Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

আদানির সঙ্গে চুক্তি প্রসঙ্গে জ্বালানি উপদেষ্টা

অনিয়ম প্রমাণ হলে বাতিলে দ্বিধা নয়

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অনিয়ম প্রমাণ হলে বাতিলে দ্বিধা নয়

ভারতের আদানির সঙ্গে বিদ্যুৎ নিয়ে করা চুক্তিতে যদি কোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রমাণ মেলে, সরকার তা বাতিলে দ্বিধা করবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি চুক্তিতেই স্বীকারোক্তি থাকে যে, এ চুক্তিতে কোনো দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়নি। কিন্তু এটা যদি ভায়োলেট করা হয়, তাহলে চুক্তি বাতিল করা যায়। যদি-কিন্তু প্রমাণিত হয়, তাহলে বাতিল করা সম্ভব। মুখের কথা আদালত মানবে না, যথাযথ কারণ থাকতে হবে।’

রোববার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংক্রান্ত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় কমিটি আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন জ্বালানি উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘চুক্তি বাতিলের একটা প্রক্রিয়া আছে। সাধারণ কোনো কারণ দেখিয়ে এবং কারণ ছাড়া-দুভাবে চুক্তি বাতিল করা যায়। তবে কারণ ছাড়া চুক্তি বাতিল করলে নির্ধারিত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।’

এ সময় চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির সদস্য ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক (অর্থনীতি) মোশতাক হোসেন খান এবং বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন সেখানে ছিলেন। 

মোশতাক হোসেন বলেন, যে চুক্তিগুলো হয়েছে, সেগুলো সার্বভৌম চুক্তি। একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি কোম্পানির চুক্তি সই হয়েছে। সার্বভৌম চুক্তি আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। যদি মনে হয়, এখানে কোনো কারচুপি হয়েছে, আপনি ইচ্ছামতো এটাকে বাতিল করতে পারবেন না। এটা বাতিল করলে আপনার ওপর অনেক বড় জরিমানা আসবে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে। এজন্য আমাদের অনেক সময় লেগেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখা যে প্রক্রিয়াগুলো কী ছিল। সেখানে কোথায় ব্যতিক্রম হয়েছে। আমরা যে বিষয়গুলো পেয়েছি, এর সবকিছু অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে নেই। কারণ, কিছু জিনিস চলমান। সেজন্য আমরা সেগুলোকে প্রকাশ করিনি।

মোশতাক হোসেন আরও বলেন, আপনারা মাস খানেকের মধ্যে আরও অনেক দুর্নীতির তথ্য পাবেন। এখানে ব্যাপক দুর্নীতি। এই দুর্নীতি আমাদের রোধ করতেই হবে। এটাকে মেনে নেওয়া বা সহ্য করা সম্ভব নয়। ইতোমধ্যে দেশে বিদ্যুতের দাম আমাদের প্রতিযোগীদের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি হয়ে গেছে। এটা এই দুর্নীতির কারণে। সাবসিডিগুলো সরিয়ে দিলে এটা হয়তো ৪০ শতাংশ হয়ে যাবে। আমাদের হিসাবে বিদ্যুতের এই দামে বাংলাদেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠান টিকতে পারবে না। তাই আমাদের এটাকে শুধরাতেই হবে। এটা যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অধ্যাপক মোশতাক হোসেন বলেন, আমাদের প্রতিবেদনে আছে কোথায় কোথায় ভুলগুলো করা হয়েছে। যেখানে ইন্টারভেনশন করা হয়েছে, ওপর থেকে হুকুম এসেছে। প্রশাসন সবসময় নির্দোষ ছিল তাও না, সেটারও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মাশুল দিচ্ছেন সাধারণ ভোক্তা, ক্রেতা ও করদাতারা। আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তারা চলে গেছেন।

এ অধ্যাপক আরও বলেন, এই যে বিশাল অঙ্কের ঋণ ও বেশি দামের বিদ্যুৎ-যারা এখান থেকে টাকা নিয়ে চলে গেছে, তাদের বুঝাতে হবে আপনারা এটা থেকে পার পাবেন না। আমরা প্রমাণ সংগ্রহ করছি, অ্যাকশন নেওয়া হবে-ভবিষ্যতে যাতে এটা আর না হয়। এটা অনেক কঠিন কাজ। সবাইকে একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে। কারণ, এটা তাড়াতাড়ি করার কাজ নয়। তাড়াতাড়ি করলে ভুল হবে। এ বিষয়ে দ্বিতীয় আরেকটি রিট পিটিশন হয়েছে জানিয়ে মোশতাক হোসেন বলেন, প্রথম রিট পিটিশন করেছিলেন শাহদীন মালিক। দ্বিতীয় রিট পিটিশনের বিষয়ে পত্রিকায় সেভাবে আসেনি। সেটা আসা উচিতও নয়। পত্রিকায় খবর এসেছে যে আদানির চুক্তির সঙ্গে অনেক দুর্নীতি ছিল। এ দুর্নীতি সম্পর্কে কেন কিছু করা হচ্ছে না? আদালত একটা রুলিং দিয়েছে-৬০ দিনের মধ্যে দুদকসহ যাদের নাম রিট পিটিশনে আছে, তাদের একটা তদন্ত করে আদালতে রিপোর্ট দিতে হবে। আমরা সেই কাজেও সহায়তা করছি। আমাদের বিশ্বাস, আপনারা মাসখানেকের মধ্যে এই দুর্নীতির শক্ত প্রমাণ পাবেন। সেটা যখন হবে, তখন আদানি এবং আরও কয়েকটি বড় কোম্পানি যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে আইনি প্রক্রিয়া চালু করা হবে ইনশাআল্লাহ। বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ও অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ কেনার জন্য যে চুক্তিগুলো ছিল এবং এর পেছনে যে চিঠি আদান-প্রদান হয়েছে, একটি চুক্তি করার ক্ষেত্রে যাদের মতামত নিতে হয়, সেই বিষয়গুলো দেখেছি। ২০০৮-০৯ থেকে ২০২৪ অর্থবছর পর্যন্ত অর্থ পরিষদের তথ্যপত্র আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সেগুলো আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি। 

তিনি বলেন, ২০১১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন চারগুণ বেড়েছে; কিন্তু অর্থ পরিশোধ বেড়েছে ১১ গুণ। এটি কোনো টেকনিক্যাল ফ্যাক্ট দিয়ে এক্সপ্লেইন করা সম্ভব নয়। আমরা ২০১১ সালে বিদ্যুতের জন্য ৬৩৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করেছিলাম, যেটা ২০২৪ সালে এসে বেড়ে ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। কাদের টাকা পরিশোধ করছে, এর বিপরীতে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ পাচ্ছি, সেই হিসাব মেলানো যায় না-সেটাই আমাদের মূল ফাইন্ডিং। বিশেষ বিধান আইনে বারবার মেয়াদ বাড়ানো হলো, বারবার দায়মুক্তির পথ খুলে গেল। এছাড়া আছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সব সময় প্রধানমন্ত্রীর অধীনে ছিল। প্রধানমন্ত্রীর অফিস এবং অন্যান্য মিলে ওখানেও একটা সমস্যা আছে। এটা একদম চোখে পড়ে।

কমিটির আহ্বায়ক মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, চুক্তি কতটা বাতিল করা যাবে, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিগুলো পুরোপুরি কারিগরি, তাই সময় লেগেছে পর্যালোচনায়। এতে ব্যাপক দুর্নীতি পাওয়া গেছে। আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

পর্যালোচনা কমিটির সুপারিশে মূলত ভবিষ্যতে সুরক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যাতে এ ধরনের চুক্তি না করা হয়। চুক্তির আগে স্বাধীন কমিশনের মাধ্যমে যাচাই করে দেখার কথা বলা হয়েছে। পর্যালোচনা কমিটির পরামর্শে গত ২১ জানুয়ারি করা হয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ট্যারিফ (বিদ্যুতের দাম) পর্যালোচনা কমিটি। এ কমিটির কাজও চলমান।

দায়মুক্তি আইন হিসাবে পরিচিত বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি বাতিল করা হয় গত বছরের নভেম্বরে। এর আগেই এ আইনের অধীনে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত সরকারের করা চুক্তিগুলো পর্যালোচনায় গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে আছেন হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী। কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন-বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সহ-উপাচার্য আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশের সাবেক প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আলী আশফাক, বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের অর্থনীতির অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান ও সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।


Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম