উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিএস) একেএম তাজকির-উজ-জামানের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
একইভাবে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরীও আওয়ামী সুবিধাভোগী একজন কর্মকর্তা। তিনি সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সময় মাদ্রাসা বোর্ড ও নায়েমে চাকরি করেছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। তিনি প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন বলে জানা গেছে। এনসিটিবির ভান্ডার ও উৎপাদন শাখাসহ বিভিন্ন দপ্তরে আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের রয়েছে কঠিন সিন্ডিকেট। তাদের মাধ্যমে প্রেস মালিকদের টেন্ডারের দর ফাঁস করার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে আজ ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির ৩৭তম সভায় নতুন শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিকের নবম ও দশম শ্রেণির বইয়ের দরপত্র অনুমোদনের প্রস্তাব উপস্থাপন করবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। তবে এই দরপত্রেও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বেশির ভাগ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান দরপত্র বাতিল করে পুনরায় টেন্ডার আহ্বানের দাবি জানিয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বই ছাপানোর কাগজের স্পেসিফিকেশনে গোপনে পরিবর্তন আনা হচ্ছে। সেখানে ব্রাস্টিং ফেক্টর এবার ২০ করা হয়েছিল। তবে পুনরায় দরপত্র আহ্বানে তা এখন ১৮তে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এছাড়া ওপাসিটি ও ওভিএ-তে পরিবর্তন আনার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। প্রেস মালিকদের সুবিধার জন্য এনসিটিবি এই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।
জানা যায়, আজ থেকে মাধ্যমিক স্তরের তিন শ্রেণির দরপত্র উন্মুক্ত করা হবে। তাই কয়েকদিন ধরে একশ্রেণির প্রেস মালিক বিভিন্ন হোটেলে গোপন মিটিং করেছেন। তারা বেশির ভাগ দরপত্র নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। এজন্য তারা কৌশলে অনেক প্রেস মালিকের আইডি ও পাসওয়ার্ড হাতিয়ে নিয়েছেন। এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য দুলাল সরকার, রুবেল, মহসিন ও মিন্টু মোল্লা।
এ বিষয়ে দুলাল সরকার বলেন, আমরা কোনো সিন্ডিকেট করি না। ভালো মানের বই ছাপানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো সত্য নয়।
এ বিষয়ে জানতে একেএম তাজকির-উজ-জামানকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতাব উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থীদের নিুমানের বই দেওয়ার অভিযোগে এনসিটিবি যে তালিকা করেছে, সেটি মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে কি না চেয়ারম্যান ভালো বলতে পারবেন। তবে শিক্ষা উপদেষ্টার ব্যক্তিগত কর্মকর্তার বিষয়ে তিনি বলেন, কাজের ক্ষেত্রে তার সব সময় আন্তরিকতা পেয়েছি। এবারের বইয়ের মান ভালো করার জন্য তিনি চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশ মুদ্রণশিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান যুগান্তরকে বলেন, মাধ্যমিকের তিন শ্রেণির পুনঃদরপত্রে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতার সনদ শিথিল করা হয়েছে। এতে কাজের প্রতিযোগিতা বাড়বে। কিন্তু অভিযুক্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় আবারও সিন্ডিকেট করার আশঙ্কা রয়েছে। এতে সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হবে।


