রাজশাহীতে এসআই মহিউদ্দিনের কাণ্ড
ছাত্রদল নেতার কাছ থেকে টাকা আদায়
বড় কর্মকর্তাদের নামে আরও দুই লাখ দাবি
রাজশাহী ব্যুরো
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
রাজশাহীতে পুলিশের এসআই (উপপরিদর্শক) মহিউদ্দিন চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেওয়ার নামে ছাত্রদল নেতার কাছ থেকে তার ব্যক্তিগত বিকাশ নম্বরে টাকা নিয়েছেন। পুলিশের বড় কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনের (ফাইনাল রিপোর্ট) কথা বলে তিনি আরও দুই লাখ টাকা দাবি করেছেন। মহিউদ্দিন রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) চন্দ্রিমা থানায় কর্মরত অবস্থায় একটি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার দায়িত্বে পালনকালে এ অনৈতিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন।
একইসঙ্গে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে একটি মামলায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর বাদীর পক্ষাবলম্বন এবং আসামিদের হয়রানি ও নির্যাতনের অভিযোগও উঠেছে। সম্প্রতি তাকে আরএমপির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থানা বোয়ালিয়ায় বদলি করা হয়েছে। এসব ঘটনায় এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে ৫ নভেম্বর রাজশাহী মহানগর ছাত্রদলের সাবেক সহসহভাপতি মাহমুদ হাসান শিশিল আরএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন।
এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে আরএমপি কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগের কপি, বিকাশে টাকা নেওয়ার স্ক্রিনশর্ট, আসামিদের সঙ্গে মামলা এবং টাকা আদায় ও দাবির দেনদরবার সংক্রান্ত কয়েকটি ফোনকল রেকর্ডও যুগান্তরের হাতে এসেছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় ইতোমধ্যে আরএমপির একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা অনুসন্ধান শুরু করেছেন। পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগে সাবেক ছাত্রদল নেতা শিশিল উল্লেখ করেন, ২ জুলাই শহরের ভদ্রা এলাকার একটি বাসায় রাজশাহী মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক রনির অবস্থানের খবর পেয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা বাসাটি অবরুদ্ধ করেন। আমি যুবদলের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারণে সহযোদ্ধাদের ফোন পেয়ে অনেক পরে সেখানে যাই। তবে সেখানে আমার ভাই মেহেদি হাসান সিজারের শ্বশুর জাবেদ আক্তার বেবি এবং তার শাশুড়ি হাবিবা আক্তার মুক্তা বসবাস করেন, সেটি আমার জানা ছিল না।
পুলিশ ওই বাসায় তল্লাশি চালালে সেখানে রনির সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে পারিবারিক বিরোধের সুযোগ নিয়ে আমার ভাই সিজারের শাশুড়ি মুক্তা পরিকল্পিতভাবে একটি চুরির মিথ্যা মামলা করেন। মামলায় মুক্তা তার ফ্ল্যাট থেকে ২ লাখ টাকা ও ১২ ভরি স্বর্ণালঙ্কার চুরির অভিযোগ আনেন। এ মামলায় আমিসহ আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী জীবন এবং ছাত্রদল নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ শাখার সদস্য সচিব মাহমুদ হাসান লিমনকে আসামি করা হয়।
মামলা হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন উপদেষ্টার কার্যালয় ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আমাদের গ্রেফতারে কঠোর নির্দেশনা রয়েছে বলে প্রচার করেন এসআই মহিউদ্দিন। এর মাধ্যমে তিনি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। তিনি আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী জীবনকে নির্যাতন করেন। সর্বশেষ এসআই মহিউদ্দিন চার্জশিট দেওয়ার নামে বিকাশে টাকা নিয়েছেন। মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার নামে আরও দুই লাখ টাকা দাবি করছেন। টাকা না দিলে তিনি জেল খাটানোর ভয় দেখিয়েছেন।
এদিকে মামলার আসামি ছাত্রদল নেতা লিমনের সঙ্গে এসআই মহিউদ্দিনের একটি ফোনকল রেকর্ডে শোনা গেছে, ‘তুমি যে আমার বিকাশে টাকা দিয়েছ, সেই স্ক্রিনশর্ট মানুষের কাছে গেল কীভাবে?’ এর উত্তরে লিমন বলেন, ‘আপনি চার্জশিটের জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে।’ এরপর মহিউদ্দিন বলেন, ‘এখন কী করব বল? তোমার টাকা খরচ করে ফেলেছি। দিয়া দেব।’
এরপর মহিউদ্দিন আরও বলেন, ‘ভাই, আমি যে চাকরি করি, আমি ভাইয়ের মধ্যে কোনো ফাঁক রাখি না। আমি যদি পাঁচ টাকা খাব, এই কাজ আমি করি না যে সিনিয়র অফিসারকে ফাঁকি দেব। এই কাজ আমি করি না, কোনোদিনও না। এখন আমার কোনো সমস্যা হলে সিনিয়র অফিসার আমাকে সেইফ করে কীভাবে?’ এ সময় দুই লাখ টাকা লেনদেনের কথাবার্তাও হয়। এছাড়া রাজশাহীর প্রভাবশালী বিএনপি নেতা মিজানুর রহমান মিনু তার আপন চাচা বলেও মহিউদ্দিন দাবি করেন।
আরেক ফোনকল রেকর্ডে শোনা যায়, শিশিল এসআই মহিউদ্দিনকে প্রশ্ন করছেন-‘আপনি কি তদন্ত করেছেন আমি গেছি কি না বা চুরি করেছি কি না?’ জবাবে এসআই মহিউদ্দিন বলেন, ‘না, না রে ভাই। ওগুলো কিছুই নাই। এগুলো নিয়েই তো ওসি লেগেছিল আমার সঙ্গে। আমি বললাম-স্যার, ইনি (শিশিল) কি ২ লাখ টাকা চুরি করবে? এগুলো কিচ্ছু নাই। একটা টাকা, এতটুকু স্বর্ণও চুরি হয়নি। আমি এসব বলে আসছি।’ এ সময় শিশিল বলেন, ‘সুষ্ঠুভাবে যেটা হবে, সেটা করবেন। আমার পক্ষেও করার দরকার নাই।’
আরেক ফোনকল রেকর্ডে শোনা যায়, লিমন মহিউদ্দিনকে বলছেন-‘আমি লিমন নিজে বলছি। আমার নাম থেকে যাক। আপনি ভাইয়ের (শিশিল) নামটা শুধু বাদ দেন।’ এ সময় মহিউদ্দিন বলেন, ‘এ ভাই, আমি তো পারব না রে ভাই। তোমরা তো বিষয়ই বুছতেছ না। মামলার মনিটরিং অফিসার হলো ডিসি স্যার। ডিসির ওপরে হলো কমিশনার। তোমরা কি জান? মামলা খালি আমাদের কাছে থাকে তাই। সব ডিরেকশন ওনারা দেয়।’
মামলার প্রধান আসামি শিশিল বলেন, ‘আমি ব্যবসায়ী। বছরে ছয় থেকে সাত লাখ টাকা আয়কর দিয়ে থাকি। অথচ কোনো তদন্ত ছাড়াই আমাদের নামে টাকা ও সোনা চুরির মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলার বাদী মুক্তার স্বামী বেবি ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দোসর। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা রাজশাহীর সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং সাবেক এমপি আসাদুজ্জামান আসাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী। বেবির ভাই আশরাফ আলী নবাব রাজশাহী মহানগর যুবলীগের দুইবারের সভাপতি। বেবি-মুক্তা দম্পতির বাসায় আওয়ামী লীগের নেতাদের স্থান দেওয়া হয়।’
শিশিল বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা মহিউদ্দিনই বলেছেন যে, আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। চুরির ঘটনাও নেই। তারপরও ওসি, ডিসি, কমিশনারের কথা বলে চার্জশিট দেওয়ার ভয় দেখিয়ে তিনি টাকা নিয়েছেন। আমার বড় ভাই সিজারের কাছে মা রওনক জাহান সাড়ে তিন কোটির বেশি টাকা পাবেন। এটি নিয়ে মামলাও রয়েছে। টাকাকে কেন্দ্র করে সিজার মাকে হত্যাচেষ্টাও চালিয়েছেন। আমি মাকে আমার কাছে রেখেছি। এ বিরোধকে কেন্দ্র করেই সিজারের শাশুড়ি মুক্তা আমাদের বিরুদ্ধে চুরির একটি মিথ্যা মামলা করেছেন।’
মামলার আরেক আসামি ছাত্রদল নেতা লিমন বলেন, ‘এসআই মহিউদ্দিন মামলার চার্জশিটের কথা বলে ২০ হাজার টাকা নিয়েছেন। গত ১৬ আগস্ট তিনি আমার কাছে নগদ ১৫ হাজার টাকা নেন। আর বাকি পাঁচ হাজার টাকা পরের দিন ১৭ আগস্ট রাত নয়টা ৪৬ মিনিটে আমি তার বিকাশ নম্বরে দিয়েছি। এছাড়া মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তিনি আরও দুই লাখ টাকা দাবি করেন। না দিলে জটিল ধারার ভয় দেখিয়ে জেল খাটানোর হুমকি দিয়েছেন।’
তবে অভিযোগ আংশিক স্বীকার করে এসআই মহিউদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, ‘নিষেধ করলেও আমার বিকাশ নম্বরে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন একজন আসামি। পরে ওই আসামিকে বিকাশেই টাকা ফেরত দিয়েছি। আমাকে লোভনীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তবে আমি প্রত্যাখ্যান করেছি। দুই লাখ টাকা দাবি, বাদীর পক্ষ নিয়ে তদন্ত কিংবা আসামিদের নির্যাতন, ভয়ভীতি ও হয়রানির অভিযোগ ভিত্তিহীন।’ তবে আসামিকে পাঁচ হাজার টাকা ফেরত দেওয়ার বিকাশের স্টেটমেন্ট চাইলে, তিনি সেটি পরে দিতে চান।
আরএমপি’র মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার গাজিউর রহমান বলেন, ‘এসআই মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে। একজন সিনিয়র কর্মকর্তাকে এ বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।’
