প্রতিমা বিসর্জনে শেষ হলো দুর্গোৎসব
আনন্দময়ী মায়ের বিদায়ে ভক্তকুলে বেদনার সুর
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
|
ফলো করুন |
|
|---|---|
আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় আনন্দময়ীর নিদ্রাভঙ্গের বন্দনায় যে উৎসবের শুরু হয়েছিল, দশমীতে বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হলো সেই দুর্গোৎসবের। পূজা, আরাধনা, আরতি ও ভক্তদের ঢল থেকে বিদায় নিলেন দেবী। বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা ও নানা আনন্দ আয়োজনের মাধ্যমে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে বিদায় জানিয়েছেন ভক্তকুল। মর্ত্যে (বাবার বাড়ি) বেড়ানো শেষে দোলায় চড়ে কৈলাসে (স্বামীর বাড়ি) ফিরে গেলেন ‘আনন্দময়ী’। দেবীর বিদায়ের আগে মণ্ডপে মণ্ডপে সিঁদুর খেলায় মেতে ওঠেন নারীরা। দুর্গার চরণের সিঁদুর নিয়ে নিজেদের রাঙিয়ে তোলেন তারা। এবার প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর পরিবেশে দুর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিমা বিসর্জন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সড়কে পুলিশের টহল ও নদীতে ছিল নৌপুলিশের টহল। ফায়ার সার্ভিসের টিমও দায়িত্ব পালন করে। এমনকি আকাশে হেলিকপ্টার উড়তে দেখা গেছে।
বৃহস্পতিবার বিকালে বুড়িগঙ্গা নদীর ওয়াইজঘাটের বীণাস্মৃতি স্নান ঘাটে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে রাজধানীতে দেবীকে বিদায় জানানোর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ঢাকের বাদ্য আর গান-বাজনা ছাড়া বিদায়ের করুণ ছায়ায় সারিবদ্ধভাবে একে একে বুড়িগঙ্গা নদীতে বিসর্জন দেওয়া হয় প্রতিমা। একই সময়ে তুরাগ নদীতে চলে বিসর্জন। এ উপলক্ষ্যে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ পাড়ে ভক্ত দর্শনার্থীদের ঢল দেখা যায়। অধিকাংশ মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হলেও ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমাটি রেখে দেওয়া হয়। কিন্তু পূজার কাজে ব্যবহৃত দেবীর ফুল, বেলপাতা ও ঘট বিসর্জন দেওয়া হয়। রাজধানীর প্রায় অর্ধশত মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয় ওয়াইজঘাটে।
এদিকে প্রতিমা বিসর্জনের উদ্দেশে বিকালে রাজধানীর ঢাকেশ্বরী মন্দির মেলাঙ্গন থেকে কেন্দ্রীয় বিজয়া শোভাযাত্রা বের হয়। সরেজমিন দেখা যায়, শোভাযাত্রায় অংশ নিতে দুপুর গড়িয়ে যেতেই ভক্তরা বিভিন্ন পূজামণ্ডপ থেকে ট্রাকে প্রতিমা নিয়ে সমবেত হতে শুরু করেন। সাদা-লাল শাড়ি, রঙিন পাঞ্জাবি ও ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত নারী-পুরুষ শোভাযাত্রার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকেন। ট্রাকভর্তি সাজসজ্জা, আলোকসজ্জা, বাদ্যযন্ত্র ও ভক্তদের নৃত্যে এলাকা যেন মেতে ওঠে উৎসবে। শিশুদের হাতে কাগজের পতাকা, কিশোরদের মুখে ঢাকের তালে নাচ-গান, আবার কোথাও মঙ্গলশঙ্খের ধ্বনি, সব মিলিয়ে পুরো পরিবেশ এক অনন্য ভক্তিময় আবহ তৈরি করে।
কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে প্রতিমা নিয়ে সদরঘাটের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, শিববাড়ি আবাসিক এলাকার শিবমন্দির, তেজগাঁও শাহীনবাগ সর্বজনীন পূজা কমিটি, আজিমপুর সরকারি আবাসন পূজা কমিটি, তেজগাঁও ফার্ম সরকারি প্রাথমিক হিন্দু কল্যাণ সমিতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার রামকৃষ্ণ ধর্মসভা, শাহজাহানপুর রেলওয়ে সর্বজনীন পূজা মন্দিরসহ শতাধিক ট্রাক শোভাযাত্রায় যুক্ত হয়। রঙিন সাজসজ্জা, ঢাক-ঢোল, শঙ্খধ্বনি আর ভক্তিগীতির সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজধানী। শোভাযাত্রাটি ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে শুরু হয়ে পলাশী মোড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর, সচিবালয়, গুলিস্তান হয়ে সদরঘাটে পৌঁছায়। সেখানে নির্দিষ্ট আচার-অনুষ্ঠান শেষে সম্পন্ন হয় দেবী দুর্গার বিসর্জন।
কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন পরিষদের আয়োজিত আরেকটি শোভাযাত্রা পলাশীর মোড় থেকে যাত্রা শুরু করে পুরান ঢাকার ওয়াইজঘাটে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে একে একে প্রতিমা বিসর্জন হয়। পাশাপাশি আশুলিয়া, বছিলা ও অন্য এলাকাতেও একইভাবে বিসর্জনের আয়োজন করা হয়। এর আগে সকাল থেকেই ঢাকেশ্বরীসহ রাজধানীর সব পূজামণ্ডপে চলে দেবী আরাধনা। সকাল ৯টার পর বিহিত পূজা, দর্পণ বিসর্জন ও ঘট বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দশমীর আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। দুপুরে সধবাদের সিঁদুর খেলায় অংশ নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মাতেন ভক্তরা। এবার রাজধানীতে ২৫৯টি এবং সারা দেশে মোট ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে ‘কাত্যায়নী মুনির কন্যারূপে’ মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব। মহালয়ার মধ্য দিয়ে ২১ সেপ্টেম্বর দুর্গোৎসবের ক্ষণগণনা ও আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এরপর রোববার মহাষষ্ঠী থেকে পাঁচ দিনের যে দুর্গোৎসব শুরু হয়েছিল, বৃহস্পতিবার প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এ আয়োজন শেষ হয়।
মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব বলেন, বিজয়া শোভাযাত্রা এখন আর শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় আচার নয়, বরং ঢাকার মানুষের জন্য এক মহাসাংস্কৃতিক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে। এই শোভাযাত্রা শুভ শক্তির জয় ও অশুভ শক্তির পরাজয়ের প্রতীক। মানুষ এখানে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মিলনের বার্তায় একত্রিত হয়। তিনি আরও জানান, দেবী দুর্গার বিদায় মানেই কেবল কৈলাসে ফিরে যাওয়া নয়। বরং মানুষের মনে আশার আলো জ্বেলে দেওয়া যে, আগামী বছর আবার দেবী ফিরে আসবেন।
জিবিএসপিএফের দুর্গোৎসব : এদিকে ‘সম্প্রীতির আলোকে সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন’ নিয়ে দেশের অন্যান্য স্থানের ন্যায় ঢাকার বনানীতে গুলশান-বনানী সর্বজনীন পূজা ফাউন্ডেশন (জিবিএসপিএফ) এর উদ্যোগে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। আয়োজকরা জানান, প্রতিবারের মতো এবারও প্রাণবন্ত ও উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। পূজামণ্ডপে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটেনের হাইকমিশনার সারাহ ক্যাথেরিন কুক, বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা, বাংলাদেশে নিযুক্ত নেপালের হাইকমিশনার ঘনশ্যাম ভান্ডারীসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা।
