গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জে মনোপলি ব্যবসা
মাশুল গুনছেন যাত্রীরা
চার কারণে টিকিটের দাম লাগামহীন * বাংলাদেশে উড়োজাহাজ গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং খরচ আকাশচুম্বী
ফাইল ছবি
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
ঢাকায় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা প্রদানকারী একমাত্র কোম্পানি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এখানে একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ হিসাবে দিতে হয় ৩ লাখ ৫ হাজার ৯৫০ টাকা। বিদেশি এয়ারলাইনসের জন্য এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কয়েকগুণ বেশি খরচ করেও বিমানের কাছ থেকে চুক্তি মোতাবেক সব ধরনের সার্ভিস না পাওয়ার অভিযোগ বেশ পুরোনো। ফলে যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে এয়ারলাইনসগুলোকে বাড়তি খরচের গচ্চা দিতেই হচ্ছে।
এদিকে একই উড়োজাহাজের এ ধরনের সেবার জন্য মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে লাগে মাত্র ৮০০ ডলার (প্রতি ডলার ১২১.৬৮ টাকা হিসাবে ৯৭ হাজার ৫৪৫ টাকা)। পার্শ্ববর্তী কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এয়ারবাস এ৩২০ মডেলের একটি উড়োজাহাজের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ ৬৩১ ডলার বা ৭৬ হাজার ৭৮০ টাকা। আর ঢাকার হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একই মডেলের উড়োজাহাজ থেকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ আদায় করা হয় ২ হাজার ২০০ ডলার বা ২ লাখ ৬৭ হাজার ৬৯৬ টাকা। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা নিতে গিয়ে এয়ারলাইনসগুলোকে প্রতিবেশী ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে কয়েকগুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও ড. মো. সাফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা একটা প্যাকেজ হিসাবে চার্জ নির্ধারণ করি। সব ধরনের সেবা ওই প্যাকেজের মধ্যে থাকে। কিন্তু অন্যান্য দেশে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ আলাদা আলাদা ভাগ করে চার্জ নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে মনে হয় আমাদের চার্জ বেশি। কিন্তু ওদের সব মেলালে চার্জ একই হবে।’ চুক্তির বাইরে এয়ারলাইনসগুলোকে নিজস্ব জনবল দিয়ে কাজ চালাণোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ নিরবচ্ছিন্ন করতে নতুন করে এক হাজারের বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ শেষে চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। শুধু কিছু হেলপার বাকি আছে। এক মাসের মধ্যে সেগুলোও নিয়োগ হয়ে যাবে। আমাদের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কারণে কোনো ফ্লাইট ডিলে হচ্ছে কিনা তা জানতে চেয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’
থার্ড টার্মিনাল চালু হলে সংকট সৃষ্টি হবে কিনা-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘থার্ড টার্মিনালে গেলে আমাদের আরও সুবিধা হবে। এখানে অনেক কিছুই অটোমেশন করা এবং ভেতরে অনেক স্পেস আছে। থার্ড টার্মিনালে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজের জন্য ইতোমধ্যে প্রায় ১৬০ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে। এছাড়া প্রায় আড়াই হাজার জনবল দাতা সংস্থা জাইকার মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।’
সূত্র জানায়, শুধু ভারত বা মালয়েশিয়া নয়, মিয়ানমার, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও চীনসহ বিভিন্ন দেশে ঢাকার চেয়ে অনেক কম খরচে উড়োজাহাজের গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা পাচ্ছে এয়ারলাইনসগুলো। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং ব্যবসায় বিমানের এই মনোপলির প্রভাব পড়ছে টিকিটের দামে। যার মাশুল গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের পাশাপাশি অতিরিক্ত ভ্রমণ কর, বিমানবন্দরে এয়ারক্রাফট ল্যান্ডিং, পার্কিং ও নিরাপত্তায় অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে টিকিটের দাম এখন লাগামহীন। একাধিক সূত্রে উল্লিখিত তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে কার্যক্রম থাকা আকাশ পরিবহণ সংস্থাগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধিদের সংগঠন এয়ারলাইনস অপারেটরস কমিটি (এওসি) ঢাকার তথ্যমতে, হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজভেদে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবা নিতে খরচ হয় ২ হাজার ২০০ থেকে ৬ হাজার ডলার। কার্গো উড়োজাহাজের জন্য অতিরিক্ত কেজিপ্রতি আরও শূন্য দশমিক ৭ ডলার খরচ হয়। এভাবে বিপুল টাকা খরচ করলেও এয়ারলাইনসগুলোকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কাজের জন্য ঢাকায় নিজস্ব গাড়ি ও জনবল রাখতে হচ্ছে। কোনো কোনো এয়ারলাইনস অর্ধশতাধিক করে জনবল নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং হলো একটি বিমান মাটিতে থাকা অবস্থায় যাত্রীদের মালামাল উঠানো-নামানো, বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, কার্গো হ্যান্ডলিং এবং যাত্রীদের বোর্ডিং পাশ ইস্যু ও অন্যান্য পরিষেবা প্রদানের কাজ। এটি একটি বিমানের নিরাপদ, দক্ষ ও নিরবচ্ছিন্ন পরিচালনা নিশ্চিত করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সঠিক পরিচালনা একটি বিমানকে দ্রুত ও নিরাপদে উড়তে সাহায্য করে। যাত্রী এবং মালামালের সঠিক পরিচালনা বিমানের সময়সূচি বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি বিমানবন্দরের সামগ্রিক পরিচালনা ও কার্যকারিতা বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ৩৮টি বিদেশি এয়ারলাইনস। তাদের মোট কর্মীর সংখ্যা ১ হাজার ১৫০ জন। চুক্তি অনুযায়ী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সব ধরনের কাজের দেশি-বিদেশি উড়োজাহাজ অপারেটররা অর্থ পরিশোধ করছে। এরপরও সেবার মান নিশ্চিত করতে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ দিতে বাধ্য হচ্ছে। এটা করতে না হলে অপারেটরদের কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৮ গুণ কম রাখা সম্ভব হতো।
প্রযুক্তির সহায়তায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, বিশ্বের কোথাও এককভাবে কোনো একটি সংস্থা বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের কাজ করে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এই কাজটি করে থাকে। তবে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস স্বাধীনতার পর থেকে এককভাবে এই কাজটি করে আসছে। বিদেশি একটি এয়ারলাইনসের একজন কর্মকর্তা জানান, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সেবার জন্য বাড়তি খরচ করার পরও, একই কাজে আলাদা জনবল নিয়োগ দিয়ে ঢাকায় ফ্লাইট পরিচালনা করায় ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। কোনো এয়ারলাইনসই বাড়তি খরচের বোঝা নিজেদের কাঁধে নেবে না। তারা টিকিটের দাম বাড়িয়ে এই টাকা তুলছে।
এয়ারলাইনস খাতের বিশ্লেষকদের মত, বাংলাদেশের বিমানবন্দরগুলোয় গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং কাজে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ছাড়া অন্য কোনো সংস্থা নেই। এ কারণে কোনো বিকল্প না থাকায় বিমানের এই মনোপলির বাড়তি চার্জ দিতে বাধ্য হচ্ছে। একটি এয়ারলাইনসের পরিচালন ব্যয়ের অন্যতম খাত গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং চার্জ। এছাড়া সিভিল এভিয়েশনের পার্কিং, ল্যান্ডিং চার্জ, নানা ধরনের ট্যাক্স মিলিয়ে পরিচালন ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এ ব্যয় এবং কাঙ্ক্ষিত মুনাফা ধরে এয়ারলাইনসগুলো টিকিটের দাম নির্ধারণ করে। বাংলাদেশ সবকিছুতে উচ্চহার নির্ধারণ করায় টিকিটের দামও লাগামহীন। আর শেষ পর্যন্ত এর মাশুল যাত্রীকেই গুনতে হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাটিক এয়ারলাইনসে ঢাকা-কুয়ালালামপুর যাতায়াত ভাড়া ৪৯ হাজার ৯৯৩ টাকা, একই এয়ারলাইনসে দিল্লি-কুয়ালালামপুর যাতায়াতে খরচ ৩৫ হাজার ৩২৬ টাকা, এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে ঢাকা-জেদ্দা যাতায়াত ভাড়া ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩৮ টাকা, একই এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে দিল্লি-জেদ্দা যাতায়াত ভাড়া অর্ধেকের কম ৫৭ হাজার টাকা।
এছাড়া বাংলাদেশে টিকিট থেকে কর আদায়ের পরিমাণও বেশি। ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে একক যাত্রার একটি টিকিট থেকে ১১ হাজার ১১৮ টাকা কর ও ফি আদায় করা হয়। অন্যদিকে কলকাতা থেকে কুয়ালালামপুরে একক যাত্রার একটি টিকিট থেকে কর ও ফি আদায় করা হয় ৬ হাজার ৭২১ টাকা, যা প্রায় অর্ধেক। ঢাকা থেকে ইন্দোনেশিয়ার বালি এয়ারপোর্ট পর্যন্ত একক যাত্রার একটি টিকিট থেকে কর ও ফি আদায় করা হয় ১৩ হাজার ৫৬৩ টাকা। কলকাতা বিমানবন্দর থেকে একই গন্তব্যে কর আদায় হয় ৮ হাজার ৩০৯ টাকা। ঢাকা থেকে সিডনি যাওয়ার একক টিকিটে যেখানে ২০ হাজার ৬৭৯ টাকা কর আদায় করা হয়, সেখানে কলকাতা থেকে একই গন্তব্যে কর আদায় করা হয় ১৪ হাজার ৯০১ টাকা। ঢাকা থেকে বিশ্বের প্রায় সব গন্তব্যে টিকিটে কর আদায়ের প্রায় একই অবস্থা। বাড়তি কর ও চার্জ কমানো হলে টিকিটের মূল্য অনেক কমে যাবে।
তবে সম্প্রতি একটি বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, উড়োজাহাজের টিকিটের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে বাজারে অবৈধভাবে প্রভাব বিস্তার করা এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে শাহজালাল বিমানবন্দরে নতুন নির্মিত থার্ড টার্মিনালে বিমানের পাশাপাশি আরও একটি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার নিয়োগ দেওয়া হতে পারে বলেও জানান তিনি।

