‘বড় পদে যাওয়ার ইচ্ছাই কাল হলো দিপুর’
গ্রেফতার আরও ২, বিক্ষোভ
ময়মনসিংহ ব্যুরো
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ময়মনসিংহের ভালুকায় গণপিটুনিতে নিহত দিপু চন্দ্র দাসের ছোট ভাই অপু চন্দ্র দাস বলেছেন, কোম্পানির বড় পদে যাওয়ার ইচ্ছাই আমার ভাইয়ের জন্য কাল হয়েছে। কিছুদিন আগে বড় পদের জন্য সাক্ষাৎকার দিয়ে সে প্রথম হয়। কোম্পানিতে তার পাঁচজন প্রতিযোগী ছিল। এরাই শত্রুতা করে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে কারখানার ভেতরে ও বাইরে উসকে দিয়েছে। রোববার যুগান্তরকে এসব কথা বলেন তিনি। এদিন যুগান্তরকে প্রায় একই কথা বলেছেন দিপুর বাবা, স্ত্রী ও বোন।
পিটিয়ে হত্যার পর লাশ গাছে ঝুলিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় আরও দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এরা হলো-আশিকুর রহমান ও কাইয়ুম। শনিবার রাতে হবিরবাড়ি ইউনিয়নের কাশর থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে মোট ১২ জন গ্রেফতার হলো। কোর্ট ইন্সপেক্টর শেখ মোস্তাছিনুর রহমান জানিয়েছেন, এর মধ্যে তিনজনের ৫ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। কাল (আজ) ভালুকা আমলি আদালতে এ নিয়ে শুনানি হবে। প্রতিষ্ঠানের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, উত্তেজিত জনতা কারখানার প্রধান ফটকের বাইরে থেকে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে পকেট গেট খুলে দিপুকে জনতার হাতে তুলে দেয় ফ্লোর ইনচার্জ আলমগীর হোসেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এরপর উত্তেজিত জনতা দিপুকে গণপিটুনি দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান। পরে গলায় রশি বেঁধে ডুবালিয়াপাড়া থেকে টেনেহিঁচড়ে তিন কিলোমিটার দূরে জামিরদিয়া মাস্টারবাড়ি এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নিয়ে আসে। ডিভাইডারের একটি গাছে ঝুলিয়ে লাশে আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ হত্যাকাণ্ডে শুক্রবার অপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ১৫০ জনকে আসামি করে ভালুকা থানায় মামলা করেন। তিনি বলেন, আমার ভাই বিএ পাশ। সে মানুষের সঙ্গে সব সময় ভালো আচরণ করত। কোম্পানির উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সে অধস্তন শ্রমিকদের চাপ দিত। যে কারণে ভাইয়ের সহকর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিল।
দিপুর স্ত্রী মেঘনা রানী দাস বলেন, ‘অপবাদ দিয়ে আমার স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে জনতার হাতে তুলে দিয়েছে কোম্পানির লোকেরাই। দেশে আইন আছে, বিচার আছে, তাহলে আমার স্বামীকে কেন পুলিশের হাতে তুলে দিল না। অন্যায় করে থাকলে কেন তাকে বরখাস্ত করে কারখানা থেকে বের করে দিল না।’ তিনি বলেন, ‘আজ আমার পরিবার নিঃস্ব। আমার স্বামী ছিল পরিবারের একমাত্র আয়ের মানুষ। এখন আমাকে এবং আমার দুধের শিশুকে কে দেখবে।’
জ্যাঠাতো বোন চম্পা দাস বিলাপ করে বলেন, তাকে পিটিয়ে হত্যার খবর শুনে তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই ঘটনাস্থলে। নিজের নিরাপত্তা ও ঘটনার আসল খবর নিতে হাতের শাঁখাও খুলে ফেলি। সিঁদুর মুছে ফেলি। গাছের ডালে ঝুলানো লাশের কাছে যাই। এ সময় আমার আবেগ ও মনের অবস্থা বুঝে কয়েকজন ভালো মনের মানুষ সেখান থেকে চলে যেতে বলেন। আমি বুকে পাথর বেঁধে ফিরে আসি এবং আমার ছোট ভাইকেও লাশের পাশে যেতে বাধা দেই। তিনি অভিযোগ করেন, আমার ভাই টাচ মোবাইল ব্যবহার করত না, সাধারণ বাটন মোবাইল ব্যবহার করত। ধর্ম নিয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। নবীজীকে নিয়ে কটূক্তি করার মতো মানুষ সে নয়। কয়েকটি সুরা জানত ও বলতে পারত।
দিপুর বাবা রবি চন্দ্র দাস বলেন, আমার ছেলে ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমি ছেলে হত্যার সঠিক বিচার চাই।
একাধিক শ্রমিক-সহকর্মী জানান, দিপু দীর্ঘদিন ধরে কারখানায় উৎপাদন বাড়ানো, ওভারটাইম, কাজের পরিবেশ ও শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন। সম্প্রতি পদোন্নতি পরীক্ষায় সে প্রথমও হয়। এ নিয়ে কারখানার একটি বিশেষ মহল ও সহকর্মীদের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। একপর্যায়ে তাকে কারখানা থেকে বের করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু হয়। বৃহস্পতিবার কারখানার জুনিয়র কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর মো. সেলিম মিয়া ও জুনিয়র অপারেটর মোছা. রহিমা বেগম নামাজ নিয়ে কথা বললে দিপু মহানবী (সা.) কে নিয়ে কটূক্তি করেন মর্মে কথা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এ নিয়ে কারখানায় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। দিপুর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে কারখানার সিকিউরিটি ইনচার্জ সার্জেন্ট মশিউর রহমান (অব.) তাকে ১ নম্বর গেটসংলগ্ন সিকিউরিটি রুমে নিয়ে যান। শ্রমিকরা আরও জানান, ঘটনার দিন কারখানার ভেতরে দিপুকে হুমকি ও মারধর করা হয়। এরপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গ্রুপ গেটের বাইরের লোকজনকে খবর দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কারখানার সামনে বিক্ষোভ শুরু হয়।
র্যাব-১৪ এর আভিযানিক দল ঘটনার ভিডিও বিশ্লেষণ এবং স্থানীয়ভাবে তথ্য সংগ্রহ করে জড়িত শুক্রবার রাতেই ৭ জনকে গ্রেফতার করে। ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নয়মুল হাসান বলেন, ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেছে, এমন বক্তব্যের প্রমাণ পাইনি। ঘটনার পেছনের কারণ ও হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতারে কাজ করছি।
পুলিশ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, পুলিশের একাধিক টিম সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িতদের শনাক্ত ও গ্রেফতারের চেষ্টা করছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িত কোম্পানির ভেতরে ও বাইরে অনেকের নাম পেয়েছি। খুব শিগগিরই হত্যার মোটিভ উদ্ঘাটন হবে।
ময়মনসিংহে বিক্ষোভ : হত্যার বিচার দাবিতে রোববার বিকালে ময়মনসিংহ নগরীর ফিরোজ-জাহাঙ্গীর চত্বরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে সচেতন সনাতনী সমাজ। এতে বক্তৃতা করেন ডা. ভবতোষ কর্মকার, বিজয় চৌধুরী, টোটন ভট্টাচার্য, শংকর সরকার, সঞ্জয় দত্ত, প্রান্ত সরকার, সুবল পন্ডিত, লিমন দেবনাথ প্রমুখ।
অপরদিকে এদিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তারা কারখানার সামনে এবং পুড়িয়ে মারার স্থানে পৃথক মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন। এতে বক্তৃতা করেন গার্মেন্টস ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহসভাপতি জলি তালুকদার, কমিউনিস্ট পার্টি, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সভাপতি কমরেড অ্যাডভোকেট এমদাদুল হক মিল্লাত, গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ বিশ্বাস, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশনের নেত্রী তসলিমা আক্তার বিউটি, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ চৌধুরী।
ঢাবিতে ছাত্রদলের বিক্ষোভ : ঢাবি প্রতিনিধি জানান, ভালুকায় পোশাক শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাসকে হত্যার পর পোড়ানো এবং লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতার শিশুকন্যা আয়েশা আক্তারকে পুড়িয়ে হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল। সেই সঙ্গে দেশজুড়ে চলা ‘মব সন্ত্রাসের’ বিচার দাবি করা হয়েছে। রোববার দুপুরে ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) থেকে মিছিলটি বের করা হয়। পরে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ হয়। এতে কেন্দ্রীয় সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব, ঢাবি ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বক্তৃতা করেন।
সমাবেশে গুলিতে নিহত ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি প্রসঙ্গে রাকিব বলেন, ‘আজকের মধ্যেই তার হত্যাকারীরা কারা, কোথায় রয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা জাতির সামনে প্রকাশ করতে হবে।’
