জলবায়ু তহবিলে মহাদুর্নীতি : জড়িতদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে
সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ০৬ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
‘বাংলাদেশ জলবায়ু তহবিল’র (বিসিসিটি) ৫০ শতাংশেরও বেশি অর্থ নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে নষ্ট হওয়ার বিষয়টি দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে একটি ‘অশনিসংকেত’। মঙ্গলবার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত এ তথ্য তুলে ধরা হয়। টিআইবির গবেষণা অনুযায়ী, ২০১০-২০২৪ সময়কালে বিসিসিটির অধীনে মোট ৮৯১টি প্রকল্পে প্রাক্কলিত তহবিল বরাদ্দ অনুমোদনের পরিমাণ ছিল ৪৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে ২৪ কোটি ৮৪ লাখ ডলার বা ২ হাজার ১১০ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মহল, বিসিসিটি বোর্ড সদস্য এবং বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের একটি অংশ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সর্বাধিক ঝুঁকিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। বলা যায়, জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য বড় হুমকি। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা-সব মিলিয়ে প্রতিবছর ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্থের প্রয়োজন হয় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাত মোকাবিলায়। অথচ ২০০৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও জাতীয় তহবিল মিলিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এই নগণ্য পরিমাণ অর্থের মধ্যেও যদি ২০০ কোটির বেশি টাকা দুর্নীতি ও অপচয়ে নষ্ট হয়ে যায়, তবে তা কেবল অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, বরং দেশের কোটি কোটি প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর সরাসরি আঘাত। এ অর্থ লুটপাটের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হওয়া সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী, যারা ত্রাণ নয়, বরং টেকসই অভিযোজন প্রকল্প আশা করে, তারা ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
জলবায়ু তহবিল মূলত জনগণের অর্থে গঠিত। এটি কোনো অনুদান নয়, এটি জনগণের অধিকার। এই তহবিলের অর্থ রাজনৈতিক বিবেচনা, যোগসাজশ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অপচয় হওয়া এক ধরনের রাষ্ট্রীয় অপরাধ। বস্তুত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবিলার সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। তাই এমন দুর্নীতি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য কঠোর পদক্ষেপ অপরিহার্য। পরিস্থিতির উন্নয়নে পিআইবি ৯ দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন ২০১০ সংশোধন করতে হবে; তহবিলের তদারকি ও নিরীক্ষার জন্য পৃথক ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে এবং অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে।
আমরা মনে করি, টিআইবির সুপারিশগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে বিসিসিটি আইন সংশোধন, তহবিলের তদারকি ও নিরীক্ষার জন্য একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান জরুরি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, দুর্নীতি ও অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু অর্থায়নে প্রকৃত উপকারভোগীদের অংশগ্রহণ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে টেকসই উন্নয়ন কেবল একটি স্বপ্নই থেকে যাবে। জনগণের অর্থ সুরক্ষার পাশাপাশি জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর জন্য বিশ্বমঞ্চে কথা বলার নৈতিক ভিত্তিও সুদৃঢ় করতে এই দুর্নীতি এখনই কঠোর হাতে দমন করা প্রয়োজন।
