Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

খেলাপি রোধে অধ্যাদেশের খসড়া চূড়ান্ত

পাচারের সম্পদ সন্ধান করবে অর্থঋণ আদালত

মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে ৯০ দিনের মধ্যে

মিজান চৌধুরী

মিজান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পাচারের সম্পদ সন্ধান করবে অর্থঋণ আদালত

অর্থঋণ আদালত খেলাপিদের বিদেশে পাচার করা অর্থ সন্ধানের ক্ষমতা পাচ্ছে। ‘অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশে’র মাধ্যমে এ ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। এতে ঋণের অর্থ অপব্যবহার করে দেশে বা ভিন্ন দেশে সম্পদ অর্জন করছে কিনা-এর তদন্ত করতে পারবে। বিদেশে অর্থ পাচার ও অর্জিত সম্পদ শনাক্ত হলে তা ফেরত আনা এবং পুনরুদ্ধারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন এ আদালত। এর মাধ্যমে দেশের আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানো এবং ব্যাংক খাতে ঋণের শৃঙ্খলা ফেরাতে চায় সরকার। এ সংক্রান্ত খসড়াটি চূড়ান্ত করে অর্থ উপদেষ্টার কাছে পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো ধরনের আপত্তি না থাকলে শিগগিরই এটি অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হবে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নতুন অধ্যাদেশে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, অর্থঋণ আদালত সংশ্লিষ্ট খেলাপির জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে থাকার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে পারবেন।

নতুন অধ্যাদেশ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর অর্থ উপদেষ্টাকে একটি চিঠি দিয়েছেন। অধ্যাদেশটি বাস্তবায়ন হলে যে তিন বিষয়ে প্রত্যাশিত ফল আসবে তা চিঠিতে তুলে ধরেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন-‘খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের সময়সীমা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাবে’ ও ‘নির্বাহী সহায়তার মাধ্যমে প্রয়োগ প্রক্রিয়া শক্তিশালী হবে’ এবং ‘আর্থিক পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার সামগ্রিক দক্ষতা ও সুশাসন বৃদ্ধি পাবে’। তিনি আরও বলেন, উল্লিখিত পরিবর্তনগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ঋণ শৃঙ্খলা ফেরাবে এবং শ্রেণীকৃত ঋণ কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সূত্র মতে, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে ‘অর্থঋণ আদালত অধ্যাদেশ ২০২৫’ চূড়ান্ত করেছে। সেখানে ঋণখেলাপির মামলা ৯০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে। বিশেষ কারণে ৩০ দিন সময় বাড়ানো হবে। নির্ধারিত সময়সীমা ভঙ্গ হলে আপিলের সুযোগ থাকবে। এছাড়া এক তরফা ডিক্রি বাতিলের আবেদনের ক্ষেত্রে জামানত জমার হার ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর বিধান থাকছে, যা আগে ১০ শতাংশ দিয়েই আবেদন করতে পারত। এছাড়া কার্যকরী প্রক্রিয়া ‘রিকভারি সার্টিফিকেট’ পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়া পরিচালনা করবেন রিকভারি অফিসার।

এদিকে একাধিক কার্যকর মামলা দায়েরের প্রথা বিলুপ্তির বিধান থাকছে নতুন অধ্যাদেশে। সম্পূর্ণ কার্যকরীকরণ প্রক্রিয়া ৯০ দিনের মধ্যে সম্পন্ন করতে হবে, প্রয়োজনে ৬০ দিন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর বিধান থাকবে। খসড়া অধ্যাদেশে বলা আছে, জামানতদার ঋণদাতাদের অগ্রাধিকার দেবে। এছাড়া মামলা দায়েরের আগে আদালত কর্তৃক অর্ন্তবর্তী আদেশ (যেমন : নিষেধাজ্ঞা, রিসিভার নিয়োগ, সম্পদ জব্দ, তথ্য প্রকাশের নির্দেশ বা দেওয়ানি আটকাদেশ) প্রদান করতে পারবে। আর সর্বোচ্চ আটকাদেশের মেয়াদ ছয় মাস থেকে বাড়িয়ে এক বছরে উন্নীত করা হয়েছে। আদালত গঠন প্রসঙ্গে সেখানে বলা হয়, অভিজ্ঞ বা বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বিচারকদের একটি পুল থেকে বিচারক নিয়োগ বিধান থাকবে। এছাড়া অর্থঋণ আদালত নামে একটি আপিল আদালত গঠন করা হবে।

এর আগে ২০১৯ সালে ‘অর্থঋণ আদালত আইন ২০০৩’ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। যেখানে খেলাপি ঋণের জন্য পৃথক আদালত তৈরি করা, খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের হালনাগাদ তথ্য নিয়মিত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করার মতো প্রস্তাব ছিল, যদিও তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি।

গত জুন পর্যন্ত অর্থঋণ আদালতে ২০ হাজার ৫৯৩টি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে তিন হাজার ২৬৯ মামলা ঝুলছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। আর উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত রয়েছে ৪২টি মামলা। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এসব মামলার মধ্যে শুধু ঢাকার চারটি অর্থঋণ আদালতেই বিচারাধীন ৮৫৭৮টি খেলাপি ঋণের মামলা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, অর্থঋণ আদালতে কোনো মামলার রায় বা আদেশ পাওয়ার পর খেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিট করে দিচ্ছেন। যদিও অর্থঋণ আদালত আইনে বলা আছে, মামলার চূড়ান্ত রায় চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাওয়া যাবে না। এ নির্দেশ কেউ মানছে না। মূলত রিট করে মামলাগুলো নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সূত্রতা তৈরি করাই মূল্য লক্ষ্য, যেন দ্রুত নিষ্পত্তি না হয়।

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, শীর্ষ ঋণ খেলাপির অধিকাংশ মামলা ঘিরে উচ্চ আদালতে একাধিক রিট আছে। এমন তথ্যও মিলছে একটি মামলার বিপরীতে সর্বোচ্চ আটটি রিট দায়ের করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চারটি ও পাঁচটি পর্যন্ত রিট আছে। আবার আদালতে শুনানির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলেও, দেখা গেছে মামলার সিরিয়াল নম্বর কার্যতালিকার অনেক নিচে। এসব প্রেক্ষাপটে এখন অর্থঋণ আদালতকে আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদি ড. মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, অর্থঋণ আদালতকে অনুসন্ধানের ক্ষমতা দেওয়ার চেয়ে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ খেলাপিকে ট্রাইব্যুনালে বিচার করা যায় সে উদ্যোগ নিতে পারলে ভালো হবে। কারণ ট্রাইব্যুনালে গেলে উচ্চ আদালতে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। ফলে মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকবে না। এটি কার্যকরী পদক্ষেপ হবে বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ।

জানা গেছে, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিল বাইশ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই লাখ এগার হাজার কোটি টাকা। আর ২০২৫ সালের জুন নাগাদ খেলাপি ঋণ গিয়ে ঠেকেছে পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে তিন লাখ ১৯ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যাচ্ছে, গত কয়েক মাসে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পাঁচ লাখ ত্রিশ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম