ঢাকায় অপরিকল্পিত নগরায়ণ
বছরে ক্ষতি জিডিপির ৬ থেকে ১০ শতাংশ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
এ দেশে একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পরিবারকেও ঢাকার গুলশান-বনানীতে থাকতে হয়। ঢাকাকেন্দ্রিক অতি এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে প্রতিবছর জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৬ থেকে ১০ শতাংশ।
গবেষকরা বলছেন, যানজট, উচ্চ তাপমাত্রাসহ নানা কারণে রাজধানীর নাগরিকদের উৎপাদনশীলতা কমছে। ঢাকার বদলে কোনো প্রান্তিক শহরে একই পরিমাণ বিনিয়োগে বেশি রিটার্ন পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে ঢাকাকে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বনানীতে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত এক সেমিনারে এসব তথ্য জনানো হয়।
সেমিনারে ‘আরবানাইজেশন অ্যান্ড বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট’ শীর্ষক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) এবং পিআরআই যৌথভাবে এটি পরিচালনা করেছে। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন, পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. খুরশীদ আলম। প্রধান অতিথি ছিলেন, পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন পিআরআইর পরিচালক ড. আহমেদ আহসান।
সেমিনারে জানানো হয়, জেলা শহরগুলোর উন্নয়ন ছাড়া জিডিপির কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়। জাদুর শহর ঢাকা। প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস এ রাজধানী শহরে। এর ওপর প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি মানুষের নানা কাজে আসা-যাওয়া এই শহরে। মানুষের ভারে ক্লান্ত ঢাকা। যানজট ও দূষণে কর্মক্ষমতা কমছে নাগরিকদের। অর্থনীতির হিসাবে অতি ঢাকামুখী জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্য শহরগুলোতে নাগরিক সুবিধা বলতে কিছু নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর সুনজর ছাড়া দেশের প্রান্তিক এলাকাগুলোর উন্নয়ন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে শুধু ঢাকার অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ না করে দেশের অন্য শহরগুলোতেও বিনিয়োগ করতে হবে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক লক্ষ্যের অভাবে এ দেশে ঢাকার বিকল্প কোনো শহর গড়ে ওঠেনি। এ দেশে একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের পরিবারকেও ঢাকার গুলশান-বনানীতে থাকতে হয়। বাস্তবতা হয়তো এরকমই। তিনি আরও বলেন, নীতি কাঠামোর দুর্বলতার কারণেও বাধ্য হয়ে সবাইকে ঢাকামুখী হতে হয়। এজন্য ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশে জমির স্বল্পতা থাকলেও পরিকল্পনাবিদদের চিন্তা জমিদারের মতো। কেননা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নিলেই বলা হয়, ১০০ একর জমি লাগবে। সচিবদের জন্য পাঁচ হাজার বর্গফুটের বাসা বানানো হয়। অথচ জাপানেও এসব কিছু অনেক ছোট করে বানানো হয়।
হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ভবিষ্যতে জমি ব্যবস্থাপনার বড় গবেষণাকেন্দ্র হতে পারে জেনেভা ক্যাম্প। সেখানে খুব অল্প জমির মধ্যে সবকিছু করা হয়। বিকেন্দ্রীকরণকে জোরদার করতে হলে স্থানীয় সরকারকে শুধু দায়িত্ব দিলে হবে না, ক্ষমতাও দিতে হবে। নগরায়ণের পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণও গুরুত্বপূর্ণ। তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের আলাপ ঐকমত্য কমিশনসহ কোনো টেবিলেই আনা যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে ঢাকা ছাড়া দ্বিতীয় শহর নেই, এটাই সমস্যা। চট্টগ্রাম দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। সেখানে আগে রেলওয়ে ও নৌবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ছিল। কিন্তু নীতি কেন্দ্রীভূত হওয়ায় সেগুলো সরিয়ে আনা হয়েছে। মফস্বল এলাকার ভিত্তি ছিল জেলা স্কুল। এখন সেগুলো নেই।
মূল প্রবন্ধে ড. আহমদ আহসান বলেন, নগরায়ণ দীর্ঘদিন ধরে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালিকাশক্তি হলেও বর্তমানে এর ঢাকাকেন্দ্রিক চরিত্র অসহনীয় হয়ে উঠছে। রাজধানীতে অতিরিক্ত জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ঘনত্ব, যানজট, দূষণ এবং অন্যান্য কারণে নাগরিকদের কর্মক্ষমতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে। এছাড়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির গতি কমাচ্ছে, শিল্প খাতে চাকরির সংখ্যা কমাচ্ছে এবং ৬-১০ শতাংশ অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে।
তিনি আরও বলেন, যদিও কিছু মানুষ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান ঢাকার বাইরে সরে যাচ্ছে, তা মূলত দ্বিতীয় স্তরের শহরগুলোকে এড়িয়ে ছোট শহর ও গ্রামীণ এলাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। এ অবস্থা নগরায়ণের সুফলকে খর্ব করছে এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে দুর্বল করছে। পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো নগরসেবা খাতের দুরবস্থা প্রধান অন্তরায় হিসাবে চিহ্নিত হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে গাজীপুরকে উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে শিল্পের গতিশীলতা শ্রমিকদের কল্যাণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
ড. আহসান আরও বলেন, জাতীয় নগরায়ণ নীতির অভাব, স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয়ের অনুপস্থিতি, নির্বাচিত নগর নেতা, কেন্দ্রীয় সংস্থা ও মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে বিচ্ছিন্ন শাসন ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দিয়েছে। তিনি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলকভাবে পরিচালনার ক্ষমতা ও সম্পদসহ ঐক্যবদ্ধ, বিকেন্দ্রীকৃত নগর সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে আলোচক হিসাবে বক্তব্য দেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মাতিন। তিনি বলেন, গবেষণায় অত্যন্ত খুঁটিনাটি ডেটা ব্যবহার করা হয়েছে, যা সচরাচর পাওয়া যায় না। এ ধরনের ডেটা নিয়মিতভাবে প্রণয়ন করতে বিবিএসকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তিনি ব্যয়বহুল ‘হারানো শহর’ প্রবণতার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে সম্পদ দ্বিতীয় স্তরের শহরগুলোকে এড়িয়ে গ্রামাঞ্চলে চলে যাচ্ছে। এর পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে চিহ্নিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিতে হবে।
পিআরআইর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষগুলো গঠনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সিটি করপোরেশনকে দুর্বল করা এবং ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা। নগরায়ণ দ্রুত বেড়েছে, কিন্তু সমানতালে নগর সুবিধা বাড়েনি। ফলে গভীর অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন না এলে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও বিকেন্দ্রীকরণ ‘অবাঞ্ছিত এজেন্ডা’ হিসাবেই থেকে যাবে।
