৮-১০ বছর একই স্থানে দায়িত্বে থাকায় স্বেচ্ছাচারী
দরিদ্রের টাকা আত্মসাৎ সমাজসেবা কর্মকর্তাদের
তদন্তে প্রমাণিত হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে : সচিব
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাঠ প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা অনিয়ম-দুর্নীতি এবং স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িয়ে পড়েছেন। তাদের বিরুদ্ধে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির সময় উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হয়েও স্বেচ্ছায় হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করছেন না কেউ কেউ। একেকজন কর্মচারী একেক উপজেলায় ৮-১০ বছর দায়িত্ব পালন করায় স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছেন। এসব বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রতিকার ও প্রতিবাদ করে আবেদন করেছেন ভুক্তভোগীরা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
এ বিষয়ে সমাজকল্যাণ সচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউছুফ যুগান্তরকে বলেন, সমাজসেবার মাঠপ্রশাসনে কর্মরত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেব। তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু মন্তব্য করতে চাননি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের ২২ লাখ ৪৭ হাজার, পল্লী মাতৃকেন্দ্রের ৫ লাখ ১৩ হাজার, প্রতিবন্ধী শিক্ষা উপবৃত্তি খাতের ৪ লাখ ৭৫ হাজার, ভিক্ষুক পুনর্বাসন কার্যক্রমের ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি কর্মস্থল থেকে লাপাত্তা। অতি সম্প্রতি তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে আত্মসাৎ করা সরকারি অর্থ আদায়ে তার বিরুদ্ধে সরকারি পাওনা আদায় আইন-১৯১৩ অনুসারে মামলা করা হয়েছে কি না, তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে ২৫ এপ্রিল গোলাম রহমান নামে এক ব্যক্তি সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও কলারোয়া উপজেলার সাবেক সমাজসেবা অফিসার মো. আরিফুজ্জামানের বিরুদ্ধে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে ৫ লাখ ৯ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ দিয়েছেন। একই অভিযোগে দাবি করা হয়, গত অর্থবছরের প্রথমার্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষয়ক্ষতির মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে শ্যামনগর উপজেলায় ৫ লাখ ৯ হাজার ২০০ এবং কলারোয়া উপজেলায় ৫ লাখ ৪৯ হাজার টাকা বরাদ্দ নিয়েছেন। বাড়তি বরাদ্দের অধিকাংশ অর্থ ভুয়া বিল-ভাউচারে আত্মসাতের অভিযোগ করেন গোলাম রহমান। এছাড়া ক্যানসার রোগীদের অনুদান পাওয়ার জন্য অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করতে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। সমাজসেবা অফিসের মাস্টার রোল কর্মচারী মনিরকে দিয়ে টাকা নেওয়া হয়েছে। অধিকাংশ ক্যানসার রোগী অনুদান পায়নি। আবার যাদের অনুদান দেওয়া হয়েছে তাদের কাছ থেকে চেক দেওয়ার আগে অগ্রিম ২৫ হাজার টাকা করে কেটে নেওয়া হয়েছে। তাকে এসব কাজে সহায়তা করেছেন জেলা সমাজসেবা অফিসের সহকারী পরিচালক রোকনুজ্জামান। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আরিফুজ্জামান ও রোকনুজ্জামান। রোকনুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের একজন অফিসার বিভিন্ন নামে এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ দায়ের করেন। ১৯ বছর চাকরিজীবনে এ ধরনের ৫০-৬০টি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তদন্তে একটিও প্রমাণিত হয়নি। বর্তমানে বিষয়গুলো তদন্ত হচ্ছে। আশা করি, এবারও প্রমাণ হবে না। তিনি আরও বলেন, আরিফুজ্জামান ভালো অফিসার এবং তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করা হচ্ছে।
অপরদিকে বরগুনা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক সহিদুল ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন খাতের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে জেলা অফিসের জন্য বই ও সাময়িকী, তথ্য ও প্রযুক্তি সরঞ্জাম, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক জিনিস কেনা এবং চুক্তিতে অফিস ভাড়া বেশি দেখিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। সরকারি শিশু পরিবারে এতিম নিবাসী বেশি দেখিয়ে প্রতিমাসে ঠিকাদারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিচ্ছেন। তিনি সরকারি অফিসের ভেতরে একটি রুমে থাকেন এবং অনেক সময় জামা ছাড়া খালি শরীরে অফিসে ঢুকে পড়েন। এতে নারী সহকর্মীরা বিভ্রত হন। তিনি মাসের বড় একটি অংশ বরিশালে নিজ বাসায় অবস্থান করেন। জটিল রোগীদের ভাতা পাওয়ার জন্য ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা উৎকোচ নিচ্ছেন। তবে এসব অভিযোগী অস্বীকার করে সহিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমি বরগুনায় আসার পর সবার কাজে ফাঁকি দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে তারা আমার বিরুদ্ধে লেগেছে এবং কাল্পনিক অভিযোগ করা হয়েছে। বরগুনার বিভিন্ন উপজেলায় কর্মরত সমাজসেবার কর্মচারীরা অনেকে বাড়ি-গাড়ির মালিক। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় তারা বেসামাল হয়ে পড়েছেন। তবে সমাজসেবা অধিদপ্তর এব আমি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত রাখব।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিংগাইর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জোবায়দা গুলশান আরা অধীনস্থদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তিনি রোগী সেজে সহকর্মীদের বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। তিনি নিয়মিত বেলা ১২টায় অফিসে আসেন। সাড়ে ৮ বছর তিনি একই উপজেলায় দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জোবায়দা গুলশান আরা যুগান্তরকে বলেন, এসব ভিত্তিহীন অভিযোগ। বরং আমার সাবেক সহকর্মী ডা. হাকিম নিয়মিত অফিসে এলেও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করেননি। ডা. রাসেল শাহা রোগীদের বেআইনিভাবে চিকিৎসাপত্র দিয়েছেন। এ নিয়ে ডা. মনিরা সুলতানার সঙ্গে তার বনিবনা হয়নি। এর বাইরে কিছু না। ডা. হাকিম, মুনিরা সুলতানা এবং রাসেল শাহা অনিয়ম করায় তাদের বদলি করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তারা দুষছেন আমাকে। তবে ডা. মনিরা সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, জোবায়দা গুলশান আরা আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে বদলি করেছেন। ডা. হাকিম বলেন, আমি অষ্টম গ্রেডের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা। আমি কেন স্বাক্ষর করব। স্বাক্ষর করবেন দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। কর্মকর্তাদের হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করতেই হবে-এমন কোনো আইন নেই। তাহলে আপনি নিয়মিত অফিস করছেন, এটা সরকার কীভাবে বুঝবে-এমন প্রশ্নে ডা. হাকিম বলেন, আমার ইমিডিয়েট বস আমার হাজিরা নিশ্চিত করবেন।

