Logo
Logo
×

নগর-মহানগর

রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃত্রিম সংকট

ডিলারদের সার যাচ্ছে সিন্ডিকেটের হাতে

Icon

রাজশাহী ব্যুরো

প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে ডিলারদের জন্য বরাদ্দকৃত ভর্তুকির সারের সিংহভাগই চলে যাচ্ছে কালোবাজারে। বিসিআইসি ও বিএডিসির ডিলাররা প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে বরাদ্দকৃত সার উত্তোলন করছেন; কিন্তু কৃষকরা ডিলারের দোকানে গিয়ে সার পাচ্ছেন না। কৃষকদের চড়া দামে সার কিনতে হচ্ছে চোরাই বাজার থেকে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সারের বিশাল চোরাই সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বাফার গুদাম বা বিভিন্ন বন্দর মোকাম থেকে ডিলাররা বরাদ্দের কিছু সার দোকানে আনলেও বড় অংশই পাচার করছে চোরাই ফড়িয়াদের কাছে।

এদিকে বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে আলু ও বোরো আবাদের ভরা মৌসুমে এক জেলার সার পাচার হয়ে যাচ্ছে আরেক জেলায়। এক উপজেলার জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি সার পাচারকারীদের হাত ঘুরে চলে যাচ্ছে আরেক উপজেলায়। কাগজে-কলমে জেলা ও উপজেলায় সার মনিটরিং কমিটি থাকলেও বাস্তবে এসব কমিটি কোনো কাজ করছে না। বরং ভুক্তভোগী কৃষকরা অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও স্থানীয় পুলিশকে ম্যানেজ করে সরকারি সারের চোরাই সিন্ডিকেট জমজমাটভাবে চলছে। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দু-একটি এলাকায় লোকদেখানো অভিযান পরিচালনা করে চোরাই সার উদ্ধার করা হলেও জরিমানা করেই অভিযানপর্ব শেষ করছে উপজেলা সার মনিটরিং কমিটিগুলো।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহীর তানোর উপজেলার মোহর গ্রামের মাসুদ বিএডিসির বীজ ডিলার। সার বিক্রির কোনো অনুমতি বা লাইসেন্স তার নেই। কিন্তু কয়েক মাস ধরে মাসুদ ট্রাক-ট্রাক সার এনে কৃষকদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করছেন। শনিবার সকালে শরিফুল ইসলাম নামের এক চাষি ডিএপি সার আছে কি না জানতে মাসুদের কাছে ফোনে কল দেন। মাসুদ তাকে জানান, ডিএপি আছে, তবে প্রতি বস্তার দাম পড়বে ১ হাজার ৭০০ টাকা। আলুচাষি শরিফুল বলেন, চাষি পর্যায়ে ডিএপি সারের সরকারি মূল্য ১ হাজার ৫০ টাকা। কিন্তু এলাকার ডিলারদের কাছে সার না থাকলেও মাসুদদের মতো ফড়িয়াদের দোকানে পর্যাপ্ত সরকারি সার মজুত আছে। বাধ্য হয়ে কৃষক চড়া দামে সার কিনে আবাদ উঠাচ্ছেন। সার বিক্রির অনুমতি বা লাইসেন্স না থাকার পরও কীভাবে টনে-টনে সরকারি সার এনে চড়া দামে বিক্রি করছেন-জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, আমি তানোর সদরের মেসার্স প্রণব ট্রেডার্স, সরনজাইয়ের মেসার্স আনজুয়ারা ট্রেডার্স এবং তালোন্দ এলাকার বিসিআইসি ডিলার সুমন কুমার শীলের কাছ থেকে সার এনে বিক্রি করি। তারা বস্তাপ্রতি ২৫০ টাকা করে বেশি রাখেন। তাই আমি কিছুটা বেশি দামে কৃষকের কাছে বিক্রি করি। মাসুদের কাছে সার বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে বিসিআইসি ডিলার প্রণব কুমার সাহা জানান, তিনি মাসুদের কাছে কোনো সার বিক্রি করেননি।

তবে তানোর এলাকার ভুক্তভোগী কৃষকরা আরও জানান, প্রণবসহ তানোরের বেশ কয়েকজন সার ডিলার গুদাম থেকে সার তুলে কালোবাজারে বিক্রি করে দেন। কৃষক সার কিনতে গেলে তাদের বলেন, সার বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। অভিযোগে জানা যায়, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উপজেলা সার মনিটরিং কমিটির সদস্য সচিব। কৃষকরা অভিযোগ দিলেও কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কৃষি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। জানতে চাইলে তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাইফুল্লাহ বলেন, আমরা প্রত্যেক ডিলারের দোকানে গিয়ে স্টক চেক করি। এভাবে সার পাচারের তথ্য তাদের কাছে নেই। তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে, জানান তিনি।

এদিকে বরেন্দ্র অঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমনুরা, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, মোহনপুরের কেশরহাটসহ আরও কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বরেন্দ্র এলাকাজুড়ে পুরোদমে শুরু হয়েছে আলুচাষ। কোথাও কোথাও চলছে বোরো আবাদের জন্য জমি তৈরির কাজ। এসব ফসল আবাদে সেচের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণ বিভিন্ন ধরনের সার লাগে। বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নাটোর এলাকায় গত এক দশকে আলু চাষ হচ্ছে। চাষিরা বলছেন, আলু ও বোরো আবাদের ঠিক এই সময়টাতে প্রতিবছর সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হয়। ডিলারদের জন্য বরাদ্দকৃত সারের বড় অংশই চলে যায় কালোবাজারে। তানোরের কৃষ্ণপুর গ্রামের আলুচাষি মজিবুর রহমান জানান, ১ হাজার ৫০ টাকার ডিএপি ১ হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৭০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। অন্যদিকে ১ হাজার ৩৫০ টাকার টিএসপি কিনতে হচ্ছে ২ হাজার টাকায় এবং ১ হাজার টাকা বস্তার এমওপি কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ৩০০ টাকায়। তানোরের সার ডিলার মাইনুল ইসলামের দাবি, টিএসপি সারের চাহিদা বেশি। তানোরে আলু আবাদের জমির পরিমাণ বেশি। অন্য উপজেলায় কম। কিন্তু বরাদ্দের ক্ষেত্রে চাহিদা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। যেখানে চাহিদা বেশি, সেখানে বেশি বরাদ্দ দরকার। সমিতির মাধ্যমে আমরা বরাদ্দ কমিটিকে অনেকবার বলেছি। তবে তিনি বেশি দামে সার বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করেন।

খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে সেচের সুবিধা থাকায় আলুসহ বিভিন্ন ফসল চাষে চাষিরা ঝুঁকেছেন। এসব ফসল আবাদে বিপুল পরিমাণ সার লাগে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বরেন্দ্র এলাকার নাচোলের রাজাবাড়ী, নওগাঁর নিয়ামতপুর, মান্দাসহ বিভিন্ন এলাকায় সার পাচার সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই পাচার সিন্ডিকেটের সঙ্গে সার মনিটরিং কমিটির কর্মকর্তাদের গভীর যোগসাজশ রয়েছে। জানা যায়, ইতোমধ্যে রাজশাহীর বাগমারা ও দুর্গাপুরে সার পাচারের সময় বঞ্চিত কৃষকরা বিপুল পরিমাণ সার জব্দ করেন। তবে প্রশাসন পাচারকারীদের নামমাত্র জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। কৃষক বলছেন, সার পাচার ও কালোবাজার সিন্ডিকেটের অবৈধ তৎপরতা বন্ধে রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলজুড়ে অভিযান প্রয়োজন। পাশাপাশি পাচারে সহায়তাকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম