Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

রূপনগরে কারখানায় আগুন

মর্গের সামনে স্বজনদের বুকফাটা কান্না

শিপন হাবীব

শিপন হাবীব

প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

মর্গের সামনে স্বজনদের বুকফাটা কান্না

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের এক মর্গ থেকে আরেক মর্গে দৌড়াচ্ছেন এক অসহায় বাবা। প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়ে বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন স্ত্রী। বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন বৃদ্ধ এক মা। বডি ব্যাগে (মৃতদেহ বহনকারী নির্ধারিত ব্যাগ) রাখা একেকটি মৃতদেহ পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে। কারও শরীরের দেহাবশেষ পড়ে আছে। চেনার উপায় নেই। অঙ্গার দেহের ওপর আছড়ে পড়ছিলেন স্বজনরা। সব মানবিক অনুভূতিকে স্তব্ধ করে দেওয়া সেই দৃশ্যের সাক্ষী ছিলেন চিকিৎসক, নার্স, পুলিশ ও গণমাধ্যমকর্মী। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন তারাও। স্বজনদের আর্তি-এমন মৃত্যুর জন্য কে দায়ী? আমাদের স্বজনরা শুধু পরিবারের মুখে একমুঠো ভাতের জোগান দিতে কাজ করত। তবুও অঙ্গার হতে হলো কেন? রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে কেমিক্যাল গোডাউন ও পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মারা যান তারা।

১৬ বছর বয়সি মুন্নী আক্তার মুনার লাশ পুড়ে ছাই। হাসপাতাল মরচুয়ারির সামনে ২০ বছর বয়সি স্বামী নাঈম বুক চাপড়ে বিলাপ করছিলেন। মা তাহারা বেগম ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে নিজেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রেম করে দুজন ৬ মাস আগে বিয়ে করেছিলেন। নাঈম জানান, দুজন একটু ভালো থাকতে কিছুদিন আগে রাজধানীতে আসেন। মাত্র ২/৩ দিন আগে তার প্রিয় মানুষটিকে কাজে দিয়েছিলেন। মুনা মঙ্গলবার সকাল ৭টায় আর নাঈম ৮টায় কাজে বের হয়েছিলেন। নাঈম একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। প্রথম মাসের বেতন পেয়ে একে অপরকে উপহার কিনে দেওয়ার কথা ছিল। কে জানত, জীবন শুরুর মুহূর্তেই পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবেন স্ত্রী! ক্ষোভ উগরে বললেন, ‘আচ্ছা বলেন তো, আমার মুনার কী অপরাধ ছিল? কেন পুড়ে মরতে হলো তাকে। মুনাকে ছাড়া কীভাবে বাঁচব। আমি নিজে মুনাকে এই শহরে নিয়ে এসেছিলাম।’

মর্গে-মর্গে দৌড়াচ্ছিলেন অসহায় বাবা উজ্জ্বল মিয়া। হাতে ১১ বছর বয়সি ছেলে মনির হোসেনের ছবি। মর্গের ভেতর একেকটি অঙ্গার লাশ দেখে শুধু বিলাপ করছিলেন। কোনটা তার প্রিয় ছেলের লাশ। একপর্যায়ে বারান্দায় এসে ছেলের ছবি বুকে নিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলছিলেন, ‘আমার বাপজানকে এনে দেন। এ শহরে আর কোনোদিন আসব না। আমার ছেলেকে ওইদিনই (মঙ্গলবার) প্রথম দিনের মতো স্মার্ট প্রিন্টিং দোকানে কাজের জন্য পাঠিয়েছিলাম। নিজ হাতে মাথায় আদর করে দিয়ে বলেছিলাম, বাবা সাবধানে কাজ করিও। সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করিও। আজ আমার ছেলে নেই’।

১৪ বছর বয়সি আলীম হোসেনের বাবা নূর ইসলাম মর্গের স্টাফদের করজোড় করে বলছিলেন, ‘আমার ছেলে পুড়ে গেলেও আমি চিনতে পারব।’ এমন অনুরোধে বেশ কয়েকবার নূর ইসলামকে মর্গের ভেতরে যেতে দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি তার ছেলেকে তখনও (বুধবার বিকাল পৌনে ৩টা) পর্যন্ত চিনতে পারেননি। মর্গের পাশে পড়ে বিলাপের শেষ হচ্ছিল না তার। তাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে মর্গের স্টাফরাও বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

বাবা বলছিলেন, ‘এক মাস হলো আমার ছেলে কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে চাকরি নিল। আগে জানলে আমার বাপরে কখনো এখানে (ঢাকাতে) নিয়ে আসতাম না।’ ওই মর্গে ৭টি পোড়া লাশ রয়েছে। ২টি নারী, ৫টি পুরুষের।

ঢামেক হাসপাতালের মরচুয়ারিতে ৯টি লাশ রাখা হয়েছে। মরচুয়ারির পাশেই বিলাপ করছিলেন এক নারী। বলছিলেন, ‘আমাকে মামুনের কাছে নিয়ে যাও। মামুনকে ধরে ঘুমিয়ে থাকব। মামুন ছাড়া আমরা কী করে বাঁচব।’ ইঞ্জিনিয়ার আল মামুন ওখানকার পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। অঙ্গার হয়ে যাওয়া স্বামীর লাশ পেতে স্ত্রী অ্যামি বিলাপ করছিলেন। অ্যামির বাবা জানালেন, আল মামুনের বাড়ি বরগুনার আমতলীতে। স্ত্রী এবং দুই সন্তান ইবাদ (৭) ও মুসাবকে (দেড় বছর) নিয়ে ঢাকায় থাকতেন।

২৩ বছর বয়সি মৃত নূর আলমের চাচা আনোয়ার হোসেন জানালেন, নূর আলম ১ বছর আগে বিয়ে করেন। স্ত্রী গীনি আক্তার স্বামীর মৃত্যুতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাবা আমিনুল ইসলাম ছেলের পোড়া লাশ দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।

এদিকে ১৬ লাশের স্বজনরা ঢামেক হাসপাতালের দুই মর্গের পাশে বিলাপ করছেন। তারা অনুরোধ জানিয়েছেন, যত দ্রুত সম্ভব স্বজনদের কাছে যেন লাশ হস্তান্তর করা হয়। মৃত আলো আক্তারের বাবা রতন মিয়া মেয়েকে চিহ্নিত করতে পেরেছেন। তবে পুড়ে অঙ্গার হয়ে আছে মেয়ে। তার স্বামীর নাম জয়। জয়ও নিখোঁজ। দুজনই চাচাতো ভাই-বোন। কারও বয়স ২০ বছর পার হয়নি। গত ঈদুল আজহার দুই দিন পর তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর দুজনই এ কারখানায় চাকরি নিয়েছিলেন। কারখানার পাশের একটি বস্তিতে ভাড়া থাকতেন।

ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগ মর্গে ৭টি লাশ রয়েছে। মরচুয়ারির ভেতর ৯টি। জরুরি বিভাগ মর্গে থাকা সাত লাশের মধ্যে ২টি নারী ও ৫টি পুরষের। মরচুয়ারিতে থাকা ৯ লাশের মধ্যে চারজন পুরুষ ও পাঁচজন নারীর। এ বিষয়ে সিআরডির এসআই মো. বাচ্চু মিয়া যুগান্তরকে জানান, তারা প্রতিটি লাশের তথ্য-উপাত্ত এবং বর্তমান অবস্থান লিপিবদ্ধ করছেন। কোনো লাশই ডিএনএ টেস্ট ছাড়া দেওয়া সম্ভব নয়। অধিকাংশ লাশ পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে।

পুড়ে মারা যাওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১০ জনের লাশ শনাক্তের দাবি করেছেন স্বজনরা। এ তথ্য জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানান, সব লাশের চেহারা বিকৃত হয়ে গেছে। তবে ১০ জনের লাশ শনাক্তের দাবি করেছেন স্বজনরা। ভবিষ্যতে সমস্যা এড়াতে এখন সবক’টি লাশের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হচ্ছে। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে স্বজনদের কাছে আপাতত এই ১০টি লাশ হস্তান্তর করা যাবে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম