Logo
Logo
×

সম্পাদকীয়

বিশ্বায়ন ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য

Icon

সোহানুর রহমান সুমন

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বায়ন ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য

বিশ্বায়ন বলতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাণিজ্য সম্পর্ক পরিবর্ধনের মাধ্যমে স্থানীয় ও জাতীয় অর্থনীতিকে একটি একক বৈশ্বিক অর্থনীতিতে একীভূতকরণের প্রক্রিয়া বোঝায়। গত শতকে পরিবহন ও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতির ফলাফল হচ্ছে বিশ্বায়ন। যদিও প্রাথমিকভাবে এটি একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া, তবে এর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব কোনোভাবেই উপেক্ষা করার মতো নয়।

গত শতকে মানবজাতি যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থায় এক সরলরৈখিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে। পরিবহন ক্ষেত্রে এ উন্নয়ন দ্রুত পণ্য পরিবহন সহজ করেছে। ফলে জাতিগুলো নিজেদের মধ্যে ব্যাপকভাবে পণ্যের বিনিময় শুরু করেছে। ফলাফল হচ্ছে- প্রতিটি জাতিই বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় একে অপরের ওপর নির্ভরশীল, কোনো দেশ বা জাতির এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার সুযোগ নেই।

তবে এ প্রক্রিয়া শুধু পণ্যের বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না, এখন বিনিময় ঘটছে সাংস্কৃতি বোধেরও। বিশ্বায়ন সাংস্কৃতিক বিনিময়ের যে বিশাল ক্ষেত্র তৈরি করেছে তার মাধ্যমে মূলত পাশ্চাত্যের মূল্যবোধেরই প্রসার ঘটছে। ফলে অনেক দেশের সংস্কৃতি ক্রমবর্ধমানভাবে একটি পাশ্চাত্যকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ প্রক্রিয়া পৃথিবীর সর্বত্রই ঘটছে। যদিও দেশ ও জাতিভেদে এ পরিবর্তনের গতি ভিন্ন, তবে এ পরিবর্তন অস্বীকার করার উপায় নেই।

সাংস্কৃতিক এ পরিবর্তন থেকে বাঙালি সংস্কৃতিও রেহাই পাচ্ছে না। আমাদের এখানেও ক্রমান্বয়ে দেশীয় সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের স্থানে জায়গা করে নিচ্ছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ। এখন আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে এ পরিবর্তন আমাদের আসলেই কাম্য কি না বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ আমাদের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি না।

বাঙালি সংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতির জীবনদৃষ্টির মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিসৌধ গড়ে উঠেছে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য (ইনডিভিজুয়ালিজম) ও ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণাকে ভিত্তি করে। এ দুটি ধারণাকে পাশ্চাত্য যে আঙ্গিকে গ্রহণ করেছে তার সারমর্ম হচ্ছে, ব্যক্তির ওপর সামাজিক প্রথা বা মূল্যবোধের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এবং ব্যক্তির ওপর পরিবার বা সমাজ কোনো দায়িত্বভার বা কর্তব্য চাপিয়ে দিতে পারবে না।

পাশ্চাত্যে এ দুটি ধারণাকে আত্তীকরণের ফলস্বরূপ সেখানে সমাজ অনেকটাই অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে এবং পারিবারিক সম্পর্কগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। সেখানে ব্যক্তি সমাজ বা পরিবারের প্রতি খুব একটা দায়িত্ব বা কর্তব্যবোধ অনুভব করে না। সর্বোপরি, পাশ্চাত্যের এমন জীবনদৃষ্টি একটি আত্মকেন্দ্রিক জাতি জন্ম দিয়েছে।

অপরদিকে, আমাদের রয়েছে একটি সমৃদ্ধ কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। আমাদের ব্যক্তিজীবনে পরিবার ও সমাজ সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়ে থাকে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় শিশুদের সামাজিকীকরণে পরিবার ও সমাজকে ব্যক্তির উপরে স্থান দেয়ার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে শেখানো হয় এবং একজন দায়িত্ববান ও মানবিক মানুষ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয় শৈশব থেকেই।

তবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির হাওয়া লাগায় আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি এখন অনেকটাই বিপর্যয়ের মুখে। এর প্রভাবে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হতে শুরু করেছে। দাম্পত্য সম্পর্কে ভাঙন ধরছে। তরুণরা আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী জীবনাচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। পাশ্চাত্য মূল্যবোধের এমন বিকাশ কোনোভাবেই কাম্য নয়।

বিশ্বায়ন আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পৃথিবীর জাতিগুলোকে কাছে নিয়ে এসেছে। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাব পড়ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ভারতীয় উপমহাদেশ হাজার বছরে শত বহিঃআক্রমণের মুখেও তার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রেখেছে।

বর্তমান সময়েও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে আমাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।

সোহানুর রহমান সুমন : যুগ্ম সাধারণ সম্পাক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব; শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাবি

 

বিশ্বায়ন

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম