Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

কুয়াকাটায় সড়ক নির্মাণে দুর্নীতি

জন্মের আগেই মৃত রাস্তার ‘গায়েবানা জানাজা’

আকতার ফারুক শাহিন

আকতার ফারুক শাহিন

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

জন্মের আগেই মৃত রাস্তার ‘গায়েবানা জানাজা’

দুই মাসও টিকবে না নির্মাণাধীন সড়ক। তাই জন্মের আগেই ‘মৃত’ ঘোষণা করে সড়কের ‘গায়েবানা জানাজা’ পড়েছেন বিক্ষুব্ধ জনতা। পর্যটনকেন্দ্র কুয়াকাটায় ঘটেছে এই ঘটনা। কেবল গায়েবানা জানাজাই নয়, সড়ক নির্মাণে বেপরোয়া দুর্নীতির প্রতিবাদ ও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার-প্রকৌশলীর শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে প্রতিবাদ। ঢালাই দেওয়ার মাত্র দুদিনের মাথায় কত সহজে সড়কের খোয়া আর বিটুমিন উঠে আসছে, সেই ছবি তুলে ভিডিও করে ফেসবুকে দিচ্ছেন অনেকে। এলাকাবাসীর দাবি, সাগরপারে অনেকটা মেরিন ড্রাইভের মতো ওই সড়কের নির্মাণ শুরু হওয়ার পর থেকেই চলছে দুর্নীতি। এই নিয়ে বহুবার স্থানীয় এলজিইডি দপ্তরে অভিযোগ করা হলেও তারা কানে তোলেননি। সর্বশেষ বিটুমিনের ঢালাইয়ে অনিয়ম হওয়ায় শুরু হয় এই আন্দোলন।

প্রায় ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ কুয়াকাটা সৈকতের ৬ কিলোমিটারজুড়ে রয়েছে সাগরঘেঁষা বেড়িবাঁধ। জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিম দিকে লেম্বুর বন পর্যন্ত ওই এলাকায় ভ্রমণে গিয়ে মেরিন ড্রাইভের অনুভূতি পান পর্যটকরা। এর বাইরে জিরো পয়েন্ট থেকে পূর্বদিকে বিস্তৃত সড়ক থাকলেও সেখানে দেখা যায় না সমুদ্র। বেড়িবাঁধ থাকলেও পূর্বদিকের ওই পথে ছিল না পাকা সড়ক। বাঁধের এবড়ো-খেবড়ো মাটি-বালি মাড়িয়ে চলতে হতো সবাইকে। দুর্ভোগ এড়াতে অনেকে আবার বাঁধ এড়িয়ে সৈকত ধরে পৌঁছাত সেখানে। তিন নদীর মোহনা, প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ঘন জঙ্গল আর সৈকতে বালি ফুঁড়ে বেরোনো গাছের দৃশ্যমান শেকড়রাজির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের কাছে বড় আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে লেম্বুর বন। ফলে দাবি ওঠে জিরো পয়েন্ট থেকে লেম্বুর বন পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার সড়ক পাকা করার। পর্যটক আকর্ষণের পাশাপাশি কুয়াকাটার পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই সড়কটি। বর্ষায় যেটি থাকে চলাচলের পুরোপুরি অনুপযোগী।

জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম পর্যায়ে জিরো পয়েন্ট থেকে পশ্চিমে মাঝি বাড়ি পর্যন্ত পৌনে ৩ কিলোমিটার সড়ক পাকা করার উদ্যোগ নেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সেই লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। প্রকল্প অনুযায়ী বেড়িবাঁধ ১৫ ইঞ্চি গভীর করে প্রথমে ৩ ইঞ্চি বালু, তারপর বালু-খোয়ার ৬০/৪০ অনুপাতে মিশ্রণ ৬ ইঞ্চি ও ৬ ইঞ্চি মেকাডাম (ইটের খোয়া) করে ওপরে ১ ইঞ্চি ঢালাই দেওয়ার কথা। টেন্ডারে অংশ নিয়ে কাজটি পায় ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তারা কাজ না করে জসিম মৃধা নামে একজনের কাছে বিক্রি করে দেয়। রাস্তা নির্মাণে শুরু থেকেই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে জসিম মৃধার বিরুদ্ধে। ৩ ইঞ্চি বালি দেওয়ার কথা থাকলেও কোথাও ১ থেকে দেড় ইঞ্চির বেশি দেওয়া হয়নি। ৬ ইঞ্চির খোয়া-বালির ৬০/৪০ অনুপাত মিশ্রণেও হয় অনিয়ম। আগাগোড়া শতকরা ২০ ভাগ খোয়া আর ৮০ ভাগ বালি দেওয়া হয় সড়কে। মেকাডামের খোয়া দেওয়া হয় নিম্নমানের ইট ভেঙে। এই নিয়ে সেখানে ঠিকাদারের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের কথা কাটাকাটিও হয়।

বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ হলে কাজ পরিদর্শনে কুয়াকাটায় যান পটুয়াখালীর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী হোসাইন আলী মীর। তার কাছে সড়ক নির্মাণে দুর্নীতি তুলে ধরেন পর্যটন ব্যবসায়ীসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। নির্মাণে অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে চলে আসেন তিনি। এরপর কিছুদিন বন্ধ থাকে নির্মাণকাজ। তবে নিম্নমানের খোয়া অপসারণ কিংবা শুরু থেকে করা অনিয়ম সংশোধনের উদ্যোগ নেননি ঠিকাদার। এছাড়া কলাপাড়া উপজেলা প্রকৌশলী মোহাম্মদ সাদিকুর রহমানের বিরুদ্ধেও ওঠে নিম্নমানের কাজে নীরব সহযোগিতার অভিযোগ।

চলমান এই জটিলতার মধ্যে মঙ্গলবার সড়কে চূড়ান্ত ঢালাইয়ের কাজ শুরু করেন ঠিকাদার। নিম্নমানের ঢালাই ও প্রকল্প অনুযায়ী ১ ইঞ্চির জায়গায় অনেক পাতলা করে খোয়া-বিটুমিন দেওয়া হচ্ছে দেখে ফুঁসে ওঠে জনতা। সড়কসংলগ্ন পর্যটন ব্যবসায়ী আজাদ রহমান বলেন, ঠিকাদার ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাজ করছে। এতে করে মিশ্রণ ঠিক না থাকায় ঢালাইয়ে অনেক ফাঁকা থাকছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি ভেতরে ঢুকে বিটুমিন আলাদা হয়ে বাতিল হবে সড়ক। খোয়ার আকারও অনেক বড় হয়েছে। ট্যুরিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটা-টোয়াক’র সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, উপরিভাগে ১ ইঞ্চি ঢালাই দেওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ জায়গায় আধা ইঞ্চি বা পৌনে ১ ইঞ্চির বেশি দেওয়া হয়নি। কুয়াকাটা বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাসুদ পারভেজ সাগর বলেন, এত নিম্নমানের নির্মাণ আগে আর দেখিনি। যে অবস্থা তাতে দুমাসও টিকবে না।

সাগর ঘেঁষে থাকা এই সড়ক নির্মাণে অনিয়মের প্রতিবাদে বুধবার সড়কটির প্রতীকী গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কুয়াকাটা স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্সের উদ্যোগে আয়োজিত এই জানাজায় অংশ নেন বিপুলসংখ্যক মানুষ। অ্যালায়েন্সের সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মুজাহিদ সিফাত বলেন, জন্ম নেওয়ার আগেই তো সড়কটির মুমূর্ষু দশা। যে সড়ক জন্মের আগেই মারা গেছে তার জন্য ‘গায়েবানা জানাজার’ এই প্রতীকী আয়োজন। কেন্দ্রীয় বিএনপির প্রশিক্ষণবিষয়ক সম্পাদক ও পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এবিএম মোশাররফ হোসেন বলেন, বুধবার সন্ধ্যায় ওই সড়কে গিয়েছিলাম। খুবই নিম্নমানের কাজ। বিষয়টি টেলিফোনে স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানিয়েছি।

সড়ক নির্মাণে দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলার জন্য কলাপাড়া উপজেলা প্রকৌশলী সাদিকুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোন ধরেননি তিনি। পটুয়াখালীর নির্বাহী প্রকৌশলী হোসাইন আলী মীর বলেন, অভিযোগের বিষয়গুলো আমার কানে এসেছে। প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনও করা হয়েছে। রাস্তার কাজে অনিয়মের বিষয়টি তদন্ত করা হবে। এছাড়া অনুমতি ছাড়া ঢালাই দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছে। তারপরও ঢালাইয়ের ওপরে আলাদা করে পাথর দিয়ে সিলকোট করে দেওয়া হবে। তাহলে আর রাস্তার সমস্যা হবে না।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম