Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ট্রাইব্যুনালে যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু

অভ্যুত্থানে হাসিনার দানবীয় সরকারের পতন ঘটে

আলমগীর মিয়া

আলমগীর মিয়া

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অভ্যুত্থানে হাসিনার দানবীয় সরকারের পতন ঘটে

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে জুলাই গণ-আন্দোলনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন-পর্ব শুরু হয়েছে। রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অনুষ্ঠিত শুনানি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এ সময় চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের কথা তুলে ধরে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্রমান্বয়ে দানবে পরিণত হওয়ার কারণেই চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। প্রথমে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তারা আমাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। পরে গুম-খুনের সংস্কৃতি চালু করে। এরপর নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। দেশে দুর্নীতি সর্বগ্রাসী রূপ পায়। এসবের মাধ্যমেই তারা (আওয়ামী লীগ সরকার) ক্রমান্বয়ে এক দানবীয় সরকারে পরিণত হয়েছিল। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ যুক্তিতর্ক উপস্থাপন হয়। শুনানির একপর্যায়ে বিচারকদেরও জবাবদিহি থাকা উচিত বলে অভিমত প্রকাশ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১।

যুক্তিতর্ক শুনানিপর্বে জুলাই আন্দোলন দমনে হত্যাযজ্ঞ ছাড়াও পিলখানা হত্যাকাণ্ড, র‌্যাবের গুম-খুন, একদলীয় শাসন, বিচার বিভাগ দলীয়করণ, প্রহসনের নির্বাচন, প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা, বিচারপতি খায়রুল হকের প্রতারণাসহ ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের নানা অপকর্ম উঠে আসে তাজুল ইসলামের বক্তব্যে।

এদিকে যুক্তিতর্ক সরাসরি উপস্থাপন সম্প্রচারের সময় চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে সাইবার হামলা হয়। চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক সরাসরি সম্প্রচারের সময় চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের ফেসবুক পেজে সাইবার অ্যাটাক (হামলা) হয়। ফেসবুক পেজটি সাময়িকভাবে ডিজেবল (নিষ্ক্রিয়) করে দিয়েছিল হামলাকারীরা। পরে সেটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম-খুনের অসংখ্য ঘটনা ঘটে। এমন একজন ঘাতক আছেন, যিনি বিরোধী মতের লোকদের হত্যায় কাজ করতেন। তিনি খুব কাছ থেকে মাথায় গুলি করতেন। ভুক্তভোগীর মাথার মগজ ও রক্ত ফিনকি দিয়ে ওই ঘাতকের শরীরে পড়ত। মগজ ও রক্তের গরম ঘাতকের অন্যরকম অনুভূতি হতো। এছাড়া বহু মানুষের মাথায় গুলি করে পেট কেটে সিমেন্টের বস্তা বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া হতো। হাত-পা বেঁধে রেললাইনে ফেলে রাখা হতো। বলা হতো ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে। এভাবে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক মানুষকে খুন করা হয়েছে, যার নির্দেশদাতা ছিলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে একে একে সাতজনকে খুন ও লাশ গুম করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লে. কর্নেল তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, মেজর আরিফ হোসেন ও লে. কমান্ডার এমএম রানা-তিনজনই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এভাবে গুমের সংস্কৃতি চালু হয়। সাতজনকে হত্যা ছিল র‌্যাবের প্রাতিষ্ঠানিক মানবতাবিরোধী অপরাধ।

তাজুল ইসলাম বলেন, জনগণকে নির্যাতন, হত্যা ও ভয়ভীতির রাজত্ব কায়েম করাই ছিল তাদের (আওয়ামী লীগ সরকারের) লক্ষ্য। এই দানবীয় শাসকই একপর্যায়ে ২০২৪ সালে আমাদের তরুণ-তরতাজা প্রজন্মের ওপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়।

গুলি চালিয়ে কিছু লোক মেরে ফেললে বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে : যুক্তিতর্কে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, গত বছরের ৪ আগস্ট রাতে শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিক বলেছিলেন, গুলি চালিয়ে কিছু লোক মেরে ফেললে বিক্ষোভ এমনিতেই দমন হয়ে যাবে। তিনি সেনাবাহিনী দিয়ে আন্দোলনকারীদের দমনের জন্যও বলেন হাসিনাকে। ওই রাতে ‘গ্যাং অব ফোর’ নামে পরিচিত আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শেখ হাসিনাকে কঠোর অবস্থানে যেতে বলেছিলেন। এর ফলে শেখ হাসিনার নির্দেশে পরদিন ৫ আগস্ট ঢাকাসহ সারা দেশে শত শত আন্দোলনকারীকে গুলি করে গণহত্যা চালানো হয়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর আগমুহূর্ত পর্যন্ত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ক্ষমতায় থাকার সব ধরনের অপচেষ্টা করেন। আন্দোলন দমনে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের ফোনালাপ থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনা আন্দোলন দমনে পুলিশ, বিজিবি মোতায়েনসহ আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশনা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন বিরোধী দল জাসদের প্রায় ৪০ হাজার নেতাকর্মীকে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার হত্যা করে, শত শত লোককে বিনা বিচারে আটক রাখে। হাজার হাজার লোক নির্যাতনের শিকার হয়। এমনকি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় নির্বাচনে জাসদপ্রধান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর এমএ জলিলকে প্রকাশ্য কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচনে পরাজিত ঘোষণা করা হয়।

চিফ প্রসিকিউটর বলেন, ২০১১ সালে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক বিতর্কিত রায়ের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল করেন। তিনি শেখ হাসিনার ক্ষমতাকে স্থায়ীকরণের লক্ষ্যে ২০১১ সালের ১০ মে সংক্ষিপ্ত আদেশে যে রায় প্রদান করেন, পরে তিনি তা পরিবর্তন করে সংবিধানের সঙ্গে প্রতারণা করেন। এর পুরস্কার হিসাবে অবসর গ্রহণের পর তাকে ‘আইন কমিশন’-এর চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়। একইভাবে বিচার বিভাগে কর্মরত অন্য বিচারকদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে বিচার বিভাগকে কলুষিত করেন।

তাজুল ইসলাম বলেন, গত সরকারের আমলে বিচার বিভাগ হয়ে উঠেছিল বিরোধী দল ও বাক্স্বাধীনতা দমনের মুখ্য হাতিয়ার। এ সময়ে মানবাধিকারকর্মী আদিলুর রহমান খান, এএসএম নাসির উদ্দিন এলান, সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানসহ অনেককে মিথ্যা মামলায় হাজতবাস ও কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ কুমার সিনহা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করেন। এ কারণে তৎকালীন ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে নির্যাতনের পর জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করে।

তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শেখ হাসিনার সরকার সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করতে ক্ষমতা গ্রহণের পরই ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় অবস্থিত বিডিআর সদর দপ্তরে তথাকথিত বিদ্রোহের নামে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন দেশপ্রেমিক চৌকশ সেনা অফিসারসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্রোহকালীন অবরুদ্ধ কর্মকর্তাদের উদ্ধার করতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তথাকথিত আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে হত্যাকাণ্ডকে নির্বিঘ্ন করতে সুযোগ করে দেয়। জনগণের জোরালো দাবির মুখে বিডিআর বিদ্রোহের বিষয়ে একটি প্রহসনমূলক তদন্ত কমিশন গঠন করে ষড়যন্ত্রের হোতাদের বাদ দিয়ে একটি মনগড়া রিপোর্ট প্রকাশ করে।

বিচারকদেরও জবাবদিহি থাকা উচিত : মামলার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের কর্মকাণ্ড ট্রাইব্যুনালের সামনে আনেন তিনি। এ সময় ট্রাইব্যুনাল বলেন, অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অব জুডিশিয়াল রয়েছে। কিন্তু জাজদের (বিচারক) অ্যাকাউন্টিবিলিটির (জবাবদিহি) কোনো ব্যবস্থা নেই। অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা পড়ে আছে, আমরা বিচার করতে পারছি না। জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা রেখে সরকারের অথরিটি পালন করছেন। তাদের একটা সিস্টেমের মধ্যে আসতে হবে। বিচারের নামে স্বাধীনতা মানে তো আপনি যা খুশি তা করবেন, এটার নাম স্বাধীনতা না। জুডিশিয়াল কাউন্সিলেরও যদি কেউ অফেন্স (অপরাধ) করে, তাদেরও জবাবদিহি বা বিচারের আওতায় আনার একটা সিস্টেম থাকতে হবে। এ প্রসঙ্গে ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, চেয়ারম্যান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে এসব বলেছেন। বিগত সরকারের সময় বিচারের নামে বিচারকরা স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা আজ সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের প্রতারণার কথা তুলে ধরেছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের সময় যে জাজমেন্ট প্রথমে ওপেন কোর্টে দেওয়া হয়েছিল, পরে চূড়ান্ত রায়ের সময় সেই রায়ের অংশটুকু বাতিল করে দিয়ে সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন তিনি। প্রধান বিচারপতির মতো আসনে অধিষ্ঠিত থেকে খায়রুল হক এই স্বেচ্ছাচারী কাজ করেছেন। এই বিচারকরা গুরুত্বপূর্ণ মামলা ফেলে রেখে সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী গুরুত্বহীন মামলাকে বিচারের জন্য নিয়ে আসতেন। কাউকে ফাঁসি দেওয়ার প্রয়োজনে সেই মামলাকে আগে নিয়ে আসা, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অন্য মামলাকে পেছনে ফেলে দেওয়া এই বিচারকদের স্বেচ্ছাচারিতা। এটা রোধ করতে সাংবিধানিক অথবা আইনি ব্যবস্থা থাকা উচিত বলে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের কাছেও তিনি অভিমত পাঠিয়েছিলেন। এই বিচারপতিদের অথবা বিচারকদের ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট বিধান থাকা উচিত। যেন ভবিষ্যতে তারা আর কখনো এমন হতে না পারেন।

এই মামলায় প্রসিকিউশন পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শুনানি করেন। উপস্থিত ছিলেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এসএইচ তামিম ও বিএম সুলতান মাহমুদ। পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। আর এ মামলায় গ্রেফতার হয়ে রাজসাক্ষী হওয়া সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী যায়েদ বিন আমজাদ। আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। বিকালে যুক্তিতর্ক সোমবার পর্যন্ত মুলতুবি করেন ট্রাইব্যুনাল।

এদিকে জুলাই আন্দোলনে চট্টগ্রামে ছাত্রদল নেতা ওয়াসিমসহ ১১ জন হত্যা মামলায় চট্টগ্রাম-৬ আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীসহ আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলে আরও এক মাস সময় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল-১। একই সঙ্গে ১২ নভেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম