পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
মুক্তি সংগ্রামের সশস্ত্র প্রতিরোধের দলিল
পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পাকিস্তানিদের মোকাবেলার অসংখ্য কেতন রয়েছে এখানে
মাহমুদুল হাসান নয়ন
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
পাকিস্তানিদের মর্টারশেলের আঘাতে এমটি শেডের লোহার পিলারের স্থায়ী ক্ষত এখনও বিদ্যমান। পুলিশপ্রধানকে ভাওয়াল রাজার দেয়া ঘোড়ার গাড়িটি বয়ে চলছে হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার চিহ্ন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র হামলার এমন অসংখ্য নিদর্শন বয়ে চলছে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স। পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে পাকিস্তানিদের মোকাবেলায় পুলিশের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধের অসংখ্য কেতন রয়েছে যেখানে।
দেশজুড়ে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা এবং পুলিশের সশস্ত্র প্রতিরোধের এমন অসংখ্য নিদর্শন নিয়ে রাজধানীর রাজারবাগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। মুঘল আমল থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সময়ের ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ দলিল সংরক্ষিত হয়েছে জাদুঘরের আর্কাইভ শাখায়। বঙ্গবন্ধুর দুর্লভ আলোকচিত্রের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দুই হাজার প্রকাশনা দিয়ে সাজানো হয়েছে এর লাইব্রেরি। বাংলাদেশ পুলিশের উদ্ভব এবং স্বাধিকার আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা ও আত্মদানের স্মৃতিস্মারক সংরক্ষিত রয়েছে এ জাদুঘরে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত প্রায় ১৪ হাজার পুলিশ সদস্য কর্মস্থল ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন এবং বিভিন্নভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা দেন। পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধে অশগ্রহণকারী পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধ ছেড়ে কর্মস্থলে যোগদানের ঘোষণা দেয়। তৎকালীন আইজিপি আবদুল খালেক রেডিওতে দেয়া ভাষণের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কর্মস্থলে যোগ না দেয়ার উদাত্ত আহ্বান জানান। আইজিপি আবদুল খালেকের ভাষণের সেই কপি সংরক্ষিত রয়েছে জাদুঘরে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগে অবস্থিত তৎকালীন পুলিশের কেন্দ্রীয় ওয়্যারলেস বেজ স্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন পুলিশ লাইন্সে পাঠানো বার্তাও সংরক্ষিত রয়েছে এখানে। বার্তাটি ছিল- ‘বেইজ ফর অল স্টেশনস, ভেরি ইমপোর্টেন্ট মেসেজ। প্লিজ কিপ নোট। বেইজ ফর অল স্টেশনস অব ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ। কিপ লিসেন, ওয়াচ। উই আর অলরেডি অ্যাটাক্ট বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ। ওভার অ্যান্ড আউট।’ বেতার অপারেটর শাহজাহান মিয়া রাত সাড়ে ১১টার দিকে ‘হেলিকপ্টার ব্যাজ’ মডেলের একটি বেতারযন্ত্র থেকে এ বার্তাটি পাঠান। মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত বেতার যন্ত্রটি এখন স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।
জাদুঘরে ঢুকলে প্রথমেই রয়েছে বঙ্গবন্ধু গ্যালারি। এরপর দু’পাশের দেয়ালে বঙ্গবন্ধুর ২০টি বাণী রয়েছে। এছাড়া সালামি গার্ডের সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন, অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে পুলিশ সদস্যদের মাঝে বিতরণ, পাগলা ঘণ্টা বাজিয়ে শত্র“ মোকাবেলার ইতিহাস সংরক্ষিত রয়েছে এ জাদুঘরে। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত থ্রি নট থ্রি রাইফেল, শহীদ এসআই শিরু মিয়ার পাকিস্তানি বাহিনীর গতিরোধ, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদান এবং পাটগ্রাম থানা পরিদর্শন বইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মন্তব্যসহ স্বাধীনতা সংগ্রামের অসংখ্য জীবন্ত দলিল।
২০১৩ সালের ২৪ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের টেলিকম ভবনে প্রথম জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়। আর এখনকার ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে পুলিশ স্মৃতিস্তম্ভের ঠিক পাশেই। জাদুঘরটিতে মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশ সদস্যদের ব্যবহৃত রাইফেল, বন্দুক, মর্টারশেল, ইউনিফর্ম, টুপি, চশমা, হাতব্যাগ ও মানিব্যাগ রাখা হয়েছে। নিচতলার দেয়ালজুড়ে সেঁটে দেয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্যদের যুদ্ধের সময়ের ডায়েরি, হাতে লেখা বিভিন্ন বার্তা, আলোকচিত্র ও পোস্টার। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরতে রয়েছে ‘প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনী হল’। এছাড়া ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত পুলিশের বিভিন্ন অস্ত্র ও সরঞ্জাম স্থান পেয়েছে এখানে। রয়েছে পুলিশপ্রধানকে দেয়া ভাওয়াল রাজার ঘোড়ার গাড়িটি। ২৫ মার্চের নৃশংসতা এ গাড়িটি এবং আস্তাবলে রক্ষিত ঘোড়াও আক্রান্ত হয়েছিল।
সম্প্রতি সাধারণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয় ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’। এরই অংশ হিসেবে রাজধানীর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের জাদুঘর পরিদর্শনে আনা হয়। শিক্ষার্থীদের ইতিহাস জানাতে জাদুঘরটিতে কাজ করছেন পুলিশের একজন সহকারী মহাপরিদর্শক, একজন অতিরিক্তি পুলিশ সুপার, একজন সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার, দুইজন পরিদর্শকসহ প্রায় ২০ জন।
বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় স্কুল হিসেবে জাদুঘর পরিদর্শনে আসে ধানমণ্ডির ব্রিটিশ কলাম্বিয়া স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ৫০ সদস্যের একটি দল। এভাবে পর্যায়ক্রমে ৫০টি স্কুলের শিক্ষার্থীদের জাদুঘরটি পরিদর্শনে আনার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে এ কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীদের নিয়ে আসার চিন্তা রয়েছে তাদের।
জাদুঘর পরিদর্শন শেষে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী রায়হান হোসেন শাফি যুগান্তরকে বলে- খুবই ভালো লেগেছে। যুদ্ধের সময় কী হয়েছে, তা আরও ভালোভাবে আজ জানা হল। কীভাবে পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর অন্যায়ভাবে আক্রমণ করেছে তাও জানতে পেরেছি। স্কুলটির সিনিয়র শিক্ষক শামীমা রহিম যুগান্তরকে বলেন, আমরা যুদ্ধ দেখিনি। ফলে অনেক সময় যুদ্ধের ইতিহাসের অনেক কিছুই অজানা থেকে যায়। বাচ্চারাও অনেক ইতিহাস জানে না। এখন তারা এখানে আসছে, দেখছে। এটা অত্যন্ত আনন্দের যে, ছোটবেলা থেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেলিব্রেটি হিসেবে জাদুঘর পরিদর্শনে যোগ দেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার কাজী নুরুল হাসান সোহান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গল্প-আড্ডায় অনেক কিছু শেখার সুযোগ হল। আগে ২৫ মার্চের নৃশংসতার কথা কেবলই শুনেছি। আজ দেখলাম। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকা দরকার।
জাদুঘরটির সহকারী পরিচালক সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার শেখ নজরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রত্যেকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একজন করে সেলিব্রেটি নিয়ে আসছি; যাতে শিক্ষার্থীদের মানসপটে ইতিহাসগুলো গেঁথে থাকে। রাজধানী দিয়ে শুরু করলেও আমরা এ কার্যক্রমকে আরও বিস্তৃত করে ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে দিতে চাই।
জাদুঘরটির দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারজানা ইমরোজ যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ মানুষের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পৌঁছে দিতে আমাদের এ উদ্যোগ। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ পুলিশই করেছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে দেশের জন্য লড়াই করেছে। সেই গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে আমরা সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই।
জাদুঘরের পরিচালক ও পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাটা কেবল প্রয়োজন নয়, বরং অবশ্য কর্তব্য। আমরা ইতিহাস জানার সুযোগ সৃষ্টিতে কাজ করছি। দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমাদের এ উদ্যোগ। আমরা চাই, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস জেনে বড় হোক।
